(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আসলে ‘নেই কাজ তো খৈ ভাজ’ টাইপের কাজ–কারবার চলছে আমাদের। একদম এলোমেলো। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, হাতে কোন কাজ নেই, তাই পার্কে পার্কে ঘুরছি। অন্যভাবে বললে, পার্ক ঘুরে দেখাই যেনো আমার একমাত্র কাজ। অপরদিকে বন্ধু স্বপনের কাজ হচ্ছে আমাকে পার্ক দেখানো কিংবা কোথাও একটু ঘুরিয়ে টুরিয়ে বন্ধুত্বের দায়িত্ব যথাযথভাবে সুসম্পন্ন করা। স্বপন তার দায়িত্ব পালন করছে। আমাকে জাহাজে চড়িয়ে নদী পার করে ভিক্টোরিয়া পার্কে নিয়ে এসেছে। হংকং এর সবচেয়ে জনপ্রিয় পার্ক হচ্ছে এই ভিক্টোরিয়া। প্রতিদিন হাজার হাজার নরনারী এই পার্ক পরিদর্শন করেন, খেলতে আসেন, হাওয়া খেতে আসেন। দেশ–বিদেশের ব্যবসায়ী শিল্পপতিরাও নানাকাজে হংকং আসলে এই পার্কটি ঘুরে যান। ব্রিটিশ রাণি ভিক্টোরিয়ার নামে গড়ে তোলা পার্কটি মানুষের হাতের ছোঁয়ায় অপূর্ব হয়ে উঠেছে। কৃত্রিমতায় ভরা পার্কটির পরতে পরতে মুগ্ধতা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। যেদিকে তাকাবেন সেদিকেই বিস্ময়। এত সুন্দর করেও পার্ক রাখা যায়? এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন! ওয়াকওয়ে থেকে শুরু করে পাহাড়ি আদলে ঘনজঙ্গল, কিংবা আকাশ ঢেকে রাখা পাইন গাছের সারি যে কাউকে মুগ্ধ করার জন্য যথেষ্ট।
বিশাল পার্কটির খুবই সামান্য এলাকাই আমাদের দেখা হয়েছে। নানা আয়োজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হয়েছে নানাদিকে। তাই আমরা হেলেদুলে ঘুরে ফিরে পুরো পার্কটি দেখার চেষ্টা করছিলাম।
প্রায় ৪৭ একর আয়তনের পার্কটিতে শুধু নদীপথে নয়, সড়কপথেও আসা যাওয়ার দারুণ সুবিধা রয়েছে। রয়েছে ট্রাম লাইনও। হংকংয়ের যে কোন স্থান থেকে সড়ক পথে এসে পার্কের সামনে নামা যায়। বাস স্টপেজের হাতছোঁয়া দূরত্বেই ভিক্টোরিয়া পার্ক। আবার ট্রামে আসলেও সুবিধার অন্ত নেই। শুধু রাস্তা পার হয়েই পার্কের ঢুকে পড়া। ভিক্টোরিয়া পার্কে প্রবেশের বেশ কয়েকটি পথ রয়েছে। রাস্তা থেকে পার্কের ভিতরে এসে পৌঁছার জন্য রয়েছে কয়েকটি ফুটওভারব্রিজ। ফুটওভারব্রিজ শুনে কি একটু চমকালেন? ভিক্ষুক কিংবা পতিতাদের দখলে চলে যাওয়া যেসব ফুটওভারব্রিজ দেখতে আমরা অভ্যস্ত এগুলো মোটেও সেরকম নয়। তকতকে ঝকঝকে ফুটওভারব্রিজে চলন্ত সিঁড়ি বা এক্সেলেটর লাগানো রয়েছে। কোনরকমে ফুটওভারব্রিজের একটি সিঁড়িতেই দাঁড়ালেই হলো, সেটি আপনাকে ঠিকঠাকভাবে উপরে তুলে দেবে। কয়েক কদম পা চালিয়ে আবারো চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে পার্কের মোলায়েম হাওয়ায় গা ডোবাতে অসাধারণ লাগে। এক মিনিটেরে জন্য বন্ধ না হওয়া বিদ্যুৎচালিত এসব সিঁড়ি দিয়ে মানুষ অনায়াসে পার্কে প্রবেশ করে, সময় কাটিয়ে ঘরে ফিরে। পার্ক থেকে বের হওয়ার সময়ও একইভাবে ফুটওভারব্রিজের সাপোর্ট রয়েছে। যোগাযোগ সুবিধার কারণেই পার্কটি এমন জনপ্রিয় বলেও আমার মনে হতে লাগলো। সড়ক, ট্রাম এবং নৌ পথে এত অবলীলায় পার্কটিতে আসা যাওয়া করা যায় যে, যে কেউ যখন তখন পার্কে ঘুরে যেতে পারেন। পার্কটিতে আসা যাওয়ার এমন দারুণ সব আনজাম দেখে হিংসে হচ্ছিল। আহা, আমাদের কেন যে নেই, আমাদের কেন যে হয়না!
পার্কটিতে দারুণ সব খেলাধুলা চলে। কত ধরনের খেলার ব্যবস্থা যে রয়েছে! ফুটবল, টেনিস, টেবিল টেনিস, সাইক্লিং, সুইমিংসহ হরেক রকমের আয়োজন। ইচ্ছে করলে খেললেন, অথবা গায়ের ছায়ায় টুলে বসে কিছুক্ষণ ঝিমিয়ে নিলেন। গাছের ছায়ায় ঘুমাতে ইচ্ছে করলে তাও পারছেন। জঙ্গলে অলস সময় কাটানোর তৃপ্তি নিতে চাইলে তাও জুটে যাবে, ঘুমিয়ে পড়ার জায়গার যেমন অভাব নেই, তেমনি আয়েশ করে বসে ফেসবুকিং কিংবা বই পড়ারও এক মোক্ষম জায়গা এই ভিক্টোরিয়া পার্ক! নানাজন নানাকিছু নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন। সুখী সুখী মানুষ তাঁবুর ভিতরে যেমন রয়েছে, তেমন পাইন গাছের ছায়ায়ও আছে। পাহাড়ের ভাঁজে কিংবা পুলের পাশে সর্বত্রই উচ্ছ্বসিত মানুষ।
পার্কটিতে শুধু বিনোদন বা খেলাধুলাই নয়, কোটি কোটি ডলারের বেসাতিও চলে। বিনোদনের পাশাপাশি পার্কটিতে বছর জুড়ে চলে বিভিন্ন ধরনের মেলা, পণ্যের বিকিকিনি। বিভিন্ন ধরনের ট্রেড শো’র আয়োজন করার অবকাঠামোগত দারুণ সুবিধা রয়েছে পার্কটিতে। গাড়ির মেলা, মেশিনারিজ মেলা, পণ্য মেলা থেকে শুরু করে নানা মেলা যেনো লেগে থাকে। আন্তর্জাতিকমানের মেলা আয়োজনের প্রয়োজনীয় অবকাঠামোসহ নানা সুযোগ সুবিধা পার্কটিতে রয়েছে। হলরুম কিংবা গ্যালারিতে দেশীয় নানা পণ্যের প্রদর্শনী বিশ্বের নজর কাড়ে। হংকংয়ের চেয়ে চীনের পণ্য বেশি বিক্রি হয় এসব মেলায়। হংকংয়ের ব্যবসায়ীরা পণ্যের অর্ডার নেন। চীনের কারখানায় তৈরি করিয়ে জাহাজে বোঝাই করে আমদানিকারকের কাছে পাঠিয়ে দেন। বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম নিয়ন্ত্রক হংকংয়ের কোটি কোটি ডলারের বেসাতির বেশ উল্লেখযোগ্য একটি অংশ এই ভিক্টোরিয়া পার্কের ট্রেড শো’তে সম্পন্ন হয়। শুধু পার্কের ভিতরে হলরুম বা গ্যালারী নয়, পার্কের বাইরের আন্তর্জাতিকমানের হোটেল রিসোর্টগুলোও মেলা আয়োজনে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে।
অন্যদিকে বছর জুড়ে চলা নানা ধরনের মেলা যাতে পার্কের সাধারণ দর্শনার্থীদের বিরক্তির কারণ হয়ে না উঠে সেজন্যও দারুণ সব আইডিয়া কাজে লাগানো হয়েছে। মেলা যেখানে হয়, যেখানে কোটি কোটি টাকার পণ্যের বিকিকিনি চলে তার সাথে পার্কের দর্শনার্থীদের যেনো কোন সম্পর্কই নেই। মেলার আয়োজন চলে মেলার মতো, আবার দর্শনার্থীদের ঘুরে বেড়ানোও তাদের নিজেদের মতো। ঘুরতে ঘুরতে কেউ যদি মেলা দেখতে যায় সেটা ভিন্ন কথা। অনেকগুলো পথ থাকায় যাতায়তেও কারো কোন অসুবিধা হয়না। মেলার পথে মেলা থাকে, বিনোদনের পথে থাকে বিনোদন! কী অসাধারণ সব আয়োজন! আহা, কেন যে আমাদের হয়না! কেন যে আমাদের হলো না।
জোড়ায় জোড়ায় দলে দলে নারী পুরুষ আসছিল পার্কে। শিশু কিশোরের সংখ্যাও কম নয়। এত লোক পার্কে আসছে কেন! স্বপন জানালো যে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হংকং বেড়াতে আসা পর্যটকদের সিংহভাগই এই ভিক্টোরিয়া পার্কে বেড়াতে আসে। এই যে দলে দলে মানুষ আসছে এরা হংকংয়ের বাসিন্দা নয়। চীন বা ধারে কাছের কোন দেশ থেকে বেড়ানো বা ব্যবসার কাজে হংকং এসেছে। এখন পার্ক–টার্ক ঘুরে সময় কাটাচ্ছে। হংকং সফরে এসে ভিক্টোরিয়া পার্ক ঘুরে যান না এমন একজন পর্যটকও পাওয়া যাবে না বলেও উল্লেখ করলো স্বপন।
যোগাযোগ ব্যবস্থার বহুমুখী সুবিধা এই পার্ককে হংকংয়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় পার্কে পরিণত করেছে বলেও আমার বন্ধু স্বপন জানালো। সে বললো, শহরের যে কোন জায়গা থেকে খুব সহজে এই পার্কে পৌঁছা যায়। পার্কটি শহরের অন্যান্য অঞ্চলের মতোই নিরাপদ এবং নির্ঝঞ্জাট। দারুণ পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা এবং সাগর ছুঁয়ে আসা নির্মল বাতাস পার্কটিকে আলাদা একটি মাত্রা দিয়েছে।
গণপরিবহনে হংকং বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর কাতারে অবস্থান করছে। কী যে সুন্দর এক একটি বাস। ট্রামগুলোর ডিজাইন কী!! মেট্রোর ডিজাইন এমন নজরকাড়া যে হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। এমন বাস রাস্তায় চলাচল করলে প্রাইভেট গাড়ির আর দরকারই বা কি! এমন ট্রেনে চড়তে পারলে আর টয়োটা গাড়িই বা কে চালায়! ট্রামগুলোতেও ছুটছেন হাজার হাজার মানুষ। যাদের প্রত্যেকেরই হয়তো একাধিক গাড়ি রয়েছে। স্বপন জানালো যে, হংকং এর লাখ লাখ মানুষ নিজের গাড়ি ব্যবহার না করেই পাবলিক বাসে যাতায়াত করেন। ট্রামে চড়েন, ট্রেনে চড়েন। আবার অনেকেই একটি নির্দিষ্ট স্থানে পার্কিং এ গাড়ি রেখে পাবলিক ট্রান্সপোট ধরেন। ফেরার সময় আবারো নিজের গাড়ি নিয়ে ঘরে ফিরেন। যোগাযোগের ক্ষেত্রে গত ক’দিনে দারুণ চাকচিক্যের দেখা মিলেছে। এমন চটকদার পাবলিক ট্রান্সপোর্ট থাকলে কে আর শখ করে গাড়িতে চড়ে!
ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশেই সাগর। এটি চীন সাগরেরই অংশ। একটি ব্রেকওয়াটারের মাধ্যমে সাগর থেকে পার্কটিকে সুরক্ষা দেয়া হয়েছে। ব্রেকওয়াটারের ওপারে সাগর থৈ থৈ করলেও এপারে শান্ত! আহা, একই সাগরের কত রূপ দেখা হলো!
ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে বের হয়ে আসলাম। কোন পথে কোন দিয়ে যে এমন শানদার একটি মার্কেটে এসে পৌঁছালাম তা বুঝতে বেশ সময় লাগছিল। পার্কের পাশ দিয়ে বাস এবং ট্রাম বোড। আমরা ফুটওভার ব্রিজের এঙেলেটর চড়ে পার্ক থেকে রাস্তায় এসে নামি। ওখান থেকে রাস্তা পার হয়ে বেশ শানদার একটি মার্কেটে ঢুকি। আর মার্কেটজুড়ে যেনো পণ্যের পসরা! (চলবে)।
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।