(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
চীনের হ্যাংঝো শহরে কয়েকটি অত্যাধুনিক গার্মেন্টস কারখানা দেখে আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করতে লাগলো। কী করেছে এরা! বোরট দিয়ে তৈরি পোশাক তৈরি করাচ্ছে! রোবট দিয়ে পণ্য গাড়িতে, গুদামে নিয়ে যাচ্ছে! আরো কত কিছু যে এরা করছে তার অনেককিছুই আমার মগজে ঢুকছিল না। সবগুলো ইকুইপমেন্টই তৈরি করেছে চীনা কোম্পানি জ্যাক। তাদের নিত্য–নতুন আবিস্কার গার্মেন্টস সেক্টরের আকাশচুম্বি উন্নয়ন নিশ্চিত করছে। তবে আগেই বলেছি যে, মানুষের কাজ কমে যাচ্ছে। রোবটই যদি সব কাজ করে ফেলে তাহলে মানুষ কী করবে!
চীনা বুদ্ধি বলে একটি কথা প্রচলিত আছে। কিন্তু সেই বুদ্ধি যে কী বিস্ময়কর তা দেখতে হলে চীনে ঘুরতে হবে। চীনে আমি আগেও এসেছি, করোনাকালের আগে। করোনার বিশাল ধাক্কায় চীন তছনছ হয়ে গেছে বলে মনে করতাম আমি। কিন্তু এবার চীনে এসে আমার সেই ধারণা ভুল বলে প্রমাণিত হলো। চার বছরের ব্যবধানে চীন ‘চীনা বুদ্ধি’তে নিজেদের যেখানে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে সেখানে পৌঁছাতে পৃথিবীর বহু দেশেরই কয়েকশ’ বছর লাগবে। বিমানবন্দর, রেলওয়ে স্টেশন কিংবা শত শত মাইল রাস্তা গাড়িতে চড়ে মনে হচ্ছে, চীন দু’চারশ’ বছর পরের চিন্তা করে নিজেদের গড়ে নিয়েছে। রাস্তার কোথাও ৬ ইঞ্চির একটি গর্তও চোখে পড়লো না। চীনারা প্রচুর সিগারেট টানে ( বুদ্ধি খোলার জন্য কিনা কে জানে!) কিন্তু রাস্তা বা হোটেল রেস্তোরাঁর কোথাও একটি সিগারেটের টুকরো দেখলাম না। জ্বী, কোথাও দেখিনি। একটিও নয়। ঘরের পাশের নালা, খাল এবং নদীর কোথাও ময়লার চিহ্ন নেই। শত শত মাইলের রাস্তার দুপাশে কেবল ফুল আর ফুল, গাছগাছালী। এতো গাছ, এত্ত গাছ আমি দুনিয়ার কোথাও দেখিনি। যাক, বলছিলাম চীনা বুদ্ধির কথা। কিন্তু সেই বুদ্ধি যে এমন শানদার তা কী আগে বুঝতে পেরেছিলাম!!! বিশ্বের কারখানা হিসেবে খ্যাত চীন। পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশই চীনা পণ্যের দখলে। এই যে আমেরিকার সাথে চীনের এমন লাগালাগি, অথচ আমেরিকার বাজারে চীনা পণ্যের জয় জয়কার। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য বা অন্যান্য দেশেও চীনের পণ্যসম্ভার সমৃদ্ধ।
এই পণ্য সামগ্রি উৎপাদনে চীন রোবট ব্যবহার করছে। ২০ জন মানুষের কাজ এক একটি মেশিন বা রোবট করে দেয় খুবই দ্রুততম সময়ে। কাঁচামালের পর্যায় থেকে রপ্তানির জন্য ডেলিভারি পয়েন্ট পর্যন্ত রোবটিক ব্যবহারে চীনা বুদ্ধির দারুণ প্রভাব। চীনে নাকি বছরে পাঁচ লাখ ইঞ্জিনিয়ার পাশ করে কাজে ঢুকেন। যাঁদের বুদ্ধির শানের কাছে তাবত বিশ্বের মান অনেকটা জিম্মি হতে চলেছে!!!
গার্মেন্টস কারখানায় ঘোরাঘুরি শেষ হলো আমাদের। আমাদেরকে কারখানার এসেম্বলী স্থানে জড়ো হওয়ার তাগাদা দিয়ে গাইড আগে আগে পথ চললেন। কারখানার সামনেই একটি খোলা চত্বর। সেখানে আমাদেরকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে একটি ছবি তোলা হলো। পৃথিবীর নানা দেশের গার্মেন্টস ব্যবসায়ী এবং সাংবাদিক রয়েছেন দলটিতে। গাইড বললেন, আপনাদের পদচারণায় আমাদের কারখানা ধন্য হয়েছে। তাই স্মৃতি হিসেবে ছবি তুলে রাখলাম।
আমরা নিজেদের বাসে চড়ে বসলাম। আমাদের প্রটোকল অফিসার শাসা এবং ফ্রাঞ্চি মাথা গুনে দেখে নিল। আসলে মানুষ মাত্র আমরা কয়েকজন। বাসের হেথায় হোথায় বসার কারনে ফ্রাঞ্চিকে মাথা গুনতে প্রায় পুরো বাসটিতেই হাঁটতে হলো।
একটি বিষয় খেয়াল করলাম যে, আমাদের সবাইকে একটি বা দুইটি বাস দিলেই হয়ে যেতো। চল্লিশ সিটের একটি বাসে পঁচিশজন করে বসলেও আমাদের দুইটির বেশী বাস লাগার কথা নয়। অথচ এখানে তা না করে শুধু বাংলাদেশ আর কলম্বিয়ার জন্যই একটি বাস দেয়া হয়েছে। ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনামসহ অন্যান্য দেশের জন্যও রয়েছে বাসের পৃথক পৃথক আয়োজন। খরচ করতে কার্পণ্য না থাকলে বুঝি এমনটি করা যায়।
আমাদের বাস চলছে। প্রোগ্রাম অনুযায়ী এখন আমাদেরকে হোটেলে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে খাওয়া দাওয়া এবং কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর বিকেলে স্থানীয় দর্শনীয় স্থানগুলোতে আমাদেরকে ঘুরাতে নিয়ে যাবে।
ঘোরাঘুরিতে আমার কোন আলস্য নেই। তাই প্রোগ্রাম সিডিউল দেখে ভালোই লাগলো। গাড়ি চলছিল। আমি জানালার বাইরে চোখ রেখে হ্যাংঝো শহর দেখছিলাম। আর কখনো আসা হবে কিনা জানি না, তাই যতটুকু সম্ভব মনের গভীরে গেঁথে নিচ্ছিলাম।
লায়ন ফজলে করিম এবং ডালিয়া ভাবী নিজেদের মতো করে গল্প করছেন। আমার এক সিট সামনে বসেই তারা খোশগল্পে মেতে উঠেছেন। কলম্বিয়ান দম্পতিও নিজেদের মতো করে রয়েছেন। শাসা এবং ফ্রাঞ্চি আমাদেরকে এক দফা পানি ও বাদাম সিটে সিটে পৌঁছে দিয়েছে। আর লাগবে কিনা তাও কিছুক্ষণ পরপরই জানতে চাচ্ছে। মেয়ে দুইটি কোম্পানির অতিথিদের নিজেদের অতিথি হিসেবেই আপ্যায়ন করছে।
চীনে সুউচ্চ ভবনের কোন অভাব নেই। আট দশ তলা উচ্চতার ভবনগুলোকে বড় বেশি অসহায় লাগে। একটি সুউচ্চ ভবনের সামনে এসে থামলো আমাদের বাস। লবির বিপরীত পাশে দারুণ সুন্দর একটি ফোয়ারা। সেই ফোয়ারায় পানি খেলা করছে। আমেরিকার লাস–ভেগাসের আলীশান হোটেলগুলোর সামনে বর্ণিল পানি যেমন নৃত্য করে, চীনের হোটেলটির সামনেও পানি সেভাবে কসরত করছে। নিশ্চয় রাতের বেলা আলো ফেলে এই ফোয়ারাকে আরো বর্ণিল করা হবে।
হোটেলটি দুর্দান্ত, চমৎকার আয়োজন। বিশাল রিসিপশনে চোখ ধাঁধানো নানা আয়োজন। শিল্পসমৃদ্ধ শহর হ্যাংঝোতে নিশ্চয় দেশি– বিদেশী ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের আনাগোনা চলে। তাদের মনের মতো করে হোটেল রেস্তোরাঁগুলো গড়ে তোলা হয়েছে। আমাকে রুম দেয়া হয়েছে এগার তলায়। স্মার্ট কী নিয়ে আমরা সবাই একইসাথে লিফটে চড়লাম। বিশাল লিফট। তবে বিভিন্ন ফ্লোরে বিভিন্নজন ভাগ হয়ে গেলাম। লায়ন ফজলে করিম এবং ডালিয়া ভাবীর রুম নম্বর টুকে নিয়ে আমি আমার রুমে চলে গেলাম। বলা হলো যে, ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চের জন্য হোটেলের প্রথমতলায় দ্রুত নেমে আসতে হবে।
রুমে ঢুকেই মনটি ভালো হয়ে গেলো। হওয়ারই কথা। ফাইভস্টার হোটেল, রুমের ভাবসাবই আলাদা। পকেটের ডলার খরচ করে এসব হোটেলে থাকার কথা কোনদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না, অতিথি হিসেবে পার হয়ে যাচ্ছি বলে গায়ে লাগছে না। আমি নিজেকে একারণেই অনেক ভাগ্যবান মনে করি যে, অতিথি হিসেবে বিশ্বের নানাদেশে ফাইভস্টার, দুয়েকবার সিক্সস্টার হোটেলেও নিশিযাপনের সুযোগ হয়েছে। চুনোপুটি একজন সাংবাদিককে কেন যে এরা এমন কদর করেন কে জানে!
ফ্রেশ হয়ে রুমটিতে আবারো একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। একজন মানুষের যা যা প্রয়োজন তার সবই রুমটিতে দেয়া আছে। এমনকি থ্রি–পিনের মোবাইল চার্জারও। কফি মেশিনের সামনে ধুমায়িত কফি খাওয়ার যাবতীয় আঞ্জাম। দারুণ এক অনুভূতি খেলে গেলো শরীর, মনে। সামনে টান টান বিছানা হাতছানি দিচ্ছিলো। ইন্টারকমে ফজলে করিম ভাইকে ফোন করে নামার সময় নক দেয়ার কথা বলে আমি বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দিলাম। রিমোর্ট টিপে চালিয়ে দিলাম টিভি। একটির পর একটি চ্যানেল ঘুরাতে ঘুরাতে মনের মতো একটি চ্যানেল পেয়ে গেলাম। বিদেশের বিভিন্ন হোটেলে টিভি চালাতে অনেকসময় বিল পরিশোধের ব্যাপার স্যাপার থাকে। এখানে সেই ধরনের কোন ঝামেলা দেখলাম না। আমি টিভি দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম বলতে পারি না। ইন্টারকমের শব্দে ঘুম ভাঙলো। বুঝতে পারলাম যে, লায়ন ফজলে করিম ভাই ফোন করছেন। হ্যালো বলতেই, অপর প্রান্ত থেকে লাঞ্চের জন্য নামতে বললেন। আমি দ্রুত লিফট ধরলাম।
আমাদের সবার জন্য একটি টেবিল সাজিয়ে রাখা হয়েছে। করিম ভাই এবং ভাবী ইতোমধ্যে টেবিলে বসে গেছেন। রয়েছে কলম্বিয়ান দম্পতিও। শাসা এবং ফ্রাঞ্চি কোন কাজে ব্যস্ত কিনা কে জানে। তাদের দেখতে পাচ্ছিলাম না।
খেয়াল করে দেখলাম যে, টেবিলে বিয়ারের ক্যান এবং স্যাম্পেন রয়েছে। কলম্বিয়ান দম্পতি চুক চুক করে বিয়ার খাচ্ছেন। শাসা এবং ফ্রাঞ্চি এসে যোগ দিলো। তারা শ্যাম্পেন খুলে আমাদের অফার করলো। নিজেরাও বেশ আনন্দ করে শ্যাম্পেনের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিলো। অল্পক্ষণের মধ্যেই খাবার সার্ভ করা শুরু হলো। খাবার মানে যেনো তরকারির বন্যা। কত ধরনের মাছ মাংস সবজি যে কত বাহারী ঢঙ্গে আসতে লাগলো!! (চলবে)
লেখক: চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।