(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সাঁই সাঁই করে ছুটছে গাড়ি। লেটেস্ট মডেলের সব গাড়ি হংকংয়ের রাস্তায়। জাপান চীন এবং ব্রিটিশ গাড়িতে ভরপুর শহরের অলিগলি রাজপথ। আমি গল্প করতে করতে এদিও–ওদিকের চোখ ধাঁধানো সব কাজকারবার দেখছিলাম। চোখ জুড়িয়ে যাওয়া সৌন্দর্য হংকংয়ের পরতে পরতে। মুগ্ধ হওয়ার নানা উপকরণ চারপাশে। রাস্তায় পথচারী তেমন একটি নেই। সবাই গাড়ি নিয়ে ছুটছে। তবে প্রচুর সাইকেলও দেখা যাচ্ছে। নারী পুরুষ সমানতালে সাইকেল চালাচ্ছে। রয়েছে স্কুটি এবং বাইকও। যারা সাইকেল নিয়ে ছুটছে তাদের ঘরেও নাকি দু’চারটি গাড়ি রয়েছে। এদের অনেকেই স্বাস্থ্য চর্চা কিংবা ধারে কাছের কাজ সারতে সাইকেল নিয়ে রাস্তায় নামে। ট্রাফিক সিগন্যালগুলোতে কোন পুলিশের দেখা নেই। সবগুলোতেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে লাল. হলুদ এবং সবুজ বাতি জ্বলছে। জেব্রা ক্রসিং এ মানুষ পারাপারের জন্যও সময় সেট করে দেয়া হয়েছে। তবে সবচেয়ে সুন্দর দেখা গেলো ফুটপাত। কী অসাধারণ ফুটপাত রাস্তার পাশে। টাইলস করা, চওড়া। কিন্তু কোথাও একটিও দোকান দেখা গেলো না। দেখলাম না কোন হকারের পসরা।
এতে করে রাস্তায় প্রচুর গাড়ি চললেও যানজট দেখলাম না। সিগন্যালগুলোতে লম্বা লাইন হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সবুজ বাতি জ্বলার সাথে সাথে গতি পাচ্ছে।
বিশাল চওড়া রাস্তা ধরে ছুটছে আমাদের গাড়ি। কোথাও পাহাড়ি পথ, কোথাওবা টানেল পার হয়ে ছুটছিলাম আমরা। গন্তব্য বন্ধুর অফিস। অফিসটি বাসা থেকে বেশ দূরে, হংকং–এর ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকায় বলেও জানাতে পারলাম। আমি মনে মনে বললাম. যত দূরে হয় ততই ভালো। দেখে দেখে যেতে পারবো। কাছে হলে তো এখনি দেখাদেখি ফুরিয়ে যাবে। গাড়ি চলছিল। আমি জানালায় চোখ রেখে দেখছিলাম সবকিছু। আকাশ দেখা যাচ্ছিল না সুউচ্চ ভবনের জন্য। কতগুলো একশ’ তলা ভবন রয়েছে দেশটিতে! দূরে সাগর দেখা যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে বন্দর। একটি বেশ উঁচু সেতুও দেখলাম দূর থেকে। ঝুলন্ত সেতু বলে মনে হচ্ছিল। সাগরে এবং বন্দরে অগুনতি জাহাজ সাগরে নোঙর করে আছে। যে বন্দর হংকং–এর সমৃদ্ধিতে অনেক বড় এবং অনেকটা একক ভূমিকা রেখেছে!
ভিক্টোরিয়া এলাকায় একটি ভবনের কয়েকতলা পর্যন্ত উপরে উঠে গেলাম আমরা। গাড়িসহ। ভবনটির নিচের দিকে বেশ কয়েক ফ্লোর পার্কিং। বেইজমেন্টও আছে নাকি তিন তলা। সবগুলো পার্কিং। ভবনে ভবনে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা থাকায় রাস্তায় জটলা হয়না। গাড়ি থেকে নেমেই লিফট পেলাম। আমার বন্ধু ৫৭ তলার বোতাম চাপলেন। ৫৭ তলায় অফিস!
কানে কী একটু চাপ লাগলো। ৫৭ তলা মানে প্রায় ৫৭০ ফুট উঁচু। ছোটখাটো একটি পাহাড়ের উচ্চতায় উঠে গেলাম মাত্র মিনিট খানেকে। বেশ গতি দেখা গেলো লিফটে। উন্নত দেশের লিফটও উন্নত!
অফিসের সামনে কোন পিয়ন দারোয়ান নেই। আমার বন্ধুর আঙ্গুলের ছোঁয়ায় দরোজাটি স্বয়ংক্রীয়ভাবে খুলে গেলো। অফিসটি তেমন বড় নয়, কিন্তু ছিমছাম। মেইন দরোজা খুলে ঢুকতেই একটি বড়সড় রুম। সেখানে ৭/৮টি ডেস্ক। হলরুমের মতো রুমটির পাশেই পাশাপাশি দুইটি রুম। একটি আমার বন্ধুর রুম, অপরটি ম্যানেজারের। অফিসে বাঙালী এবং হংকং এর লোকজন কাজ করছে। গার্মেন্টস এক্সেসরিজ সাপ্লাই দেয়ার ব্যবসা। বাংলাদেশ এবং ভিয়েতনামে গার্মেন্টসের কাঁচামাল সরবরাহ দেয়া হয়। অর্ডার নেয়া থেকে শুরু করে ব্যবসা বাণিজ্যের সবই চলে এই অফিস থেকে, তবে পণ্য উৎপাদন থেকে সরবরাহ দেয়া হয় চীন থেকে। হংকংয়ে পণ্য উৎপাদন খরচ অনেক বেশি হওয়ায় চীন থেকেই পণ্য সরবরাহ দেয়া হয়। তাবত দুনিয়ার শত শত ব্যবসায়ী এভাবে হংকংয়ে বসে ব্যবসা করছেন বলেও আমার বন্ধু জানালেন।
কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে আমি নানা প্রশ্ন করছিলাম। ল্যাপটপে কাজ করতে করতে উত্তর দিচ্ছিলেন আমার বন্ধু। জেলে পল্লী এবং দুস্থ মানুষের বসবাসের জায়গা থেকে আজকের হংকং হয়ে উঠার কাহিনী বেশ অভিনব।
হংকংয়ের বিবর্তনের যাত্রা বেশি দিনের নয়। ৫০ এর দশকে চীনের মূল ভুখন্ডের সাংহাই থেকে বিপুল সংখ্যক শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল হংকংয়ে। আসার সময় তারা তাদের প্রচুর পুঁজি এবং মেধা নিয়ে এসেছিল সাথে করে। শরণার্থীদের মেধা ও পুঁজিই মুলত হংকংয়ের অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে দিতে শুরু করে। ওই সময় প্রচুর বিদেশী কোম্পানি সাংহাই থেকে অফিস নিয়ে আসে হংকংয়ে। তারা আড়তদারি থেকে হংকংকে একটি উৎপাদনমুখী শহরে পরিণত করে। ছোটখাটো শিল্প কারখানা স্থাপন করে তারা নানা ধরনের কর্মকান্ড শুরু করে, পুঁজি বিনিয়োগ করে। মুলত সাংহাই থেকে আসা পুঁজিতেই হংকংয়ের জয়যাত্রা শুরু হয়। একসময় হংকংকে মিনি সাংহাই নামেও অভিহিত করা হয়। হংকংয়ের বিবর্তনে চীন থেকে প্রচুর অভিভাসি এসে যুক্ত হয় এই কর্মকাফেলায়। মাত্র বছর দশেকের মাথায় ৬০ এর দশকে এসে হংকং একটি কর্মমুখর জনপদে পরিণত হয়। ৬০ এর দশককে হংকংয়ের টার্নিং পয়েন্ট বলেও বিবেচনা করা হয়। এই সময় হংকংয়ে স্থানাভাব প্রকট হয়ে উঠে। আবাসন খাতেও প্রচুর বিনিয়োগ ঘটতে থাকে। পরবর্তী বছরগুলোতে হংকং কেবলই উন্নতি করেছে। জনসংখ্যার বাড়তি চাপ এবং আবাসন সংকট ঘুচাতে হংকংয়ে বহুতল ভবন নির্মাণের উপর সরকারিভাবে জোর দেয়া হয়। যার জের ধরে শত শত আকাশছোঁয়া ভবন তৈরি হয়েছে। যার একটিতে বসে রয়েছি আমরা।
আমার বন্ধুর রুমটি খুবই সুন্দর। বিশাল একটি সিক্রেটারিয়েট টেবিল, রিভলভিং চেয়ার, টেবিলের বিপরীত পাশে দুইটি হাতওয়ালা চেয়ার। এর পেছনে দুইসিটের একটি সোফা, টি–টেবল। রুমের এক কর্নারে একটি শোকেজ। যাতে কিছু গার্মেন্টস পণ্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে। দেয়ালে চমৎকার একটি পেইন্টিং। জানালায় ভারি পর্দা। রিভলভিং চেয়ারের পেছনের দেয়ালটি পুরোটাই কাচের। পর্দা সরাতেই কলকল করে উঠলো হংকং শহর। দূরের সাগরও যেনো হাতছানি দিতে লাগলো। সাগরের ভাসমান জাহাজগুলো ৫৭ তলার উপর থেকে আরো যেনো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। দূরের ব্রিজটিকে মনে হচ্ছিল হাত বাড়ালেই ধরা যাবে। একটি ব্রিজও যে এতো ‘ডাকে’ তা যেনো প্রথম টের পেলাম। কথাটি বলতেই আমার বন্ধু ল্যাপটপ বন্ধ করলেন। বললেন, চলুন, আপনাকে নিয়ে কিছুক্ষণ ঘুরে টুরে বাসায় চলে যাবো।
আমি তো নাচুনে বুড়ি, ঢোলের বাড়ি পেলে তর সামলানো কঠিন। তাই সাথে সাথেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। বন্ধু বললেন, আরেক কাপ কফি খেয়ে নিন। ভালো লাগবে।
গাড়ি ছুটছিল। বাঙালী ড্রাইভার বেশ রপ্ত করেছে হংকংয়ের অলি গলি রাজপথ। কোন ধরনের ডিরেকশন ছাড়াই সে গাড়ি চালাচ্ছিল। গাড়িতে উঠার পর আমার বন্ধু শুধু কি একটা জায়গার নাম যেনো বলে দিয়েছিলেন।
বিশাল চওড়া একটি রাস্তা ধরে ছুটছিলাম আমরা। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর সেতুটি চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আগেই বলেছি বিশাল সেতু। এখন মনে হচ্ছে দূর থেকে যত বিশাল মনে হয়েছে এটি যেনো তার চেয়ে বিশাল। হংকং দ্বীপের সাথে বিমানবন্দরমুখী রাস্তায় পড়া অপর একটি দ্বীপকে যুক্ত করতেই নদীর বুকে নির্মাণ করা হয় সেতুটি। মুলত দুইটি দ্বীপের মাঝে সৃষ্ট একটি চ্যানেলকে এই সেতুটি যুক্ত করেছে। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।