ফোনটি অসময়ে বাজছিল। বিরক্তিকর রিং টোন। সভা সমাবেশ কিংবা কোলাহলের মাঝেও যাতে ফোন আসলে বুঝতে অসুবিধা না হয় সেজন্য বেশ কড়া একটি রিং টোন সিলেক্ট করে রেখেছি। কিন্তু এই রিং টোন প্রায়শঃ আমার ঘুমের কিংবা ধ্যানের বারোটা বাজায়। তবুও কিছু করার থাকেনা। রিং টোন পাল্টাতে পারছি না। কত ধরণের জরুরি ফোন থাকে, কত ধরণের প্রয়োজন! আয়েশের কথা চিন্তা করে তো আর খবরের কাগজের রিপোর্টারগিরি চলে না! অতএব জয়তু কড়া রিং টোন!
যাক, বিরক্তি নিয়ে ফোন হাতে নিলেও স্কিনে চোখ দিয়ে মুখে হাসি ফুটে উঠলো। আমার লায়ন্স ক্লাবের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফজলে করিম লিটনের ফোন। ‘হ্যালো’ বলতেই অপর প্রান্ত থেকে কোন ভূমিকা না করেই বললেন, চীন যেতে পারবেন? আমিও এক সেকেন্ড চিন্তা না করেই বললাম. পারবো তো। তিনি বললেন, কোরবানের ঈদের সময় কিন্তু! হাসতে হাসতে বললাম, ‘ তাতে কী,কোন সমস্যা নেই। জীবনে বহুবার ঈদ–কোরবান দেশের বাইরে করা হয়েছে। এবারও সমস্যা হবে না।’
সত্যি বলতে কি বিদেশে যাওয়ার জন্য আমি ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। বহুদিন কোথাও যাইনি। ভয়াল করোনা পৃথিবীর অনেক কিছুই পাল্টে দিয়েছে। পাল্টে দিয়েছে আমার বিদেশ ভ্রমনের গতিবিধিও। বছরে তিন চারবার বিদেশ ঘুরতে অভ্যস্ত হয়ে উঠা আমি অনেকটা ঘরে বন্দি হয়ে পড়েছিলাম। ঠিক কখন বিদেশ গিয়েছিলাম মনে করার চেষ্টা করলাম। বিদেশ ভ্রমণের এমন খরার মাঝে লায়ন ফজলে করিমের চীন ভ্রমনের প্রস্তাব মরুর বুকে বৃষ্টির মতো মনে হচ্ছিল। তাই কোন কিছু না ভেবেই বললাম, যাবো। কোথায় যাবো, কেন যাবো তা নিয়ে পরে ভাবলেও হবে। আপাততঃ সীমান্ত পার হই, তারপর নাহয় চিন্তা ভাবনা করা যাবে। পাসপোর্টের স্ক্যান কপি হোয়াটসঅ্যাপে দিয়ে রাখতে বলে তিনি ফোন রাখলেন।
ফজলে করিম লিটন আমার ক্লাবের সদস্য। লায়নিজমে দারুণ নিবেদিত একজন মানুষ। আমি যখন ক্লাবের প্রেসিডেন্ট তখন তিনি ক্লাবের সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আমরা একই সাথে দুই টার্ম কাজ করেছি। করোনাকালে আমাদের ক্লাবের নানা কার্যক্রমে মানুষটি এতো বেশি নিবেদিত ছিলেন যে, আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। ক্লাবের সম্পর্কের বাইরেও তার সাথে গড়ে উঠে আমার পারিবারিক সম্পর্ক, আত্মার স্বজন–আত্মীয়।
করিম ভাইয়ের সাথে আগেও আমি চীনে গিয়েছি। লায়ন্সের নানা প্রোগ্রামে গিয়েছি অন্যান্য দেশেও। অতএব একটি চমৎকার ভ্রমণের স্বাদ পেতে যাচ্ছি ভেবে পুলকিত হয়ে উঠলাম।
বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গার্মেন্টস মেশিনারিজ উৎপাদনকারী চীনা প্রতিষ্ঠান জ্যাক। এই কোম্পানি গার্মেন্টস শিল্পের জন্য রোবটসহ নানা অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি বানিয়ে ইতোমধ্যে পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। শুধু চীনেরই নয়, পৃথিবীর বড় কোম্পানিগুলোর একটি হচ্ছে জ্যাক। হাজার হাজার কোটি ডলারের বার্ষিক টার্ণওভার এই কোম্পানির। পৃথিবীর দেশে দেশে রয়েছে কোম্পানির অফিস, বিনিয়োগ। শত শত নয়, হাজার হাজার কর্মী এই কোম্পানির। গতবারও এদের আমন্ত্রণে আমি চীন গিয়েছিলাম। এবারও তাদের আমন্ত্রণে অতিথি হিসেবে চীনে যাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। জ্যাক এর কার্যক্রম কাছ থেকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না যে, এটা কোম্পানি হিসেবে কত বড়, এদের আয়োজন কত আলীশান! অতিথিদের সম্মানে এরা কত কিছু করে!
লায়ন ফজলে করিম জানালেন যে, জ্যাক গার্মেন্টস সেক্টরের জন্য নানা ধরণের নতুন নতুন ইকুইপমেন্ট প্রস্তুত করেছে। রোবট দিয়ে তারা দুনিয়ার সব কাজ করিয়ে নিচ্ছে। ২০ জন শ্রমিকের কাজ করছে একজন রোবটে। এগুলো বিশ্বের সামনে তুলে ধরার জন্য সারা দুনিয়া থেকে গার্মেন্টস ব্যবসায়ী এবং সাংবাদিকদের নিয়ে বড় পরিসরে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। উক্ত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের একমাত্র সাংবাদিক হিসেবে আপনাকে দাওয়াত দেয়া হয়েছে। অনুষ্ঠানের কিছু ‘নিউজ–টিউজ’ করে দিলে হবে। আমি হাসতে হাসতে বললাম, নিউজ তো সমস্যা নয়। সমস্যা হচ্ছে বেড়ানো। গতবার চীনের বিস্তৃত অঞ্চলে বহুকিছু দেখে এসেছি। আবার ইচ্ছে থাকার পরও অনেককিছু দেখতে পারি নি। বিশাল চীনের পুরোটাই দেখা সম্ভব নয়, তবে যতটুকু সম্ভব সেগুলোরও অনেকগুলো বাদ রয়ে গেছে। গতবার যেগুলো দেখিনি এবার সেগুলো দেখানোর ব্যবস্থা করবেন। তাহলেই হয়ে যাবে। কোথায় থাকলাম, কি খেলাম সেসব নিয়ে আমার কোন মাথাব্যাথা থাকে না। কিন্তু দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখতে না পারলে মাথাব্যাথা শুরু হবে। করিম ভাইও হাসতে হাসতে বললেন, সব হবে।
করিম ভাই জ্যাক এর আমন্ত্রনপত্র থেকে শুরু করে বিমানের টিকেট হোয়াটসঅ্যাপে দিয়ে দিলেন। বললেন, পাসপোর্ট ঢাকা পাঠাতে হবে, ভিসার জন্য। লায়ন্সের একটি অনুষ্ঠানে আমার পাসপোর্ট ওনাকে দিয়ে দিলাম। চীনের ভিসা খুব সহজে জুটে না। তবে আমি আগে যেহেতু একবার তাদের দেশে কোন ধরনের ঝামেলা না করে বেড়িয়ে এসেছি তাই আমার ভিসা না হওয়ার বিশেষ কোন কারণ দেখছি না। তাছাড়া জ্যাকের মতো কোম্পানির অতিথিকে ভিসা না দেয়ার প্রশ্নই উঠেনা। ভিসার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম বলেই আমি অফিস এবং বাসার নানাকাজ গুছিয়ে নিতে শুরু করলাম। পাঁচদিনের মাথায় চীনের ভিসাসহ পাসপোর্ট ফেরত পেলাম।
কোরবানি ঈদের দুইদিন আগে ঢাকা এয়ারপোর্টের ইবিএল লাউঞ্জে বসে পরাণটা হু হু করে উঠলো। বিদেশ যাওয়ার উত্তেজনা থাকলেও ঈদের আগ দিয়ে পরিবার পরিজনকে রেখে দেশ ছাড়তে কেমন কেমন যেনো লাগছিল। লায়ন ফজলে করিম, মাহমুদা করিমসহ ঢাকা এবং চট্টগ্রামের কয়েকজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী মিলে ছোটখাটো একটি দল আমরা। সবাই জ্যাক এর আমন্ত্রিত অতিথি। কমবেশি উচ্ছ্বাস সবার ভিতরে।
চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে যাত্রা করবো আমরা। মধ্যরাতের কিছু আগে ঢাকা থেকে যাত্রা করে ভোরে গুয়াংজু পৌঁছাবো। চেকইন থেকে শুরু করে ইমিগ্রেশন পর্যন্ত সব কাজই আমাদের হয়ে গেছে। লাগেজ দিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন অনেকটা ঝাড়া হাত পা নিয়ে বিমানবন্দরের লাউঞ্জে খাওয়া দাওয়া করছি। জানি যে, বিমানে চড়লে আমাদের ডিনার সার্ভ করা হবে। তবুও ইবিএল লাউঞ্জের দারুণ সব খাবার একটু একটু চেকে দেখছিলাম।
চায়না সাউদার্ন চীনের অনেক বড় একটি এয়ারলাইন্স। চীনের প্রধান তিনটি এয়ারলাইন্সের একটি হচ্ছে চায়না সাউদার্ন। এছাড়া চায়না এয়ার এবং চায়না ইস্টার্ণ এয়ারলাইন্সও চীনের বড় ফ্লাইট অপারেটর। চায়না সাউদার্ন বিশ্বের ৬ষ্ঠ বৃহত্তম ফ্লাইট অপারেটর এবং এশিয়ার প্রধানতম। শত শত এয়ারবাস এবং বোয়িং তাদের বহরে। প্রতিদিন বিশ্বের দুইশ’টিরও বেশি গন্তব্যে তারা হাজার হাজার যাত্রী নিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করে। ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখলাম যে, ১৯৮৮ সালের পর বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনায় বেশ কিছু যাত্রীর প্রাণহানীর ঘটনা ঘটেছে। তবে এরমধ্যে সাম্প্রতিক কোন ঘটনা নেই। অতএব কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে বড়সড় বোয়িং এর পথে যাত্রা করলাম। ঢাকা গুয়াংজু রুটে এতো বড় এয়ারবাস দেয়ার অর্থই হচ্ছে এই রুটে প্রচুর যাত্রী চলাচল করে।
ইবিএল লাউঞ্জ থেকে বের হয়ে বোর্ডিং ব্রিজের পথে হাঁটছিলাম। আমাদের এয়ারপোর্ট অত বড় নয়। সবকিছুই কাছাকাছি। তাই কষ্ট কম হয়। কিন্তু জুতা মোজা খোলার পাশাপাশি কোমরের বেল্ট খোলার যন্ত্রনা কী যে পীড়া দেয়! একদফা তল্লাশীর পর আমরা বিমানবন্দরের লাউঞ্জ পর্যন্ত পৌঁছেছি। বিমান বন্দরের এত নিরাপত্তা বলয়ের ভিতরে আবারো নতুন করে তল্লাশি করার কোন মানে আছে বলে মনে হয়না। কিন্তু বোর্ডিং গেটের আগে আবারো সবকিছু খুলে টুলে চেক করা হয়। যাত্রীদের প্রায় সকলেই মুখ বেজার করে তল্লাশির ধকল সামলে নেন। আমরাও নিলাম। বোর্ডিং ব্রিজের ভিতর দিয়ে সামনে হাঁটছিলাম।
এয়ারবাসের গেটে চীনা সুন্দরীরা স্বাগত জানালেন আমাদের। হাতের বোর্ডিং কার্ড দেখে কোন রো ধরে সামনে এগুবো তা বাতলে দিচ্ছিলেন। চেক ইন করার সময় আমাকে উইন্ডো সিট দেয়ার অনুরোধ করেছিলাম। একটু পেছনের দিকে হলেও আমার সিট কোথায় সেটি আমি বুঝতে পারছিলাম।
হাতের কেবিন ব্যাগটি ঠেলে ঠেলে আমি এয়ারবাসের পেছনের দিকে যাচ্ছিলাম। বিজনেস ক্লাসের কয়েকটি সিট খালি থাকলেও ইকোনমি ক্লাসের প্রায় পুরোটাই মানুষে ভর্তি। আমি নির্দিষ্ট সিটে গিয়ে ওভারহেড কেবিনে ব্যাগ রাখতে গিয়ে টের পেলাম যে, সেটি আগেই দখল হয়ে গেছে। বিমানবালার দৃষ্টি আকর্ষন করলাম। তিনি ঠেলে ঠুলে আমার ব্যাগটি ঢোকানোর চেষ্টা করলেন। না পেরে নিজেই অন্য একটি সিটের উপরে তুলে রাখলেন। আমার দিকে তাকিয়ে ইংরেজীতে বললেন, সরি। তোমার ব্যাগটি একটু দূরে রাখতে হলো। আমি হাসিমুখে মাথা নাড়লাম। মনে মনে বললাম, তুমি যে রেখেছো তাতেই হবে। বিমানের পুরোটা যদি ঠিকঠাকভাবে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার উড়তে পারে, তাহলে আমার সাথে আমার ব্যাগও গুয়াংজুতে পৌঁছাবে। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।