দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৬ নভেম্বর, ২০২৪ at ৬:০১ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

আমাদের বাস ছুটছিল। রাজপথ ধরে ছুটছে বাস। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চকচকে বাসটিতে জ্যাক কোম্পানির ব্যানার সাঁটানো। কোম্পানির অফিসারদের আনা নেয়ার কাজেই হয়তো এটি ব্যবহৃত হয়। এখন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেয়া অতিথিদের কাজে লাগানো হয়েছে। সাংহাই হোটেল থেকে যাত্রা করার পর থেকে নানা ধরনের খাবারের উপর রয়েছি। আমাদের পাঁচজনের জন্য মোতায়ন করা দুইজন প্রোটোকল অফিসার বাসটিতে দুনিয়ার খাবার নিয়ে রেখেছেন। পানি থেকে ফলমুল, বিস্কিট, চকলেট, বাদাম থেকে শুরু করে নানা খাবার। ফ্রান্সি এবং শাসা নামের দুই তরুণী অফিসার আমাদের সিটে সিটে খাবার পৌঁছে দিচ্ছিলো। কী যে মমতা তাদের চোখে, ভাষায়!

লায়ন ফজলে করিম ভাই জানালেন যে, প্রথমে আমরা একটি পুরাতন শহর দেখতে যাবো। এনসাইয়েন্ট সিটি। ওটি দেখার পর আমরা ঘুরে ফিরে আজ রাতটি আমরা হাংজোতে একটি হোটেলে কাটাবো। পরদিন আমরা নতুন গন্তব্যে যাত্রা করবো। আজ অফিসিয়াল কোন কাজ নেই, শুধু ঘুরে বেড়ানো।

ঘুরে বেড়ানোর চেয়ে ভালো কোন কাজ থাকতে পারে নাকি! আমি ভিতরে ভিতরে চমকিত হলাম! এতো টাকা পয়সা খরচ করে অতিথি এনে এখানে সেখানে ঘুরানোর মধ্যে জ্যাকের ব্যবসাটি কোথায় ঠিক ধরতে পারছিলাম না। চীনাদের বুদ্ধি কী কমে গেছে! বাংলাদেশ থেকে বিমানে চড়িয়ে অতিথি এনে, পাঁচতারকা হোটেলে রেখে কোন কাজ না করিয়ে শুধু এখান থেকে ওখানে বেড়ানোর ব্যবস্থা করছে!

আমাদের বাস ছুটছে একশ’ ত্রিশ থেকে চল্লিশ কিলোমিটার স্পিডে। বিশাল চওড়া রাস্তা ধরে ছুটছে আমাদের গাড়ি। আট লেনের সড়ক, মাঝে ডিভাইডার। দুইপাশে অযুত নিযুত গাছগাছালি, ফুলের বাগান। কোথাও রাস্তার উপর আরো একটি রাস্তা, কোথাওবা ফ্লাইওভার। কোথাও নদীর উপর দিয়ে বয়ে গেছে রাস্তা, বিশাল ব্রিজ। অধিকাংশই ব্রিজেরই কোন পিলার নেই নদীর মাঝখানে। কোথাও কোথাও পিলার থাকলেও লাইটারেজ জাহাজ চলাচলের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কিছুক্ষণ পরপরই পার হচ্ছিলাম এক একটি জনপদ, উপশহর। সুউচ্চ সব ভবন, জনবসতি। ভবনের সামনে খোলা চত্বর, সবুজ ঘাসের চাদর। পরিকল্পিত এবং গোছানো উন্নয়নে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছিলো। সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ছিল পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা। রাস্তার কোথাও ময়লা আবর্জনা নেই, যেখানে ইচ্ছে অনায়াসে শুয়ে পড়া যাবে। রাস্তা দখল করে কোন বাজার নেই, রিক্সা ঠেলা বা টেক্সির একটিও জটলা নেই। রাস্তার উপর হকার নেই। একই তাল এবং লয় ধরে রেখে ছুটছিল আমাদের বাস। তীব্র গতিতে এগিয়ে চলছিল। ট্রাফিক সিগন্যালগুলোতে দাঁড়াচ্ছিল, লাল সবুজের হিসেব মিলে গেলে আবারো ছুটছিল।

আমি বেশ খেয়াল করলাম যে, ট্রাফিক সিগন্যাল ছাড়া বাসটির স্পিড একশ’ ত্রিশের নিচে নামছেই না। ওভার স্পিডের জন্য চীনারা কি জরিমানা করে না? পুলিশ কী গাড়ি আটকায় না? বিষয়টি আমার মাথায় ঢুকছিল না। এতো স্পিডে একটি বাস কি করে একটির পর একটি জনপদ পার হয়ে আসছে! নাকি জ্যাক কোম্পানি আমাদের বড় বড় কোম্পানিগুলোর মতো মাসিক ভিত্তিতে সবকিছু ম্যানেজ করে রাখে!

আমাদের মহাসড়কে বিপুল গতিতে বাস চললেও সাধারণ মানুষ ৮০ কিলোমিটারের বেশি বেগে গাড়ি চালাতে পারে না। পুলিশ আটক করে। মামলা দেয়, ক্যাশ জরিমানা পকেটে পুরে। আবার মামলার ভয় দেখিয়েও হাতানো হয় অর্থ। ঈদের দিন ফাঁকা রাস্তায় ৮৭ কিলোমিটার স্পিডে গাড়ি চালিয়ে কুমিল্লার ইলিয়টগঞ্জে আমার ড্রাইভারকে এক হাজার টাকা ‘নগদ জরিমানা’ দিতে হয়েছিল। পরে অবশ্যই তা নিয়ে অন্যরকমের এক গল্পেরও জন্ম হয়েছে। কথাটি করিম ভাইকে বলতেই তিনি আমাকে রাস্তার পিচের উপর বড় বড় হরফে ইংরেজীতে লিখে রাখা ‘১১০’ দেখালেন। অর্থাৎ স্পিডলিমিট ১১০ কিলোমিটার। দশবিশ কিলোমিটার এদিক ওদিক হলে পুলিশ ওভারলুক করে, কিছু বলেনা। এমন রাস্তায় কম স্পিডে গাড়ি চালালে এক্সিডেন্ট করতে করবে। ঠিক একথাটিই আমি বহুভাবে বহুজনকে বুঝাতে পারিনি। আমাদের ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়কের স্পিডলিমিট ৮০ কিলোমিটার। অথচ এই স্পিডে গাড়ি চালালে পেছনের গাড়ি উড়িয়ে নিয়ে যাবে। বাসগুলো একটিও স্পিডলিমিট মানে না, মানে না অসংখ্য প্রাইভেট গাড়িও। এমন গতির প্রতিযোগিতার মাঝে স্পিডলিমিট মেপে গাড়ি চালালে ওই চালকের কপালে দুঃখ আছে। বর্তমানে বহু গাড়ি রাস্তায় এসেছে যেগুলো স্টার্ট করে গিয়ার লাগানোর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই স্পিড ৬০ থেকে ১০০ কিলোমিটারে উঠে যায়। এমন গাড়িকে ৮০’র ঘরে আটকে রাখা সত্যিই কঠিন!

মহাসড়কে আমাদের স্পিড লিমিট অন্তত একশ’ করার জন্য বহুজনকে বলেছি। কিন্তু কেউ শুনেননি। অথচ আমাদের প্রধান মহাসড়কটি চীনারাই বানিয়ে দিয়ে গেছেন! চীনাদের তৈরি সড়কে চীনে যদি ১১০ কিলোমিটার স্পিডলিমিট থাকে, তাহলে সেই চীনাদের তৈরি আমাদের মহাসড়কে স্পিডলিমিট ৮০ কেন কে জানে!

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে খাওয়ার এবং পানির অভাব নেই। যোগান রয়েছে জুসেরও। আমরা একেকজন দুইটি করে সিট নিয়ে অতি আয়েশ করে নানাকিছু খেতে খেতে সময় পার করছিলাম। আমি লায়ন ফজলে করিম ভাই এবং ডালিয়া ভাবীর সাথে নানা গল্প করছিলাম। যোগ দিচ্ছিলো ফ্রাঞ্চি এবং শাসাও। তবে কলম্বিয়ান ভদ্রলোক এবং তার তরুণী বধূ আমাদের সাথে হাই হ্যালোর পর আর বিশেষ কোন কথা বলেননি। নিজেদের মতো রয়েছেন। একজন অপরজনের হাত নিয়ে খেলা করছেন। দারুণ সুন্দরী কলম্বিয়ান মেয়েটি আড়চোখে আমাদের দুয়েকবার দেখলেও তার চোখজোড়া সারাক্ষণই খেলা করছিল। ঠোঁটে লেগেছিল হাসি। শাকিরাকে কাছ থেকে দেখিনি, তবে আমাদের সহযাত্রী শাকিরার চেয়ে সুন্দরী বলে মনে হচ্ছিলো।

আমাদের বাসের গতি কমে আসলো। আমরা একটি শহরে প্রবেশ করতে যাচ্ছি বলেও মনে হলো। ইতোমধ্যে প্রায় দুই ঘন্টা সময় পার হয়ে গেছে। টানা বাস চলেছে। ফ্রাঞ্চি বললো, আমরা পৌঁছে গেছি। সাংহাই থেকে আমরা দেড়শ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সুঝৌ শহরে এসে গেছি। এখানে আমরা একটি এনসাইয়েন্ট সিটি দেখবো। আড়াই হাজার বছরের পুরানো শহর। বাস থেকে বাইরে চোখ বুলালাম। চারদিকে অত্যাধুনিক সুউচ্চ ভবন। তকতকে ঝকঝকে একটি আধুনিক জনপদ। এটি আড়াই হাজার বছরের পুরানো হয় কি করে!

আন্তর্জাতিক চেইন হোটেল মা’কিউরের সামনে আমরা বাস থেকে নামলাম। এই হোটেলে আমি প্যারিসে কয়েকরাত ছিলাম। দারুণ সার্ভিস। আড়াই হাজার বছরের পুরানো এনসাইয়েন্ট সিটিতে এমন তরতাজা হোটেল কোত্থেকে এলো! কথাটি ফ্রাঞ্চিকে বলতে সে কুটিকুটি হয়ে হাসলো। অতঃপর বললো, আসলে আড়াই হাজার বছরের এনসাইয়েন্টকে সিটিকে ঘিরে অত্যাধুনিক এক পর্যটন নগরী সুঝৌ গড়ে উঠেছে। পুরানো শহরটিকে অক্ষত রেখেই চারপাশে গড়ে তৈরি হয়েছে আধুনিকতা। শহরের ভিতরে শহর, কিংবা শহরের বাইরে শহর!

বেশ চিপা একটি গলি ধরে আমরা এগুলাম। মূলসড়কের সাথে চিপা গলির সংযোগস্থলে কয়েকটি স্টিলের পিলার তুলে দেয়া হয়েছে। যাতে কোন ধরনের ছোটখাটো গাড়ি এমনকি সাইকেলও যেনো ভিতরে প্রবেশ করতে না পারে। আমরা পায়ে হেঁটে এগুলাম। খুব সামান্য পথ এগুনোর পরই আমি চমকিত হলাম। মনে হলো সত্যিই আমি কয়েক হাজার বছরের পুরানো এক জীবনযাত্রায় এসে পড়েছি।

আসলেই মনে হচ্ছিলো ভেনিস শহরে ঘুরছি। ঠিক যেনো ইতালীর ভেনিস। চীনের সুঝৌ শহরের এই এনসাইয়েন্ট সিটিকে আমার প্রাচ্যের ভেনিস বলে মনে হলো। ঠিক যেনো ভেনিসের সেই সেতু। সেই খাল। ভেনিসের খালে খালে ঘুরে বেড়ানো বিখ্যাত গন্ডোলার মতো সুঝৌর খালেও চলছে সোয়ান। ইঞ্জিন নিষিদ্ধ হওয়ায় এখানেও বৈঠা টেনে টেনে চালানো হচ্ছে সোয়ান নামের নৌকা। অনেক মহিলাকে দেখলাম সর্বশক্তি দিয়ে বৈঠা টানতে। একজন চালকই বৈঠা টেনে টেনে বিশেষ ডিজাইনের নৌকা এই সোয়ান চালান। ১৪/১৫ জন যাত্রী নিয়ে বৈঠা টানেন চালক। ৪০ মিনিটের মতো নৌকায় থাকতে হয় শহরের প্রধান খালটি ঘুরতে। শিশুদের কাছ থেকে নেয়া হয় ২৫ ইউয়ান এবং বড়দের ৪০ ইউয়ান। প্রতি ইউয়ান বাংলাদেশের সাড়ে ষোল টাকা। রাস্তায় কোন গাড়ি চলে না। পায়ে হেঁটে ঐতিহ্যের খোঁজ করেন হাজার হাজার পর্যটক। কেউ সোয়ানে ঘুরে ঘুরে দেখেন, আর কেউবা পায়ে হেঁটে। কিন্তু কোন বাহন নেই, কোন ইঞ্জিন নেই। বাড়িঘর এবং দোকানপাটগুলোতে রকমারি আধুনিক পণ্যে ঠাসা, কিন্তু ভবনের আদল সেই আড়াই হাজার বছরের পুরানো। মাটির, ইটের, সুরকির, ছাদে সবগুলো টালি। ভবনগুলোর সামনে এবং দোকানে দোকানে সেই সময়কার সাজপোশাকে সুসজ্জিত মানুষ, নারী পুরুষ। আবার পর্যটকদের মাঝেও ওই সময়কার পোশাক পরিহিত মানুষের সংখ্যা অগুনতি। সুসজ্জিত তরুণ তরুণীরা ওই সময়কার আদলে চীনা পোশাক পরে, কোমরে তরবারি ঝুলিয়ে আড়াই হাজার বছর আগেকার বাপদাদাদের ফিল নেয়ার চেষ্টা করছিল। তরুণীরা মুখে রঙ মেখে, খোঁপায় ফুল গুজে, কেউবা মাথায় ফুলের মুকুট পরে নিজেদের নিয়ে গেছে আড়াই হাজার বছর আগের আবহে। হাজার হাজার পর্যটকের পদচারণায় পুরো এলাকা মুখরিত। রঙবেরঙের নারী পুরুষ গিজগিজ করছিল চারপাশ। আমার মনে হলো মুখে রঙ মেখে বা উদ্ভট সাজ নিয়ে তারা শুধু আনন্দই করছে না, একই সাথে নিজেদের শেকড়েরও খোঁজ করছে! (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহৈমন্তীর প্রেম
পরবর্তী নিবন্ধছাপাখানাগুলো : কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেস সৃষ্টি করেছিল ইতিহাস