(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সাংহাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ডোমেস্টিক টার্মিনাল থেকে বেশ খোশ মেজাজে বের হলাম আমরা। খোশ মেজাজের উৎস হচ্ছে ধ্রুব। লায়ন ফজলে করিমের বড় সন্তান। ধ্রুব সাংহাইতে লেখাপড়া করে। সাংহাই শহরের সবকিছু তার নখদর্পনে। একটি অচিন শহরে টেনশনমুক্ত থাকা যে মেজাজ খোশ করার কত বড় ট্যাবলেট তা এই পরিস্থিতির শিকার না হলে বুঝে উঠা কঠিন। সাংহাই কিংবা চীনের অন্যান্য শহরগুলোতে বাইরের লোকদের গিয়ে ঠিকঠাকভাবে কাজ সামলানো অনেক কঠিন। ইংরেজীর বেহাল দশা দেশটিতে। গতবার যখন চীনের বেইজিং শহরে একা একা ঘুরছিলাম তখন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম যে, একজন পরিচিত মানুষ কিংবা কথা বুঝিয়ে দেয়ার মতো একজন মানুষের অভাব কী ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে!
এবার যেহেতু ধ্রুব আছে তাই আর টেনশনের কিছু থাকছে না। যা কিছু করার সেই করবে। তার বাপ–মায়ের জন্য সে যা করবে তার কিছু অংশ আংকেলের ভাগেও উপচে পড়বে। অতএব মেজাজ তো ফুরফুর করবে!
আমাদের সামনে এবং পিছনে শত শত মানুষের ছুটন্ত কাফেলা। কোথায় যাচ্ছে এতো মানুষ! যে যার মতো করে ছুটছে। চীনাদের পাশাপাশি চ্যাপ্টা নাকের অন্যান্য জাতির লোকজন যেমন রয়েছে তেমনি প্রচুর পশ্চিমাও। আমাদের চেহারারও বহু মানুষ দেখা গেলো। এরা নিশ্চয় ভারতীয়। পাকিস্তানের সাথে চীনের সম্পর্ক দারুণ। চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে পাকিস্তানের বহু মানুষের উপস্থিতিও বেশ চোখে পড়ে।
ধ্রুব আমাদেরকে একটু সামনে গিয়ে গাড়িতে উঠতে হবে বলে জানালো। সে তার মা’র লাগেজটি টেনে নিল। আমার ভীষণ ভালো লাগলো। জগতের সব মা যদি সন্তানের কাছে এমন ভালোবাসা পেতো! ধ্রুব আগে আগে হাঁটছে, আমরা পেছনে। আমাদের পাশ কেটে শত শত মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে। এদের সবাই কি গাড়ির জন্য ছুটছে। আমি ভড়কে গেলাম। এতো লোক, গাড়ি ঠিকঠাকভাবে পাওয়া যাবে তো!
কথাটি শুনে ধ্রুব হাসলো। বললো, চীনে গাড়ির অভাব হবে না। আমি ‘ডিডি’ কল করে দিয়েছি। দুই মিনিট লাগবে। ধ্রুব ইংরেজী এবং চাইনিজ টোনে বাংলা বলে। তার ডিডি আমার কাছে ‘দিদি’র মতো লাগলো। তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম, দিদি আবার আসলো কোত্থেকে! ডালিয়া ভাবীকে বললাম, আপনার তো দুই ছেলে জানতাম, মেয়েও আছে? সেও এখানে থাকে? ভাবী যেনো আকাশ থেকে পড়লেন। সারাক্ষণ হাসিখুশীতে থাকা ডালিয়া ভাবী হাসতে হাসতে কুটি–কুটি।
ফজলে করিম ভাই ব্যাপারটি বুঝতে পারলেন। বললেন, এটা দিদি নয়, ‘ডিডি কার’। আমাদের উবারের মতো। চীনে উবার নেই। এবার আমার আকাশ থেকে পড়ার পালা। উবার নেই মানে! পৃথিবী দাবড়িয়ে বেড়ানো উবার চীনে নেই। তাহলে এখানের মানুষ চলে কেমনে? করিম ভাই উত্তর দিলেন, যেমন করে গুগল, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ছাড়া উইচ্যাট বা সিনা ওয়েইবো দিয়ে চলে। ওরা নিজেদের মতো করে সবকিছু করে নেয়, ইউরোপ আমেরিকার ধার ধারে না! আমি ভিতরে ভিতরে থমকে গেলাম, চীনের সক্ষমতা কোন পর্যায়ে তা ভাবতে লাগলাম।
দুই মিনিটের মধ্যেই চকচকে একটি গাড়ি এসে হাজির হলো। নামটি অপরিচিত, চীনের তৈরি। ফ্রন্ট সিটে বসলাম আমি। করিম ভাই স্ত্রী পুত্র নিয়ে পেছনে। ড্রাইভার আমাকে ইশারায় সিট বেল্ট বাঁধতে বললো। আমাদের এখানে একজন চীনাকেও সিট বেল্ট বাঁধতে দেখিনা, অথচ নিজের দেশে অন্যরকম।
গাড়ি ছুটছিল। দারুণ গতিতে ছুটছে অপরিচিত ব্র্যান্ডের গাড়িটি। চড়েও বেশ আরাম। তবে সবচেয়ে আরাম লাগছিল রাস্তা দেখে। এতো সুন্দর রাস্তা আমি খুব কমই দেখেছি। হাতের নখও মনে হয় এতো মসৃন নয়, পুরো রাস্তা যেনো টাইলস করা, সমান। রাস্তার দু’ধারে প্রচুর গাছ, ফুলের গাছই বেশি। কত রকমের ফুল যে ফুটে আছে! এখন কী ফুলের মৌসুম? ধ্রুব বললো, সারা বছরই তো এদের রাস্তা, বাড়ি কিংবা বাগানে ফুল থাকে। এতো ফুল! আমার চোখ কপালে উঠে যাচ্ছিলো।
হঠাৎ আমার মনে হলো, চট্টগ্রামের অন্যতম প্রসিদ্ধ ফুল ব্যবসায়ী মাধবীর সেলিম ভাইয়ের কথা। সেলিম ভাই আমার বেশ ঘনিষ্টজন। মাঝেমধ্যে ওনার দোকানে বসে কফি খেতে খেতে গল্প হয়। বউ–বাচ্চাদের জন্মদিনের ফুল নেয়ার জন্য দোকানে গেলেই তিনি কফি খাওয়ান আর রাজ্যের গল্প জুড়ে দেন। সেলিম ভাই আমাকে বলেছিলেন যে,তিনি চীন থেকে ফুল আমদানি করেন। আমাদের দেশের ফুলের দোকানগুলোতে শোভা পাওয়া বেশিরভাগ ফুলই নাকি চীন থেকে আনা হয়। নানা ধরণের দামি ফুলের পাশাপাশি গোলাপের মতো সাধারণ ফুলও আসে চীন থেকে। সুজলা সফলা কৃষিপ্রধান একটি দেশে ফুল আনতে হয় চীন থেকে!
বিভোর হয়ে চারদিক দেখছিলাম। কী সুন্দর করেই না প্রকৃতিকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। বিমানবন্দর থেকে শহরের রাস্তা পৃথিবীর সবদেশই সুন্দর করে রাখে। কারন এই রাস্তাকে বলা হয় শহরটির আয়না। এরাও রেখেছে। এতে তেমন কোন নতুনত্ব নেই। তবে কোথায় যেনো একটু অন্যরকম ভাব আছে! বিশাল চওড়া রাস্তা। কোথাও দশ লেনই, কোথাও বারো লেইন, কোথাও বা আট লেইন। সবগুলো লেনেই চলছে গাড়ি। ১১০ পর্যন্ত অনুমোদিত মাইলেজ। কিন্তু এক একটি গাড়ি ছুটছে ১২০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার বেগেও। আমাদের ডিডি’র স্পিড ১২৫। কী যে গতি এক একটি গাড়ির। কিন্তু একটিকে অন্যটি ধাক্কা দিচ্ছে না, একটির লেনে অপরটি উঠে যাচ্ছে না। প্রতিটি গাড়ি নিজের লেনে ছুটছে। রাস্তার কোথাও পুলিশ দেখা যাচ্ছে না, অথচ কেউ সিগন্যাল ব্রেক করে এগিয়েও যাচ্ছে না। অটো সিগন্যালে থামছে, সবুজ বাতিতে ছুটছে। টোল প্লাজায় স্বয়ংক্রীয়ভাবে টোল কেটে নেয়া হচ্ছে। অদ্ভুদ এক ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট পুরো পথে।
সাংহাই শেরাটনে যখন আমাদের ‘ডিডি কার’ ঢুকলো তখন আমার পিলে কিছুটা চমকে উঠলো। শেরাটনে কেন? করিম ভাই বললেন, ধ্রুব এখানেই আমাদের জন্য রুম নিয়েছে। আগে থেকে সে বুকড করে রেখেছিল। এখানে দুইদিন থেকে তারপর আমরা অন্য শহরে চলে যাবো। সেখানে অন্য হোটেলে থাকা যাবে। তাই বলে শেরাটনে!
গাড়ি থামার সাথে সাথে বেলবয় এসে আমাদের লাগেজগুলো নামিয়ে নিল। এই ধরনের পাঁচতারকা হোটেলগুলোতে ব্যাগ বা লাগেজ নিয়ে টানাটানি করতে হয় না, হোটেলের বেলবয় রুমে পৌঁছে দেয়। এসব বেলবয়কে সাধারণ ভাবলে ভুল করা হবে। এরা বেশ শিক্ষিত, ড্রাইভিং জানে। বিভিন্ন ভাষার উপরও দক্ষতা থাকে। সাধারণত বিদেশ থেকে পড়তে আসা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঘন্টা হিসেবে এসব চাকরি করেন। এদের আচার আচরণ অসম্ভব মার্জিত। বেলবয় এগিয়ে আসায় আমরা আর লাগেজের জন্য অপেক্ষা করলাম না। ধ্রুব ডিডি বিদায় করে দিল। এসব এ্যাপসে কল দেয়ার সময়ই নাকি টাকা কেটে নেয়, মোবাইল থেকে। তাই ভাড়া কত আসলো বা ভাংতি আছে কি নেই, টিপস দেবেন কি দেবেন না এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না।
আমরা সোজা রিসিপশনে পৌঁছে গেলাম। আলীশান কারবার। দৃষ্টিনন্দন বিশাল ডেস্ক, সেখানেও চ্যাপ্টা নাকের জয়জয়কার। কয়েকটি তরুণী চেয়ারে বসে কম্পিউটারে কি যেনো কাজ করছিলেন। আমরা কাছে যেতেই তিনি কম্পিউটার থেকে চোখ তুলে সরাসরি তাকালেন। দাঁড়িয়ে সম্মান জানালেন। ধ্রুবই কথা বলছিল। চীনা ভাষায়। কম্পিউটারে কি কি সব টিপাটিপি করে তরুণী আমাদের পাসপোর্ট চাইলেন। আমরা ব্যাগ থেকে পাসপোর্ট নিয়ে ওনাকে দিলাম। তিনি পাসপোর্টের প্রথম পেজের পাশাপাশি ভিসা পেজও স্ক্যান করে নিলেন। চীনের ভিসাটি আসল না নকল সেটিও যেনো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করে নিলেন। আমাদেরকে একই ফ্লোরে তিনটি রুমের চাবি দেয়া হলো। তিন রুম কেন? করিম ভাই বললেন, ধ্রুব একা থাকবে।
রুমে ঢুকে মনটি ভালো হয়ে গেলো। শেরাটন হোটেল বলে কথা। আন্তর্জাতিক এই চেইন হোটেলের সেবা বিশ্বব্যাপী। থাকা খাওয়া এবং আতিথেয়তায় তাদের তুলনা মেলা কঠিন। ঢাকা শেরাটনে একরাত ছিলাম। আলেকজান্দ্রিয়া শেরাটনেও ছিলাম কয়েক রাত। দারুণ লেগেছিল। কিন্তু সাংহাই শেরাটনের আয়েশ কিছুটা বাড়তি বলে মনে হচ্ছিল। প্রথমত রুমটি বিশাল, ঘরের ঠিক মাঝখানে একটি কাপল বেড। ধবধবে সাদা বিছানার উপর বালিশগুলো অনেক নান্দনিক করে রাখা। রুমের জানালার পাশে একটি ডিভাইন, পাশেই সোফা। চেয়ার টেবিল. ওয়্যারড্রপসহ নানা আসবাব ঘরজুড়ে। কর্ণারে ফুলদানিতে চমৎকার তাজা ফুল, টি–টেবলের উপর র্যাপিং করা ফ্রুটস বাকেট। হ্যাঙ্গারে ঝুলছিল দুইটি স্লিপিং গাউন, পাশে স্টিলনেস স্টিলের তাকের উপর তিনটি পৃথক সাইজের ছয়–ছয়টি তোয়ালে। কফি মেশিনসহ নানা উপকরণ। কফিমেকারটিও দারুণ। উপকরণগুলোও অসাধারণ। সবকিছু মিলে একটি রাজকীয় ভাব রুমটির পরতে পরতে। এমন রাজকীয় আবহে হাত–পা ছড়িয়ে সময়টি দারুণ কাটবে বলেও মনে হচ্ছিল। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।