(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
থালার পিঠের মতো মসৃণ রাস্তা, ছয় লেনের। প্রশস্ত সড়ক ধরে ছুটছে শত সহস্র গাড়ি। নামি দামী মডেলের গাড়িগুলো কেবলই ছুটছে। হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শহরের দিকে ছুটছি আমরা। চারপাশের পরিবেশ এবং আবহ দেখে বুঝতে বাকি থাকলো না যে, আমরা শহরে ঢুকে গেছি। সুউচ্চ সব ভবন গর্বিত তরুণীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। হাত বাড়ালেই টাওয়ার, পা বাড়ালেই টাওয়ার। চারদিকে কেবল টাওয়ার আর টাওয়ার। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল টাওয়ারগুলো একটির সাথে অপরটি তীব্র প্রতিযোগিতা করছে। উচ্চতার প্রতিযোগিতা! এত বেশি সুউচ্চ টাওয়ার হংকং এ রয়েছে যে চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না যে ছোট্ট হংকং জুড়ে শত শত একশ’ তলার টাওয়ার রয়েছে। যেদিকে চোখ যাচ্ছিল সেদিকেই টাওয়ার, সেদিকে আকাশ ফুটো করে ফেলার আনজাম! পঞ্চাশ ষাট তলা উচ্চতার ভবন রয়েছে অগুনতি। পাঁচ সাততলা উচ্চতার কোন ভবনই চোখে পড়লো না শহরটিতে। ভূমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে যতটুকু উপরে উঠা যায় সবাই যেনো সেই সংগ্রাম করছে। আমার মনে হলো উঁচু উঁচু ভবন নির্মাণ করে হংকং এর আয়তনের চেয়ে বহু বেশি আয়তনের ফ্লোর স্পেস ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। অনেকগুলো ভবনের চূড়া দেখা যাচ্ছিল না। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে, ওসব ভবনের চূড়া মেঘের ভিতরে ঢুকে রয়েছে। মেঘের জন্য ভবনের উপরের অংশ দেখা যাচ্ছে না। মেঘের ভিতরে বসবাস!! দারুণ তো!
আর এভাবে বহুতল ভবন নির্মাণ যদি করা সম্ভব না হতো তাহলে হংকং বসবাসের যোগ্যতা হারাতো বহু আগে। আগেই বলেছি হংকং ছোট্ট একটি দেশ। দক্ষিণ চীন সাগরের বেশ কিছু দ্বীপ জোড়াতালি দিয়ে গড়ে উঠা একটি জনপদ। মাত্র ১১শ’ বর্গ কিলোমিটার আয়তন। চট্টগ্রামের এক পঞ্চমাংশ মাত্র, পাঁচ ভাগের একভাগ! লোকসংখ্যা প্রায় এক কোটি। এরমধ্যে নদী খাল বিল রয়েছে। পাহাড় পর্বতও কম নয়। সাগর, পাহাড়, নদী এবং খাল–বিল বাদ দিয়ে এক কোটি মানুষের বসবাসের জন্য যে চট্টগ্রাম জেলার এক পঞ্চমাংশ আয়তনের যে জায়গাটি রয়েছে তা খুবই কম, একেবারে অপ্রতুল। এতে করে বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোর মধ্যে হংকং অন্যতম। মানুষের মাথা মানুষে খাওয়ার মতো অবস্থা! কিন্তু বিপুল আর্থিক সমৃদ্ধি এবং মজবুত অর্থনীতি দেশটিকে ভয়াবহ অবস্থা থেকে আগলে রেখেছে। মানুষের মাথা মানুষে খাওয়ার অবস্থা বলতে যা বুঝায় হংকং এ তা হয়নি, আর্থিক সামর্থ্য দেশের প্রতিটি মানুষকে ভিন্নমাত্রার সক্ষমতা দিয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে দেশটি যদি আমাদের মতো হতো, তাহলে বহু আগেই মানবিক বিপর্যয় ঘটতো। বিশ্বের রসাতলে যাওয়া একটি দেশের তালিকায় হংকং এর নাম থাকতো সবার উপরে। অথচ দেশটি শুধু সমৃদ্ধই নয়, বিশ্বের অন্যতম ধনী এবং শান্তির দেশ হিসেবেও নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে।
ভীষণ ট্রাফিক। প্রচুর গাড়ি ছুটছে রাস্তায়। কিন্তু শত সহস্র গাড়িতে রাস্তাজুড়ে যে বেহাল অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল তা কোথাও চোখে পড়ছে না। কোন যানজট নেই, স্থবির হয়ে রয়েছে এমন একটি মোড়ও দেখলাম না। সবগুলো গাড়ি ছুটছে। দ্রুত গতিতে এগুচ্ছে সামনে। অবশ্য রিঙা বা ঠেলা গাড়ির মতো স্বল্পগতির কোন গাড়ি দেখা গেলো না। গতির সাথে গতিহীনতা যে দুর্গতি সৃষ্টি করে তার বাড় প্রমাণ বাংলাদেশ। ঢাকা চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহরগুলো থেকে স্বল্পগতির গাড়িগুলোকে তুলে দেয়া সম্ভব হলে সার্বিক গতিশীলতায় বড় ধরণের পরিবর্তন আসতো। হংকং এ ফুটপাত এবং রাজপথ দখল করে ভ্যানে ভ্যানে পণ্যের পসরাও দেখা গেলো না। মোড়ে মোড়ে রিক্সা টেক্সি কিংবা শহর এলাকার বাসের যে অত্যাচার তার ছিটেফোঁটাও নেই। সবকিছু মিলে আমরা মোড়কেন্দ্রিক যানজটের যে ভয়াবহতার মুখোমুখি হই হংকং এ তা দেখা গেলো না। এতে করে রাস্তায় স্বস্তির সাথে গাড়ি চলছিল, অন্যভাবে বললে চলতে পারছিল।
গাড়ি ছুটছে। গতিও দারুণ। ট্রাফিক সিগন্যালগুলোতে লাল সবুজ বাতি জ্বলছে। লালে গাড়ি থামছে, সবুজে এগুচ্ছে। মানুষ পারাপারেরও সময় দেয়া হচ্ছে। সবকিছুই ঘটছে লাইটে, সিগন্যালে। হাত উঁচিয়ে কেউ কাউকে থামানোর চেষ্টা করছে না, চিৎকার শোরগোলও নেই। স্বয়ংক্রীয়ভাবে চলছে ট্রাফিক সিগন্যালিং সিস্টেম। আমি চোখ বুলিয়ে পুলিশ দেখা যায় কিনা খোঁজ করলাম। না, কোথাও চোখে পড়লো না। অবশ্য, আমার গাড়ির চালক বললেন ধারে কাছেই পুলিশ রয়েছে। আইন লংঘন করার সাথে সাথে পুলিশ হাজির হবে। আবার ক্যামেরা দিয়েও নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। আপনি সিগন্যাল না মেনে চলে গেলেন। কিন্তু ঠিকই পুলিশ আপনার নামে কেস স্লিপ পাঠিয়ে দেবে। কোথায়, কতক্ষনে আপনি ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করেছেন তা উল্লেখ করে আপনাকে কোর্টে হাজির হতে বলবে। অস্বীকার করার সুযোগ নেই বলে উল্লেখ করে চালক জানালেন যে, কোন শার্ট পরে আপনি কোন গাড়ি চালাচ্ছিলেন তার ছবিসহ বিস্তারিত তারা দিয়ে দেবে। আদালত আপনাকে জরিমানা করবে, লাইসেন্সের পয়েন্ট কেটে নেবে। একইভাবে বার বার অঘটন ঘটালে লাইসেন্সই বাতিল করে দেবে। প্রতিটি রাস্তায় শত শত ক্যামেরা, ক্যামেরার চোখ দিয়ে পুলিশ শহর দেখে। শুধু রাজপথই নয়, শহরের গুরুত্বপূর্ণ নানাস্থানও পুলিশের নখদর্পণে!
কিছু কিছু জায়গায় প্রচুর মানুষ দেখা গেলো। রাস্তা ধরে ছুটছে বহু নারী পুরুষ ও শিশু কিশোর। গাড়ি যেমন গিজগিজ করছে, তেমনি মানুষও। তবে কোথাও বিশৃংখলা চোখে পড়ছিল না। মানুষগুলো ছুটছে, হাঁটার মধ্যেও ইউরোপের মতো ছুটে চলার প্রবণতা রয়েছে। আমাদের মতো আয়েশী ভাব নেই তাদের হাঁটা–চলায়। কেন যে তারা এতো ছোটাছুটি করে কে জানে!
হংকং শহরের রাজপথ ধরে ছুটছি আমরা। আমাদের সাথে একইভাবে ছুটছে আরো শত শত গাড়ি। ওয়ানওয়ে সড়ক, মুখোমুখি সংঘর্ষের কোন শংকা নেই। তবুও নিয়ন্ত্রিত এবং অনুমোদিত গতিতেই গাড়িগুলো ছুটছে। রাস্তাগুলোও দেখার মতো। কুচকুচে কালো, পিচ ঢালা। আগেই বলেছি যে, থালার পিঠের মতো, একেবারে মসৃণ। এমন রাস্তায় গতির ঝড় উঠে, কিন্তু আমাদের চালক আশি’ কিলোমিটারের বেশি স্পিড তুলছিলেন না। আমি কিছু না বলে চালকের পাশে বসে শহর দেখছিলাম।
শহরের নানা পথ মাড়িয়ে আমরা ছুটছি। বন্ধুর বাসার দিকে যাচ্ছি আমরা। অনেকক্ষণ ধরে শহরের নানা পথে ছুটছে আমাদের গাড়ি। শুধু রাস্তার উপর দিয়ে নয়, কখনো নদীর উপর, কখনোবা খালের উপর দিয়েও ছুটছিলাম আমরা। কোন নদীতে ব্রিজ, কোনটিতে টানেল তৈরি করা হয়েছে। ছোট বড় অনেকগুলো দ্বীপ নিয়ে গড়ে উঠা হংকং–এ অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ রয়েছে। তবে বেশ কিছু দ্বীপের একটির সাথে অপরটির সংযোগ ঘটানো হয়েছে ব্রিজ কিংবা টানেলের মাধ্যমে। ব্রিজগুলোও দেখার মতো। সুন্দর। একটি ব্রিজ দেখলাম বেশ বড়। যেনো বিশাল এক নদীর এপাড় ওপাড় সংযোগ ঘটানো হয়েছে। ঝুলন্ত ব্রিজ। আহা, কর্ণফুলীর উপর একটি ঝুলন্ত ব্রিজ করার কত আন্দোলন হলো। কিন্তু ব্রিজ হলো না। আন্দোলনকারীদের বুঝ দেয়ার জন্য পিলারের ব্রিজের উপর ঝুলন্ত ব্রিজের আদলে রশি টাঙ্গিয়ে দেয়া হলো। কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতুর পিলারের কারণে ইতোমধ্যে নদীর বেশ বড় একটি অংশ ভরাট হয়ে গেছে, চর জেগেছে। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বন্দরে। দেশের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দরের এক এবং দুই নম্বর জেটি এলাকায় ভরাট হয়ে গেছে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই দুইটি জেটিতে এখন আর সমুদ্রগামী জাহাজ ভিড়ানো সম্ভব হয়না। বন্দরের তালিকা থেকেও এক নম্বর জেটি বাতিল করে দেয়া হয়েছে। অথচ ঝুলন্ত ব্রিজ করলে এই দুর্দশা হতো না বলেও বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। হংকং–এ বেশ কয়েকটি টানেল রয়েছে। একটি দ্বীপের সাথে অপর দ্বীপের সংযোগ ঘটেছে টানেলে মাধ্যমে। কত টানেল আছে তাদের কে জানে! ইতোমধ্যে আমরা মনে হয় দুইটি টানেল পার হলাম। একটিকে বেশ দীর্ঘ মনে হলো! টানেলের ভিতরে কী যে সুন্দর!! উপরে জাহাজ ভাসছে, নৌকা চলছে। রয়েছে মাছের রাজত্ব। আর নদীর একেবারে তলদেশ দিয়ে ছুটছে যানবাহন। নদীর কত নিচ দিয়ে এই টানেল বয়ে গেছে কে জানে! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।