দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৪ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ৫:৫৫ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

বনের ভিতরে আলিশান কটেজে রাত কাটানোর আয়েশ শরীর জুড়ে। ফুরফুরে একটি আবহে মনে মেজাজে। চোখজোড়া ভরে আছে সবুজে। অনন্য এক আয়োজন চারদিকে। শরীরে ক্ষুধা কিছুটা বাড়াবাড়ি করলেও প্রকৃতির এমন অপরূপ সাজ অনেককিছুই ভুলিয়ে রাখছিল। যে পথে এতক্ষণ হেঁটেছিলাম সেই নান্দনিক ওয়াকওয়ে ধরে ফিরতি পথে আমরা। ব্যুফে ব্রেকফাস্টের আয়োজন রয়েছে রেস্টুরেন্টে। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে প্রটোকল অফিসার ফ্রাঞ্চি এবং শাসা। বিশ্বের নানাদেশ থেকে আসা অন্যান্য অতিথিরাও নিশ্চয় এতোক্ষণে পৌঁছে গেছেন। তারা আমাদের জন্য অপেক্ষা না করলেও আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, ফ্রাঞ্চি এবং শাসা আমরা না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে।

চারতলায় রেস্টুরেন্টে গিয়ে থরে থরে সাজানো খাবারের বাহার দেখে চোখ কপালে না উঠলেও মন ভরে গেলো। এতো আয়োজন! কত ধরনের খাবার যে সাজিয়ে রাখা হয়েছে তা গুনে শেষ করা কঠিন। বাদামভাজা থেকে শুরু করে মাংস পর্যন্ত নানা খাবার। তবে একটি বিষয় খেয়াল করলাম যে, লালআলু পোড়া যেনো কমন আইটেম। সবসময়ই এই দ্রব্যটি আলীশান হোটেলগুলোর ম্যানুতে চোখে পড়ছে। এতো কিছু থাকতে চীনারা লালআলুর মতো নিরীহ একটি খাবার নিয়ে কেন যে পড়ে রয়েছে কে জানে! দেশে কখন শেষবারের মতো এই আলুপোড়া খেয়েছি মনে করতে পারলাম না। তবে চীনের রেস্তোরাঁয় চেকে দেখেছি। লায়ন ফজলে করিম জানালেন যে, এই আলুর পুষ্টিগুণ অনেক। তাই চীনারা তাদের খাবারের তালিকায় লালআলুকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। সেদ্ধ করে রাখা আস্ত ভুট্টার থোকায় নানা জাতের মশলা মিশিয়ে কামড়ে কামড়ে খেতে দেখলাম অনেককেই। আমিও একটি ভুট্টা তুলে নিলাম প্লেটে। সাথে ছিটিয়ে নিলাম রকমারি মশলা। এগ স্টেশনে তরুণী ডিম ভেজে দিচ্ছিলেন। ডিম পোজ দিতে অনুরোধ করলাম তাকে। তিনি আমার চোখে চোখ রেখে ডিমের সাথে কি কি মেশাবেন তা জানতে চাইলেন হ্যাং প্যাং টাইপের ভাষায়। একটি শব্দও বুঝলাম না। চীনা ভাষা বুুঝার কোন যোগ্যতাও আমার নেই। এমন পাঁচতারকা মানের একটি কটেজে ইংরেজী জানা লোক না দিয়ে কেন যে প্যাং পুং টাইপের ভাষাওয়ালীকে ডিম ভাজতে দেয়া হয়েছে কে জানে! এখানে বলে রাখা ভালো যে, তরুণীর একটি শব্দ না বুঝলেও বডি ল্যাঙ্গুজে বুঝলাম যে, তিনি তার সামনে রাখা নানা জিনিসের বাটি দেখাচ্ছিলেন আমাকে। সেখানে মরিচ পেঁয়াজ থেকে শুরু করে মাংসের কুচি পর্যন্ত অনেক কিছু রাখা হয়েছে। ওগুলো ডিমের সাথে মিশিয়ে বিভিন্ন জনের অর্ডারে ডিম তৈরি করে দিচ্ছিলেন তিনি। আমি অচিন জিনিসগুলো ডিমের সাথে মেশাতে না করলাম।

একপাশে দেখলাম স্যুপের বাটিতে নুডলস ডুবিয়ে বিশেষ এক ধরনের খাবার নিচ্ছিলেন অনেকেই। খবর নিয়ে নিশ্চিত হলাম যে, পুরোটা ভেজিটেবল। আমিও নিলাম। বাদাম, ভুট্টা, ডিম এবং স্যুপ নুডলস দিয়ে আমার নাস্তা হয়ে গেলো। কলা এবং কমলার স্বাদ এতো টাটকা এবং অনন্য যে মনে দাগ কাটলো। ভরপেট নাস্তা সেরে রুমে গেলাম। শূন্য ঘরের শূণ্য বিছানাটি আমাকে যেনো হাতছানি দিচ্ছিলো। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেবো কিনা ভাবছিলাম। চোখ বন্ধ করার প্রায় সাথে সাথেই ইন্টারকমে হাজির হলেন লায়ন ফজলে করিম। এমন রোমান্টিক এক পরিবেশের মাঝে তিনি একেবারে নির্দয়ভাবে আমাকে বাসে চড়ার তাগাদা দিলেন। বললেন, বাইরে বাস চলে এসেছে। এখনি চড়তে হবে। বাস ছেড়ে দেবে।

চীনারা সময়ের ব্যাপারে খুবই সচেতন হয়ে উঠেছে। গতবার চীন সফরের সময় বিষয়টি টের পেয়েছিলাম। এবারও এখন পর্যন্ত ঘড়ির কাঁটা ধরে সবকিছু চলছে। আমাকে যে ট্যুর প্ল্যান দেয়া হয়েছে সেটাতে চোখ বুলিয়ে নিলাম। চোখ কচলে দেখলাম যে, সেখানে যে সময় দেয়া আছে তা থেকে আমি মাত্র পাঁচ মিনিট দূরে রয়েছি। অতএব কিছুটা তাড়াহুড়ো করেই লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে এলাম। ওয়াকওয়ের মতো পথ ধরে এগিয়ে রিসিপশনে পৌঁছে দেখলাম, দেরি করিনি। আরো কয়েকজন চাবি জমা দিয়ে চেকআউট করছেন। ফ্রাঞ্চি এবং শাসা অতিথিদের চাবি নিয়ে জমা দিচ্ছেন। ফ্রাঞ্চি আমার চাবিটি হাতে নিয়ে লাগেজ নিয়ে বাসে চলে যেতে বললো। রুমের মিনিবার থেকে কিছু খেয়েছি কিনা সেটা দেখার পরই চেকআউটে ক্লিয়ারেন্স দেবে। আমি মিনিবার খুলিনি। সুতরাং কোন ঝামেলা নেই। বাসে চড়ে দুই সিট নিয়ে হেলান দিলাম। কতদূর যাবো বুঝতে পারলে ঘুমের প্ল্যান করতে সুবিধা হবে। কিন্তু কতদূর যাবো সেটি জানতে হলে আগে ফ্রাঞ্চি কিংবা শাসাকে বাসে ফিরতে হবে। আমি বাসের জানালায় চোখ দিয়ে বাইরের বনবনানী দেখতে লাগলাম।

ফ্রাঞ্চি এবং শাসা বাসে ফিরে এলো। আমি খেয়াল করে দেখলাম যে, আমাদের যাত্রার যে সিডিউল দেয়া হয়েছে ঘড়ির কাটা সেখানেই। কেমনে যে এরা এভাবে সময়কে বশ মানিয়ে সব কাজ করতে পারে কে জানে!

আমাদের বহনকারী বাস চলতে শুরু করেছে। বাসটি সেই সাংহাই থেকে আমাদের সাথে রয়েছে। ইতোমধ্যে আমরা জেনে গেছি যে, আলীশান এই বাসটিতে আমরা আরো বহু পথ পাড়ি দেবো। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চকচকে বাসটির চল্লিশটি সিটের মধ্যে আমরা সর্বসাকুল্যে আমরা ৮ মানুষ। এরমধ্যে একজন চালক। শাসা এবং ফ্রাঞ্চির দায়িত্ব হচ্ছে আমরা বাংলাদেশের তিনজন এবং কলম্বিয়ার দুইজন অতিথিকে প্রটোকল দেয়া। তাই বিশাল বাসটিতে আমরা একেকজন কয়েকটি করে সিট নিয়ে বসলেও সিটের অভাব হচ্ছিল না।

আবারো সেই রাজকীয় রাস্তা ধরে ছুটছি আমরা। রাস্তার দুধারে ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে, অকাতরে সবুজ বিলুচ্ছে লাখো কোটি গাছ। কী অনাবিল এক পরিবেশ রাস্তাজুড়ে! লেটেস্ট মডেলের নানা গাড়ি ছুটছে, ছয় লেনের রাস্তায় কেউ আমাদেরকে ওভারটেক করছে, আমরাও পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি অনেককেই। রাস্তায় গতির ঝড় তোলা একেকটি গাড়ি, আমাদের বাসের গতিও ক্ষণে ক্ষণে তাক লাগাচ্ছিলো।

ছুটছে আমাদের গাড়ি। গন্তব্য হ্যাঙঝো। সুঝৌ থেকে হ্যাঙঝোর রাস্তা ধরে এগুচ্ছিলাম আমরা। বিশাল বিস্তৃত জনপদ, কোথাও কোথাও উপশহর, কোথাও বসতি, আবার কোথাও ধূ ধূ ফসলের মাঠ। কত ধরনের রঙ যে মাঠ থেকে ছড়াচ্ছে! ফুলের চাষ, ফলের চাষ, ধানের চাষ মিলে এক এলাহী কারবার চীনের একেকটি অঞ্চলে। হ্যাঙঝোতে চাষাবাদের পাশাপাশি ব্যাপক শিল্পায়ন হয়েছে। বহু কলকারখানা রয়েছে অঞ্চলটিতে। এটি চীনের বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর। আজ রাতে ওখানে আমাদের থাকা এবং জমকালো সব আয়োজন রাখা হয়েছে।

ভাবতে বেশ ভালো লাগছে যে, দুইবার চীন সফরে বিশাল দেশটির উত্তরদক্ষিণ এবং পূর্বপশ্চিমের অনেকগুলো অঞ্চলই আমার ঘোরা হয়েছে, দেখা হয়েছে কাছ থেকে। এবারও লম্বা সময় নিয়ে রয়ে সয়ে সবকিছু দেখছি। যদি আরো অনেককিছু দেখার বাকি রয়ে গেছে। আসলে চীন এতো বড় এবং বৈচিত্রে ভরা একটি দেশ যে, একজীবনে এটির সব দেখে শেষ করা সম্ভব নয়। চীনের কোটি কোটি মানুষও তা পারেনি, বিদেশের জন্য তো ব্যাপারটি দূর অস্ত!

আমাদের পৌঁছাতে কতক্ষণ লাগবে জানতে চাইলাম। ‘লেট মি চেক’ বলে ফ্রাঞ্চি মোবাইল টিপাটিপি শুরু করলো। গুগল থাকলে বিষয়টি আমিও করতে পারতাম। কিন্তু আগেই বলেছি যে, চীনে গুগলের কোন কারবার নেই। নিজস্ব অ্যাপ তৈরি করে তারা গুগলের ধারে কাছে না গিয়েও সব প্রয়োজন সারিয়ে ফেলছে। ফাঞ্চি মোবাইল থেকে চোখ তুলে আমাকে দেখলো। অতপর বললো, ১৬১ কিলোমিটার। দুই ঘন্টার মতো সময় লাগবে। আমি চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত হিসেব কষলাম। কুমিল্লার দূরত্ব চট্টগ্রাম থেকে ১৫০ কিলোমিটার। এই দূরত্ব পাড়ি দিতে আমাদের চার ঘন্টা লাগে। সহজ করে বললে, আমাদের চার ঘন্টার পথ চীনারা দুই ঘন্টায় পাড়ি দিচ্ছে। অবশ্য, এই দূরত্ব মাত্র আধাঘন্টায় পাড়ি দেয়ার মতো ট্রেন রুট চীনাদের রয়েছে। গাড়ি ছুটছিল, সম্ভবত একশ’ বিশ কিলোমিটার বেগে। জানালায় চোখ রেখে আমি বাইরের অপরূপ নৈসর্গিক দৃশ্যগুলোতে চোখ জুড়াচ্ছিলাম। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমনে হঅর আবার গুরা অইবল্লাই
পরবর্তী নিবন্ধস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব : জেলা প্রশাসক এজাহারুল ফয়েজ