(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
কফির মগে চুমুক দিতে দিতে মেট্রো স্টেশনে চক্কর মারছিলাম। হংকংয়ের সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশন। প্রথম দেখার যে ভালো লাগা তা কোনভাবেই কাটছিল না। যত দেখছিলাম ততই মুগ্ধ হচ্ছিলাম। একটি রেলওয়ে স্টেশন কি করে এতো সুন্দর হয় তা আমার মাথায় ঢুকছিল না। আমাদের বিমানবন্দরের চেয়ে বেশি আয়োজন স্টেশনটিতে। পুরো ফ্লোরই দারুণভাবে টাইলস করা। রয়েছে চলন্ত পথও। হাঁটতে হাঁটতে কাহিল হয়ে গেলে শুধু দাঁড়িয়ে থাকলেই হয়। এস্কেলেটর আপনাকে সামনের দিকে নিয়ে যাবে। অনেকেই দেখলাম লাগেজ টাগেজ নিয়ে এস্কেলেটরে দাঁড়িয়ে আছেন। পথই তাদের নিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। আমরাও একটি এস্কেলেটরে দাঁড়িয়ে পড়লাম। এরূপ বেশ কয়েকটি স্কেলেটর রয়েছে হংকং সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশনে। রয়েছে চলন্ত সিঁড়িও। এসব সিঁড়িতে চড়ে দোতলা তিনতলার দিকে ছুটছেন অনেকেই। আমাদের ওদিকে কোন কাজ না থাকায় গেলাম না। আমরা সামনেই হাঁটলাম। পথের ধারে ধারে কত যে বিস্ময়!
স্টেশন থেকে বের হওয়ার সময় পথ আগলে দিল যন্ত্র। দারুণ এক ব্যারিয়ার। টিকেট ছাড়া কারো প্রবেশের বা বের হওয়ার সুযোগ নেই। টিকেট চেকিং পথেই হয়ে যাচ্ছে। আমি টিকেট মেশিনের কয়েন বক্সের মতো একটি ছিদ্রে দেয়ার পর সেটি টুক করে অন্যদিকে বের হয়ে গেলো। সাথে সাথে সরে গেলো ব্যারিয়ার। আমি বাইরে এসে দাঁড়ালাম। আমার পেছনে হাতের অক্টোপাস কার্ডটি ছুঁইয়ে দিয়ে ব্যারিয়ার পার হলো স্বপন। কত আধুনিক সব আয়োজন! অবশ্য এমন আয়োজন দুনিয়ার অনেক দেশেই আছে। শুধু আমাদের রেলওয়ে স্টেশনে নেই।
স্টেশনের বাইরে এসে ভীষণ এক ব্যস্ত জনপদ দেখা গেলো। প্রচুর মানুষ, গাড়ি। ব্যস্ততা যেনো এখানে বাঁধ ভেঙ্গেছে। কারো হাতে এক মিনিট সময় নেই। শুধু অলস সময় পার করছিলাম আমরা। স্বপন আমাকে বললো, চল, এবার একটু হাঁটতে হবে। অল্প পথ, বেশিক্ষণ লাগবে না। আমাদের কোন লাগেজ নেই। একেবারে খালি হাত। তাই হাঁটতে তেমন কোন অসুবিধা নেই। আমি আলতো করে পকেট হাতড়ে পাসপোর্টটি দেখে নিলাম। ঠিকঠাক আছে। এই পাসপোর্ট যে বিদেশে কী পরিমাণ গুরুত্বপূর্ণ একটি জিনিস তা যে হারায়নি, তার বুঝার কথা নয়। আমি কোনদিন পাসপোর্ট হারাইনি, তবে খুব কাছ থেকে পাসপোর্ট ছিনতাই হওয়া এক অভাগার দুর্ভোগ দেখেছিলাম। ওই ঘটনার পর থেকে দুনিয়ার আর কিছুর যত্ন না করলেও পাসপোর্ট বড় যত্নে রাখি আমি। ভিসা এবং পাসপোর্টের একাধিক ফটোকপিও সংরক্ষণ করি। যাতে বিপদে পড়লেও ‘আউটপাস’ যোগাড়ে ভোগান্তি কম হয়।
স্বপন সামান্য পথ বললেও আমার মনে হলো অনেকপথ পাড়ি দিলাম। হংকং শহরের রাজপথ ধরে হাঁটছি। ফুটপাতের উপর দিয়ে হাঁটার যে আনন্দ তা আমাদের দেশে কোথায়!
বিশ্বের উন্নত শহরগুলোতে ফুটপাতের চাকচিক্য দেখেছি। হংকংও যে, ইউরোপ আমেরিকার মতো ফুটপাত গড়ে তোলেছে তাও দেখা হয়ে যাচ্ছিল। কী প্রশস্ত, কী সুন্দর! কী পরিষ্কার, গোছানো!
সিনেমা হলের সামনে পৌঁছে ভিমরি খেলাম। বহু লোক। এতো লোক সিনেমা দেখে! ঢাউশ সাইজের একটি পোস্টার হলের বাইরে। এক পলক তাকিয়ে স্বল্পবসনা নায়িকার ছবি দেখা গেলো। কারাতে স্টাইলের মারামারির দৃশ্যও চিত্রায়িত করে রাখা হয়েছে পোস্টারটিতে। বুঝতে পারলাম যে, মারদাঙ্গা টাইপের ছবি হবে।
স্বপন টিকেট কেটে নিলো। আমাদের দুজনের টিকেটের যে দাম শুনলাম তা বেশ চড়া বলে মনে হলো। হংকং পৃথিবীর ব্যস্ত শহরগুলোর একটি। তাই ব্যয়বহুল। যেখানে কোন কিছুরই দাম কম নয়। মানুষের বেশুমার আয়ের সুযোগ থাকায় চড়া দাম খুব বেশি প্রভাব ফেলে না।
সিনেমার প্রতি বিশেষ কোন আকর্ষণ নেই আমার। না দেখলেও চলে। তবে হংকং এ সিনেমা দেখার বিশেষ একটি উদ্দেশ্য রয়েছে। সিনেমার জগতে হংকং বহুদূর এগিয়ে গেছে। সিনেমায় প্রযুক্তির ব্যবহারে হংকং হলিউডকে অনুসরণ করে। হংকংয়ের ইউনিভার্সেল স্টুডিওতে শুধু নিজেদেরই নয়, বহু চীনা মুভিরও কাজ সারে। তাছাড়া সিনেমা দেখলে দেশের বিভিন্ন স্থানের নানা দৃশ্য দেখা যায়। এতে করে পুরো দেশটি না ঘুরেও বহু কিছু সিনেমার কল্যাণে জানা যায়।
হলে প্রবেশ করে চক্ষু চড়কগাছ। কী যে সুন্দর একটি হল। এক একটি আসন যেনো কর্পোরেট হাউজের সোফা। বেশ আয়েশ করে বসলাম। ঢাউশ সাইজের পর্দা। সিনেমা শুরু হয়নি, লোকজন আসন নিতে শুরু করেছে। প্রচুর নারী পুরুষ সিনেমা দেখতে এসেছে। জোড়ায় জোড়ায় আসা মানুষের সংখ্যাও অনেকে।
নির্দিষ্ট সময়ে হলের বাতি নিভে গেলো। উজ্জ্বল হয়ে উঠলো পর্দা। বিজ্ঞাপন টাইপের কিছু প্রদর্শিত হচ্ছিল। এরপরই শুরু হলো সিনেমা। সিনেমার নাম আমার মনে নেই। ভাষারও কিছু বুঝতে পারছিলাম না। তবে আমি বুঝে গেছি যে, ছবি এবং বডি ল্যাঙ্গুয়েজে যতটুক বুঝা যায় তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
সিনেমা জমে উঠেছে। জমজমাট প্রেম কাহিনী। নায়ক নায়িকার রোমাঞ্চ, খলনায়কের উৎপাত, অভিভাবকদের ঝক্কিসহ সবকিছু বেশ চেনা। তবে শুধু মারের স্টাইলটা একটু অন্যরকম। দারুণ মারামারি সিনেমার যেখানে সেখানে। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে এত বেশি মারামারি চলছিল যে তা বেশ উচ্ছ্বসিত করছিল হলভর্তি দর্শককে। ভাষা না বুঝলেও মারের নানা কৌশল দেখে আমি বেশ চমকিত। নায়িকা যেনো উড়ে উড়ে মারছিল। শরীরে হাড় না থাকলেও যেমন করে নিজেকে দুমড়ানো মুচড়ানো যায়, তারা যেনো তেমন করেই নিজেদের তৈরি করেছিল। সিনেমা চলছিল, জমে উঠেছিল গল্প। যথারীতি দারুণ এক রোমাঞ্চের দৃশ্যে নায়ক নায়িকার মহামিলন ঘটিয়ে সিনেমার পর্দা নামলো।
সবার সাথে বের হয়ে আসলাম আমরা। উচ্ছ্বসিত দর্শকেরা বেশ সাড়ম্বরে হল ছাড়ছিলো। বাইরে বের হওয়ার পর আবারো জটলা দেখা গেলো। গাড়ি এবং মানুষ যেনো গিজগিজ করছিল। স্বপন বললো, চল, কিছু খাই। তারপর যেদিকে ইচ্ছে যেতে পারবো। আমরা একটি রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলাম। এখানের সব খাবারই অচেনা, অজানা। স্বপনই আমার ত্রাণকর্তা। সে অর্ডার করলো। স্যান্ডউইশ এবং ফ্রেঞ্চফ্রাইসহ একটি খাবার দেয়া হলো আমাদের। স্বপন আমাকে আশ্বস্ত করলো যে, টুনাফিশের স্যান্ডউইস, সমস্যা নেই। কফি দিয়ে শেষ হলো আমাদের নাস্তা পর্ব। স্বপনই বিল পরিশোধ করলো। বিল দেয়ার সময় খেয়াল করলাম যে, বেশ ভালো অংকের অর্থ এই নাস্তার পেছনে চলে গেলো।
স্বপন গার্মেন্টস এক্সেসরিজ সাপ্লাই দেয়ার ব্যবসা করে। সে হংকং এ থাকলেও চীন থেকে প্রচুর গার্মেন্টস এক্সেসরিজ দেশের গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে পাঠায়। চীনে কারখানায় উৎপাদিত পণ্য বাংলাদেশের গার্মেন্টসগুলোতে ব্যবহৃত হয়। অনেক সময় বিদেশী বায়ার এঙেসরিজ নির্দিষ্ট করে দেয়, আবার কখনো উন্মুক্ত থাকে। স্বপন তার বড়ভাইয়ের সাথে বহুদিন ধরে এই ব্যবসা চালিয়ে আসছে।
আমার জন্য অনেক টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে বলায় স্বপন কিছুটা রাগ দেখালো। বললো, তোর জন্য খরচ করার সুযোগ পাচ্ছি কোথায়? কিছুই তো নিচ্ছিস না। কফি খেয়ে আর কত খরচ করা যায়! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।