দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৯ অক্টোবর, ২০২৪ at ৬:২০ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

কথা গল্প আড্ডায় আমাদের সময় দ্রুত পার হচ্ছিল। কনে দেখায় আলোয় ভরে যাচ্ছিল ঘর। সাজানো গোছানো ড্রয়িং রুমের একপাশের দেয়ালের পুরোটাই কাচ। কোন গ্রিল নেই। ওই কাচ গলে আসা আলোতে উজ্জ্বল হয়ে উঠে পুরো ঘর। বিশাল টাওয়ারের ৭ তলার বেটির ফ্ল্যাটের বাইরে স্বচ্ছ নীল আকাশ, অদূরে পাহাড়, সবুজ গাছগাছালী। কী যে অপূর্ব লাগছিল চারদিক! ছবির মতো সুন্দর কিংবা ছবির চেয়ে বেশি সুন্দর। আয়েশি ভাব নিয়ে আমরা ফলমূল খাচ্ছিলাম। ইতোমধ্যে বেটি দুইবার কফিও দিয়েছে। বেটির ছোট্ট পরিবারটি লায়ন ফজলে করিম ভাইয়ের পরিবারকে পেয়ে অনেকটা আত্মহারা। করিম ভাইয়ের বন্ধু হিসেবে আমিও সমান ভাগ পাচ্ছি খাতির যত্নের।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলো। আমরা উঠি উঠি করেও কেমন যেনো মায়ায় আটকে আটকে যাচ্ছি। অবশেষে আমরা উঠলাম। কিন্তু একেবারে হৈ হৈ করে উঠলো বেটি এবং তার স্বামী। ডিনার না করে যেতেই দেবে না। আমি মনে মনে হেসে উঠলাম। কিন্তু কাউকে বুঝতে দিলাম না। বেটির এ্যাপার্টমেন্টের কাচঘেরা রান্নাঘরটিতে বিন্দুমাত্র আয়োজন নেই। অথচ সে আমাদের ডিনার না করে ছাড়বেই না বলে পথ আটকাচ্ছে। ব্যাপারটি আবার আসলে কিন্তু খেয়ে যেতে হবে টাইপের বলে মনে হচ্ছিলো আমার। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই বেটি বললো যে, সব আয়োজন সে করে ফেলেছে। এখন না খেয়ে গেলেও তাকে লস দিতে হবে। বেটি রেস্টুরেন্টে আমাদের ডিনারের সব আয়োজন করে রেখেছে। সিট বুকিং থেকে শুরু করে সবই। আধাঘন্টা পরই সেখানে যেতে হবে বলে জানিয়ে বেটি বললো যে, আমাদের যেতে মাত্র ২০ মিনিট লাগবে।

নিজে নিজে লজ্জা পেলাম। বেটিকে কি ভাবছিলাম আমি, আর সে কি করে রেখেছে। আসলে পুরোটা না জেনে নিজ থেকে মনে মনে কোনকিছু বিচার করে ফেলা উচিত নয়। এটা আমি জানি, তবুও কেন যে ভুলটি বার বার করি!

তবে বেটি যেতে ২০ মিনিট লাগবে বলে কী অবলীলায় ‘সময়’ বলে দিলো! আমি জানি যে, ওই ‘বিশ মিনিট’ সময়েই রেস্টুরেন্টে পৌঁছাবে আমাদের গাড়ি। রাস্তায় হাজার হাজার গাড়ি, অথচ থমকে যাওয়ার অবস্থা নেই। সবকিছু ঘড়ির কাঁটা ধরে চলে। আমরা সবাই একসাথে ঘর থেকে বের হলাম। দরোজায় সাঁটানো একটি ডিভাইজে নম্বর ঘুরিয়ে দরোজা লক করলো বেটি। আমাদের দলে বেটির স্বামীসন্তান এবং ছোটবোনও রয়েছে। সবমিলে ৭জন। কিন্তু এতে করে একটি গাড়িতে যাওয়ার জো থাকলো না, দুইটি গাড়ি লাগবে। বেটিই সমাধান বের করলো। তার টেসলা গাড়িতে মেয়েরা সবাই, আর বেটির স্বামীর বিএমডব্লিউতে ছেলেরা। সাংহাই শহরে ২৪ কোটি টাকার ফ্ল্যাটে যার বসবাস, তার গ্যারেজেতো দুইতিনটি গাড়ি থাকবেই। কিন্তু তা যে এতো দামি তা বুঝতে আমার কিছুক্ষণ সময় লেগেছিল। বেটির আর্থিক অবস্থা আমি যতটুকু আঁচ করেছিলাম এখন মনে হচ্ছে তার থেকে সে ঢের ঢের ভালো অবস্থানে রয়েছে। লেটেস্ট মডেলের চকচকে দুইটি দামি গাড়ি পোষা চাট্টিখানি কথা নয়। বেটির স্বামী বিএমডব্লিউ নিয়ে অফিস করে, আর বেটি ছুটে তার টেসলা নিয়ে। স্বামীর জার্মানির বিএমডব্লিউ থেকে নাকি বেটির আমেরিকান টেসলার দাম অনেক বেশি। মডেল নিয়ে কথা!

সাংহাই শহরের বেশ জমকালো একটি রেস্তোরাঁয় আমাদের ডিনারের আয়োজন করেছে বেটি। চীনের আর দশটা অভিজাত রেস্তোরাঁর মতো এটিও বিশাল। গোলাকার সব টেবিল ঘিরে পেতে রাখা চেয়ার। আমরা এক টেবিলেই সবাই মিলে বসে পড়লাম। আরো দু’চারজন বাড়তি মানুষ থাকলেও টেবিলটিতে অনায়াসে বসে যাওয়া যেতো। বেটির বছর চারেক বয়সী বাচ্চাসহ আমরা সাতজন বসার পর টেবিলটির পাশ থেকে কয়েকটি চেয়ার সরিয়ে নেয়া হলো। আমাদের বসার আয়েশ বেড়ে গেলো।

পুতুলের মতো সুন্দরী দুই চীনা তরুণী আমাদের সামনে বেশ কয়েকটি ম্যানু রেখে একজন খাবারের অর্ডার নেয়ার জন্য নোটবুক নিয়ে দাঁড়ালো। অপরজন দারুণ সুন্দর এক কেটলি থেকে আমাদের সবার সামনে গ্রিনটি সার্ভ করে দিল। চীনা সংস্কৃতিতে গ্রিনটি ছাড়া লাঞ্চ ডিনারের কথা চিন্তাও করা যায় না। হার্ড ড্রিংকস ও বিয়ারের ছড়াছড়িও থাকে টেবিলে টেবিলে। আমরা কোন হার্ড ড্রিংকস নেবো কিনা জানতে চাইলো তরুণী। আমি আড়চোখে তাদের দেখছিলাম। আমি কিছু বলার আগে লায়ন করিম ভাই ড্রিংকস না নেয়ার কথা বলে দিলেন। বেটি বিয়ার হলেও নেয়ার অনুরোধ করলো। আমরা না বলার পর আর জোর করলো না। বেটি ম্যানু উল্টিয়ে কি কি সব খাবারের অর্ডার করতে লাগলো। অনেকক্ষণ ধরে সে অর্ডার করলো, আর তরুনী নোটবুকে টুকে নিচ্ছিলো। করিম ভাই যতই বলেন এতো লাগবে না, বেটি যেনো ততই জেদ করে অর্ডার করছিল।

আমি করিম ভাইকে আলতো করে চাপ দিয়ে বললাম, মাংসের অর্ডার না দিয়ে শুধু মাছ ও সবজী জাতীয় খাবারের অর্ডার করতে বলুন। করিম ভাই আমাকে আশ্বস্ত করলেন যে, বেটি খুবই সচেতন, সুতরাং সমস্যা হবে না।

সমস্যা না হলে ভালো। খাবারের টেবিলে বসে এই ধরনের কথা বলা অভদ্রতা। সান্ত্বনা হচ্ছে আমি খুবই নিচু স্বরে বলছিলাম এবং বেটি খুব বেশি বাংলা বুঝে না। খাবার আসতে শুরু করলো। বড় বড় ডিসে একটির পর একটি খাবার। কোনটি ঝোলে ডুবে আছে, কোনটি ঝোলের উপর ভাসছে, কোনটি বা একেবারে শুকনো, কোনটি কসানো, কোনটি রসালো। নুডলস, চিফস, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, মাছের কাবাব, মাছ ভাজা, ঝোলের ভিতরে আস্ত মাছ, শাক, সবজি, কচু, আলু থেকে শুরু করে নানা খাবার। আমাদের প্রত্যেককেই একটি করে ছোট বাটি দেয়া হয়েছে। বড় ডিস থেকে বাটিতে নিয়ে চুকচুক করে খেতে হচ্ছে। আমাকে চামচ দেয়া হয়েছে, অন্যরা চপস্টিক দিয়ে চালাচ্ছেন।

রেলগাড়ির মতো খাবারের ডিস আসছিল। একটির পর একটি। কিন্তু ভাত বা রুটিজাতীয় কোন খাবারের দেখা মিলছিল না। চীনারা প্রচুর তরকারি খায়। মাছ মাংস শাক সবজি সবই ভাতের আগে খেয়ে নেয়। একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে দুয়েক চিমটি ভাত নিলেও তাকে ঠিক ‘ভাতখাওয়া’ বলা চলে না। চীনারা ভাত দিয়ে তরকারি খায়, আর আমরা তরকারি দিয়ে ভাত খাই। কথাটি শুনতে একই রকম মনে হলেও আসলে যে কী যোজন যোজন দূরত্ব তা বুঝতে হলে চীনাদের সাথে লাঞ্চ বা ডিনার করতে হবে। অন্তত বিশত্রিশ পদের তরকারি শেষ করার পর দুয়েক চিমটি ভাত নেয়াকে ঠিক ভাত খাওয়া বলা যাবে কিনা সেটি অবশ্য আমি জানি না। তিন চার কেজি ওজনের আস্ত মাছ, আস্ত হাঁস কিংবা আস্ত মুরগীর বেশিরভাগই টেবিলে পড়ে থাকলো। আমরা এখান ওখান থেকে ছিঁড়ে বা টেনে যা খেলাম তার থেকে বেশি ঝোলের ভিতরে ভাসছিল।

অন্তত ঘন্টা দুয়েক সময় নিয়ে ডিনারের নামে আমাদের খোশগল্প এবং খাবারের মহোৎসব চললো। কত কত্ত খাবার যে টেবিলটিতে দেয়া হলো। এক পর্যায়ে টেবিলে ডিস রাখার জায়গার অভাবে একটির উপর একটি রাখতে হলো। দুতলা তিনতলা খাবারের ডিস!! শুধু আমাদের টেবিলেই নয়, আশেপাশের টেবিলগুলোতেও একই ধরনের খাবারের আধিক্য চোখে পড়লো। চুমুকে চুমুকে ড্রিংকস এবং বিয়ার চলছিল প্রতিটি টেবিলে। এক একটি টেবিলে বিয়ারের ক্যানের পাহাড়, কয়েকটি করে মদের বোতল। নানা পদের খাবারের ছড়াছড়ির মাখে বিপুল খাবার নষ্ট হওয়া দেখে আমার খুবই খারাপ লাগছিল। কী দুর্দান্ত এক খাবার নষ্টের প্রতিযোগিতা। রেস্তোরাঁটি অভিজাত, কাস্টমারদের প্রায় সবাই ধনাঢ্য। এখানের টেবিলের অবস্থা দেখে সাধারণ চীনাদের অবস্থা বিচার করা হয়তো ঠিক হবে না। তবে অভিজাত রেস্তোরাঁগুলোতে যে পরিমাণ খাবার নষ্ট করতে দেখলাম তাতে আমি একটুও স্বস্তি পাচ্ছিলাম না।

আমাদের অদূরে একটি টেবিলে আটদশজন চীনা তরুনতরুণী ডিনার করছিলো। পানীয়যোগের কারণে তারা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি হৈ হুল্লুড় করছিল। তারা উচ্ছ্বাস করছিল। অবশ্য উচ্ছ্বসিত যুবক যুবতীর হুল্লুড় আশপাশের টেবিলগুলোর বিরক্তির কারণ হচ্ছিল না। তারা সবাই যেনো সবার মতো করে সবকিছু সহ্য করছিল।

লায়ন ফজলে করিম বেটিকে উদ্দেশ্য করে বললো, ফিনিশিং রাউন্ডে কফি বা চা খাওয়াতে হবে। বেটি বেশ সুন্দর করে হাসলো। ওয়েটারদের একজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো সে। তরুণী কাছে আসার পর তাকে কি কি যেনো বললো। তরুণীও হেসে হেসে উত্তর দিচ্ছিলো। তরুণী যা বললো বেটি তা আমাদের অনুবাদ করে জানালো যে, এই রেস্তোরাঁয় এই সময় চা কফি হয় না। তবে তারা ম্যানেজ করে দিচ্ছে। বুঝতে পারলাম যে, বেটি এই রেস্তোরাঁর দামি কাস্টমার। তাই তার চাওয়া তারা অপূর্ণ রাখছে না। অল্পক্ষণের মধ্যে বেশ বড় বড় মগে কফি আসতে শুরু করলো। আমাদের কেউ কেউ খাবে না বলে ঠেলে রাখলেও আমি হাত বাড়ালাম। আমার মনে হলো, পাশের টেবিলের চুমুক থেকে আমার এই চুমুক অনেক বেশি উষ্ণ। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনীরবে সবার মন জয় করে নেয়া সাদিক মিয়ারা ক্ষণকালে জন্মায়
পরবর্তী নিবন্ধবাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সমস্যা এবং ভবিষ্যতে করণীয়