(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
রয়ে সয়ে লাঞ্চ করছিলাম। পাঁচতারকা হোটেলে লাঞ্চ, সুতরাং এটার বর্ণনা দেয়ার খুব বেশি দরকার আছে বলে মনে হচ্ছে না। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খাবার অর্ডার এবং নষ্ট করা যেনো এসব স্থানের কালচার। আমাদের বেলায়ও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। খাবারে খাবারে টেবিলের চেহারা পাহাড়ের মতো হয়ে গেলো। টেবিলে জায়গা না হওয়া এক ডিসের উপর অপর ডিস রাখা হচ্ছিল। বিশ্বের নানা দেশের মানুষ একসাথে বসেছি আমরা। চীন কোরিয়া জাপানের পাশাপাশি ভারত বাংলাদেশ পাকিস্তান কিংবা কলম্বিয়ার মতো দেশের মানুষও রয়েছেন। ইন্টারন্যাশনাল লাঞ্চ। অতএব সবার কথা বিবেচনা করেই রকমারি খাবারের অর্ডার দেয়া হয়েছে। এমন বহুজাতিক লাঞ্চ কিংবা ডিনারে অতীতে বহুবার যোগ দেয়ার সুযোগ হয়েছে। তাই পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায় পরিস্থিতি সামলে খাওয়া দাওয়া করতে আমার অসুবিধা হচ্ছিলো না। তাছাড়া পাশে ‘চীনা মানুষ’ লায়ন ফজলে করিম রয়েছেন। যেখানে ঠেকছি সেখানে তিনি হাত লাগাচ্ছেন। তাই খাবার পছন্দে আমার খুব একটা বেগ পেতে হচ্ছিলো না। আমরা সবাই মিলে যার যেটা ইচ্ছে সেটা নিজের প্লেটে তুলে নিয়ে খাচ্ছিলাম।
লাঞ্চের পরও কেউ কেউ গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিলেন। অবস্থা দেখে আমার মনে হলো যে, এরা মাগনায় পাওয়া দামি মদের লোভ ছাড়তে পারছেন না। আমাদের কয়েকজনকে গ্লাস থেকে দূরে থাকতে দেখে ফ্রাঞ্চি এগিয়ে এলো। কাঁধের উপর হাত রেখে বললো কোন এনার্জী ড্রিংকস বা কোল্ড ড্রিংকস নেবো কিনা। সুযোগটি আমি হাতছাড়া করলাম না। বললাম ‘হট ড্রিংকস’ খাওয়ালে খাবো। কিছু না বুঝে ফ্রাঞ্চি একবার আমার দিকে একবার করিম ভাইয়ের দিকে তাকাতে লাগলো। তার চোখে মুখে পৃথিবীর অষ্টমাশ্চর্য! টেবিলে এতো ‘হট ড্রিংকস’ থাকতে আমি আবার কোন ‘হট ড্রিংকসের’ কথা বলছি! কোন স্প্যাশাল ব্রান্ড কি! ফ্রাঞ্চিকে বললাম, ম্যানেজ করা গেলে এক কাপ কফি খাবো। খিলখিল করে উঠলো ফ্রাঞ্চি। চীনা মেয়েরাও কী বাঙালি মেয়েদের মতো হাসতে পারে! লায়ন ফজলে করিম এবং ডালিয়া ভাবী কফি নেবেন না। শুধু আমি একাই ধুমায়িত কফির মগে চুমুক দিতে লাগলাম।
শাসা এবং ফ্রাঞ্চি আমাদের জানালো যে, বিকেলটা পুরো ফ্রি। ইচ্ছে করলে এখানে ধারে কাছে কোন দর্শনীয় স্থান বা পর্যটন স্পট আমরা ঘুরে দেখে আসতে পারি। রাতে ডিনারও এখানে হবে বলেও শাসা জানিয়ে দিলো।
রুমে ফিরে কিছুটা ফ্রেশ হয়ে আবারো লবিতে নেমে আসলাম। সেই আলীশান লবি। বিশাল রিসিপশন ডেস্কে চীনা সুন্দরীদের আনাগোনা। সেদিকে না গিয়ে আমি সোফায় গিয়ে বসলাম। লায়ন ফজলে করিম ডালিয়া ভাবী এবং ইতোমধ্যে আমাদের সাথে যোগ দেয়া বাংলাদেশের বিশিষ্ট গার্মেন্টস ব্যবসায়ী সোহেল শাহাদাতের জন্য অপেক্ষা করছি। ওনারা আসলে আমরা কোথাও ঘুরতে যাবো। সোহেল শাহাদাত চট্টগ্রামের সন্তান হলেও ঢাকায় থাকেন। ব্যবসা বাণিজ্যের বেশিরভাগই ঢাকায়। তবে চট্টগ্রামেও একাধিক গার্মেন্টস কারখানা রয়েছে।
হোটেল রিসিপশনে গিয়ে এক তরুণীকে কিছুটা পটানোর চেষ্টা করলাম। জানতে চাইলাম,ধারে কাছে দেখার মতো কোন কিছু আছে কিনা। মেয়েটি অনেকক্ষণ চিন্তা করে একটি জায়গার নাম বললো। আমি বুঝতে বা চিনতে পারলাম না। তাকে অনুরোধ করলাম চীনা ভাষায় কাগজে নামটি লিখে দেয়ার জন্য। সে বেশ খুশি হয়েই কাজটি করে দিল। আমি সোফায় গিয়ে আবারো অপেক্ষা করতে লাগলাম।
অল্পক্ষনের মধ্যেই আমরা চারজন একটি গাড়ি নিয়ে রওয়ানা হলাম। বলে রাখা ভালো যে, গাড়িও ডাকিয়েছিলাম রিসিপশনের ওই তরুণীকে দিয়ে। ফাইভ স্টার হোটেলগুলো কাস্টমারদের এই সার্ভিসটি আনন্দের সাথে দিয়ে থাকে।
করিম ভাই এবং সোহেল ভাই দুজনেই জানতে চাইলেন কি দেখতে যাচ্ছি। কিছুই বলতে পারলাম না। যেখানে যাচ্ছি সেখানে কি আছে কে জানে। মেয়েটি বলেছে বলেই তো যাচ্ছি। ডালিয়া ভাবী টিপ্পনি কাটলেন। করিম ভাইকে বললেন, দেখো, সুন্দরী মেয়ের পরামর্শে তোমার আকবর ভাই কোথায় আবার যাচ্ছেন!
তরুণীর হাতে লেখা চিরকুটটি ড্রাইভারকে দিয়েছি। তিনি গাড়ি চালাচ্ছেন। মিটার চলছে। সুতরাং পথ হারানোর কোন শংকা নেই। হোটেলের বিজনেসকার্ড পকেটে রয়েছে। ফেরার সময় আবার কোন ড্রাইভারকে দিলে পৌঁছে দেবে। সুতরাং হারিয়ে যাওয়ার কোন শংকা নেই। অবশ্য কোন কারণে হারিয়ে গেলেও জ্যাক আমাদের উদ্ধার করবে। লোকাল ফোন যেহেতু রয়েছে, তাই যোগাযোগের ক্ষেত্র অবারিত।
গাড়ি থামলো। বেশ চওড়া রাস্তা, রাস্তার পাশেই চমৎকার একটি দীঘি, অনেকটা লেকের মতো। বিশাল। চোখের সামনে রাস্তার মাঝখানে পুরানো দিনের রাজবাড়ির আকাশছোঁয়া একটি গেট। গেটের চারদিকে নানা কারুকাজ। কত ধরনের কাজ যে বিশাল গেটটিতে করা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু গেটটির এখন আর কোন কাজ নেই, এটির চারদিকেই মানুষ এবং গাড়ি চলাচল করে। রাস্তার মাঝখানে এমনভাবে গেটটি রয়েছে, যেনো সাগরের বুকে ছোট্ট একটি পাহাড়। বিস্তারিত না জানলেও বুঝতে পারলাম যে, গেটের পেছনের অংশটি একসময় নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা থাকতো। আজ সবই উন্মুক্ত। গেটের উপরে একটি সন তারিখ লেখা, হিসেব কষে বুঝতে পারলাম যে, তারিখটি চারশ’ বছর আগের। অর্থাৎ চারশ’ বছরের পুরানো একটি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। চওড়া রাস্তা ধরে কিছুদূর এগিয়ে একটু বাঁক নিতেই অপর একটি রাস্তায় পড়লাম। এই রাস্তাটিও বিশাল। গাছে গাছে ঢেকে আছে রাস্তার উপরের পুরো আকাশ। আর গাছের ঢালে ঝুলছে ঝাড়বাতি টাইপের বর্ণিল লাইট। সন্ধ্যা নামতে আরো কিছুক্ষন দেরি থাকলেও লাইটগুলো জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। সেগুলোতে বর্ণিল আলো খেলা করছে।
লেকের মতো বিশাল দীঘির পাড় ধরে হাঁটছিলাম আমরা। লেকের একপাশে একটি প্রাসাদ। প্রাসাদের বেশ কিছু অংশ দীঘির পানিতে। চীনা স্থাপত্যে নির্মিত প্রাসাদটিতে এখন কেউ বসবাস করেন কিনা জানা যায়নি, তবে প্রথম দেখায় ভবনটি আমার মন ভরিয়ে দিল। এতো সুন্দর করেও প্রাসাদ বানানো যায়। দক্ষিণমুখী জানালাগুলো খুলে দিয়ে এমন প্রাসাদে রাত যারা কাটিয়েছেন তারা যে কী পরিমাণ সুখী ছিলেন তা ভাবার চেষ্টা করলাম। ভর চাঁদনীতে এমন প্রাসাদে রাতগুলো যে কী পরিমাণ বর্ণিল হতো কে জানে। এতোক্ষনে আমি রাস্তার মাঝখানে দেখে আসা গেটটি যে এই প্রাসাদকেই ঘিরে তা বুঝতে পারলাম।
লেকের পাড়ে শ’খানেক ডিঙ্গি নৌকার মতো নৌকা। বেশ নান্দনিক নৌকাগুলোতে চড়ে পর্যটকেরা দীঘির জলে ভেসে বেড়ান। তবে আমাদের সেই সুযোগ হলো না। কারণ একটু আগেই নৌকা চালানোর নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে গেছে। এখন আর কেউ জলে ভাসতে বা ভাসাতে পারবেন না। কয়েকজন স্থানীয় নাগরিক দীঘিতে মাছ শিকার করছিল। বড়শি দেখলেই আমার ভিতরটা নড়াচড়া শুরু করে। আমি চীনা ভদ্রলোকের পাশে গিয়ে বসে পড়লাম, এবং লোভাতুর দৃষ্টিতে ছিপের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। বেশ কিছুক্ষণ বসলাম, কিন্তু মাছের কোন সাড়াশব্দ নেই। বড়শিতেও নেই কোন নড়ন–চড়ন। দীঘিতে মাছ আছে কিনা কে জানে, নাকি বড় মাছ সারাদিনে এক দুইটি ধরে তাও অজানা। চীনা ভদ্রলোকের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তিনি ইংরেজির একটি শব্দও বুঝলেন না, কোন উত্তরও দিলেন না। শুধু হা করে আমার মুখের দিকে একটুক্ষন তাকিয়ে আবারও বড়শির দিকে নজর দিলেন।
আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। রাস্তার মাঝের গেটটি পেছনে রেখে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম। ব্যস্ততম সড়ক ধরে ছুটছে লেটেস্ট ডিজাইনের নানা গাড়ি। আমরা ফুটপাত ধরে এগুচ্ছি। রাস্তার পাশের পুরোটা জুড়েই অসংখ্য দোকান,শোরুম। খেয়াল করে দেখলাম যে, খাবারের দোকান থেকে কাপড়ের দোকান পর্যন্ত সবই রয়েছে। রয়েছে ব্যাগ, চশমা, ঘড়িসহ নানা পণ্যের দোকানপাটও। সোহেল ভাই টুক করে একটি দোকানে ঢুকে পড়লেন, পেছনে আমরাও। ৩০/৩৫ বছর বয়সী এক চীনা মহিলা দোকানটিতে বসে আছেন। দোকানে আর কেউ নেই। আমি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম যে, দোকানটির তাকজুড়ে চিরুনি আর চিরুনি। চার দেয়ালের অসংখ্য তাকে শত সহস্র চিরুনি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। শুধু চিরুনি বিক্রির জন্য যে আস্ত একটি দোকান হতে পারে তা আগে আমি কোনদিন দেখিনি। এখানে না দেখলে কেউ বললে আমি বিশ্বাসই করতাম না। দোকানের ভিতরে একপাশে সেলুনের চেয়ারের মতো একটি চেয়ার, চেয়ারের সামনের দেয়ালে ঢাউশ সাইজের আয়না। মনে করলাম, চুল কাটে। কিন্তু চালিয়ে নেয়ার মতো ইংরেজিতে ভদ্রমহিলা সোহেল ভাইকে যা বললেন, তাতে আমার অনেকটা ঘোর লেগে গেলো। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।