(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
রাত নেমে গেছে। বান ডাকা আলোয় রাতের চিহ্ন না থাকলেও বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না যে সন্ধ্যা গত হয়েছে বেশ আগে। পাহাড়ের চূড়ায় গড়ে তোলা বিশাল রেস্টুরেন্টটির টেবিলে টেবিলে ভোজোৎসবে মাতোয়ারা নারী পুরুষ। আমরা নাস্তা করলেও খাবারের ধরণ দেখে মনে হচ্ছিল সবাই ডিনার সারছে। আমাদের পাশের টেবিলে চারজন তরুণ তরুণী দারুণ তৃপ্তিতে অক্টোপাস খাচ্ছিল। চুরি কাঁচি নিয়ে অক্টোপাসের টানাটানিতে আমার ভিতরটা নড়াচড়া করতে শুরু করলো। বলছিলাম হংকংয়ের সর্বোচ্চ পাহাড় দ্য পিক’এর চূড়াস্থ রেস্টুরেন্টের কথা। দ্য পিক দেখতে এসে ঘুরতে ফিরতে রাত নামিয়ে নাস্তা করতে রেস্টুরেন্টে ঢুকেছি আমরা। চট্টগ্রামের কয়েক হাজার লোকের মেজবান আয়োজনে যেমন করে চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় এই রেস্টুরেন্টটির অবস্থাও তেমন। কেউ খাচ্ছে, কেউবা পিটের উপর দাঁড়িয়ে আছে। চেয়ার খালি হলে বসবে বলে! আমরা দুইটি চেয়ার দখল করে বসেছি। বসার সুযোগ পেয়েই যেনো বর্তে গেলাম আমি। অনেকক্ষণ ধরে হাঁটতে হাঁটতে পায়ের উপর কী পরিমাণ ধকল গেছে এখন চেয়ারে বসে তা যেনো টের পাচ্ছিলাম। বেশ ব্যথা করছিল। আমি পা টান টান করে ব্যথা নিরসনের কসরত করছিলাম। বেশ সময় নিয়ে খাবার খাচ্ছিলাম। ঝাল সসে মুড়িয়ে মুড়িয়ে পিৎজা এবং ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেতে দারুণ লাগছিল। বেশ আয়েশ করে খাবার শেষ করলাম।
কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে চারদিকের অবস্থা দেখছিলাম।
আমাদের টেবিলটির অবস্থান জানালার পাশে। কাচের ভিতর দিয়ে বাইরের সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। দ্য পিক চূড়ায় ঘুরছে মানুষ। কেউ কেউ হেথায় হোথায় দাঁড়িয়ে গল্প করছে। কেউবা আয়েশ করে বসে আছে। হংকং এর অন্যতম জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পর্ট হিসেবে প্রতিদিনই কয়েক হাজার মানুষ দ্য পিক পরিদর্শন করে। দিনের তুলনায় সন্ধ্যার পরে বেশি মানুষ দ্য পিক’এর চূড়ায় চড়ে বলেও ড্রাইভার জানালো। তার কথার সত্যতা যেনো চোখের সামনে দেখা যাচ্ছিল। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আসলাম। পিটের উপর মানুষ দাঁড়িয়ে থাকলে আসলে আয়েশ করে খাওয়া কিংবা বসে থাকা যায় না। তাই যতটুকু দ্রুত কফি শেষ করে সামনে পা বাড়ালাম।
রেস্টুরেন্টের বাইরে আসতেই আমার পুরো শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো। এটাকে কি রোমাঞ্চিত বলে! হয়তো বা। দ্য পিকের উপর থেকে যেদিকে চোখ যাচ্ছিল সেদিকেই বিস্ময়। হংকং এর কী অপরূপ রূপই না চারদিকে! ভিক্টোরিয়া হারবার, কাউলুনসহ নানা অঞ্চল চোখের সামনে। সবই আলোকোজ্জ্বল। ভিক্টোরিয়া হারবারে ভাসমান ইয়ট কিংবা হংকং এর রাস্তায় ছুটে চলা শত সহস্র গাড়ি. কিংবা হংকং বন্দরে নোঙর করা জাহাজ সবই যেনো আলোর দুনিয়ায় ভাসছে। রঙিন দুনিয়ার কথা শুনেছি, কিন্তু এই জগত যেনো আরো বেশি কিছু।
আরো বেশ কিছুক্ষণ থেকে চারদিকের বর্ণিল দুনিয়ায় চোখ বুললাম। মন প্রাণ ভরে দেখে নিলাম সবকিছু। দ্য পিক এর চূড়া থেকে ৩৬০ ডিগ্রিতে সবকিছু ধরা দিচ্ছিল চোখে। দূর থেকে ছিটকে ছিটকে আসা বর্ণিল আলোর ঝলক পরাণে নাচন ধরাচ্ছিল।
আলো এবং মেঘের লুকোচুরি চলছিল। সাথে ঠান্ডা একটি আবহ। মন ভরিয়ে দেয়া প্রকৃতি এবং পরিবেশ বুকের গভীরে তৃপ্তির আমেজ বুলিয়ে দিচ্ছিল। দ্য পিক থেকে রাতের হংকং না দেখে যদি ফিরে যেতাম তাহলে আমার ভ্রমণই অসম্পুর্ণ থেকে যেতো। মেঘের ভিতরে বসে হংকং শহর দেখতে যে কত মোহনীয় লাগে তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। চারদিকে আলোর বানের মাঝে একটি শহর যে রাতেও কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে তা লিখে বুঝানো অসম্ভব। দ্য পিক ছাড়া হংকং এর অন্য কোথাও থেকে এই অপরূপ সাজ দেখা সম্ভব কিনা তা আমার জানা নেই।
উদ্বিগ্ন বন্ধু ইতোমধ্যে বার কয়েক ফোন করে ফেলেছেন। রাত হয়ে যাওয়ায় চিন্তা করছিলেন তিনি। এত তাড়াতাড়ি ফেরার ইচ্ছে না থাকলেও বন্ধুর উদ্বিগ্ন কণ্ঠে আর বেশি দেরি করতে মন সায় দিল না। ড্রাইভারকে ফিরতি পথ ধরতে বললাম। ড্রাইভার মাথা নেড়ে বললো, হু, চলেন, আপনাকে এবার নাইট মার্কেট দেখাবো।
দুনিয়ার বহু জায়গায় নাইট মার্কেট দেখেছি। তবে শপিং নিয়ে বিশেষ কোন আগ্রহ না থাকায় এই নাইট মার্কেট নিয়ে আমার তেমন কোন কৌতূহল নেই। তবুও ড্রাইভার যখন হংকং এর নাইট মার্কেট এর কথা বললো, তখন চুপ করে থাকলাম। দেখতে তো অসুবিধা নেই।
ট্রাম স্টেশনের দিকে হাঁটলাম। দ্য পিকের চূড়ায় আসার সময় যেখানে ট্রাম থেকে নেমেছি ঠিক সেখান থেকেই নামার জন্যও ট্রামে চড়তে হবে। তবে উঠা–নামার পথ ভিন্ন। আয়োজনও আলাদা। কারো সাথে কারো যেনো ঠোক্কর না লাগে, কিংবা ট্রামে উঠানামা করতে যাতে সমস্যা না হয় সেজন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
ঘুরপথ মাড়িয়ে আমরা ট্রামে চড়লাম। গড়াতে শুরু করেছে ট্রাম। পাহাড়ের চূড়া থেকে নামছে নিচের দিকে। খাড়া পাহাড় থেকে নামতে গিয়ে হুড়মুড় করে নিচে পড়লে কী যে হবে!
তেমন কিছু হলো না। আয়েশি ট্রেনে চড়ে নামার মতো করে নামতে লাগলাম আমরা। মাত্র মিনিট কয়েকের মধ্যে নিচে নেমে আসলাম।
আবারো নানা ঘুরপথ মাড়িয়ে, কখনো চলন্ত সিঁড়ি আবার কখনো এ্যলিভেটরে চড়ে আমরা নিচে নেমে আসলাম। আমাকে একটি ভবনের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে ড্রাইভার গাড়ি আনতে চলে গেল। বললো, পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আসবো। আপনি এখানে দাঁড়ান। আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম। চমৎকার একটি ভবন। সামনে রাস্তা। রাস্তা এবং ভবনটির মাঝখানে উঠোনের মতো খোলা চত্বর। সেই ছোট্ট স্থানটিকেও পার্কের আদল দেয়া হয়েছে। ফুলের গাছ থেকে শুরু করে বসার জায়গা পর্যন্ত নানাভাবে সাজানো হয়েছে।
অল্পক্ষণের মধ্যে গাড়ির লাইটের সিগন্যাল পেলাম। গাড়িও চিনলাম। আমাদের দেশে হলে কষে হর্ন দেয়া হতো। কিন্তু হংকংয়ে হর্ন নেই বললেই চলে। অবশ্য বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ কয়েকটি প্রদেশে হর্ন বাজলেও দুনিয়ার আর কোথাও হর্র্ণের এমন অত্যাচার নেই। সভ্য দেশগুলোতে হর্ণ বাজানোকে অসভ্যতা ভাবা হয়। কাউকে হর্ণ বাজানো মানে তাকে গালি দেয়া হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। একেবারে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে গেলেই ছোট্ট করে হর্ন বাজিয়ে ‘গালি’ দেয়া হয়।
যাক, আমি ফ্রন্ট সিটে বসার সাথে সাথেই এক্সেলেটরে চাপ দিল ড্রাইভার। সেকেন্ডের মধ্যে স্পিডমিটারের কাটা ৬০ কিলোমিটার পার হয়ে গেলো। ছুটতে লাগলাম আমরা। ছুটছে শত শত গাড়ি। হংকংয়ের রাজপথ জুড়ে দিনের বেলা প্রচুর গাড়ি দেখেছি, এতো রাতেও এতো বেশি গাড়ি দেখে কেমন খটকা লাগলো। এখন কি অফিস ছুটি হলো? আমার প্রশ্ন শুনে ড্রাইভার হাসলো। বললো, আরে না। অফিস ছুটি হয়েছে আগে। এখন আবার হয়তো কেউ কেউ অফিসে যাচ্ছে। বহু অফিসই রাতে দিনে ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে। শিফটিং ডিউটি চলে। কোন কোন কর্মকর্তা কর্মচারী ঘরে ফিরে আবার কেউ কেউ অফিসে প্রবেশ করে। রাস্তায় সবসময় এমন চাপ থাকে বলে উল্লেখ করে ড্রাইভার বললো, তাবত বিশ্বের সাথে যোগাযোগ হংকংয়ের। তাই সকাল বিকেল অফিস শেষ করার সুযোগ এখানে নেই। এছাড়া কারখানাগুলোতে রাতে দিনে কাজ চলে। বিভিন্ন শিফট ভাগ করা থাকে। এক শিফটের লোকজন চলে গেলে অপর শিফট কাজ শুরু করে। এভাবে পাগলের মতো কাজ করে বলেই হংকং বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম মাতব্বর হয়ে উঠতে পেরেছে বলেও মন্তব্য করলো সে। আমার বন্ধুর ড্রাইভার মোটামুটি শিক্ষিত। তাই হংকংয়ের বহু কিছু সে গত বছর কয়েকে ঠিকঠাকভাবে রপ্ত করতে পেরেছে। গাড়ি ছুটছিল, সামনে পেছনে প্রচুর গাড়ি নিয়ে যেনো অচিন এক কাফেলার সাথী হয়ে পথ চলছি আমরা। (চলবে)।
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।