(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আমি এগিয়ে গেলাম। হাসিমুখে সামনে এগুলাম। বিদেশ বিভুইয়ে এমন নির্ভার হয়ে পথ চলায় অন্যরকমের আনন্দ আছে। বিশেষ করে অচিন নগরীতে একজন চেনা মানুষ অনেক বড় সহায় হয়ে ওঠে। এখানে তো শুধু চেনা মানুষই নয়, একজন পাক্কা ড্রাইভার। পথ ঘাট যার নখদর্পনে। আরো বড় ব্যাপার হচ্ছে সেই চেনা মানুষটির সাথে আস্ত একটি গাড়িও আছে। যে গাড়িতে যাত্রী হিসেবে কেবল আমিই থাকবো। সবকিছু মিলে সোনায় সোহাগা মনে হয় একেই বলে!
হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এক্সিট ডোরের সামনের ব্যারিয়ার পার হতেই সাইফুল আমার ট্রলিটি টেনে নিল। সৌজন্যতা দেখাতে আমি ‘লাগবে না’ ‘লাগবে না’ বললেও সে জোর করে ট্রলির নিয়ন্ত্রণ নিল। ট্রলিতে আমার লাগেজ এবং কেবিনব্যাগ দুটোই একটির সাথে অপরটি জড়াজড়ি করে রয়েছে। এখন ঝাড়া হাত–পা নিয়ে হাঁটছিলাম আমি। ড্রাইভার জানালো, ‘গাড়ি একটু দূরে আছে। কষ্ট করে একটু হেঁটে যেতে হবে।’ মনে মনে বললাম, কষ্ট কোন ছার! এই যে আস্ত একটি গাড়ি আমার জন্য এসে দাঁড়িয়ে আছে সেটিই বরং বড় ব্যাপার। এই গাড়ি না থাকলে কিংবা ড্রাইভার না হলে আমাকে টেক্সি নিয়ে খুঁজে খুঁজে হোটেল ধরতে হতো। ড্রাইভার বললো, হংকং এ প্রচুর গাড়ি। কিন্তু ট্রাফিক আইনের বেজায় কড়াকড়ি। ইচ্ছে করলে যে কেউ আমাদের দেশের মতো আইন লংঘন করতে পারে না। আপনি মন্ত্রী হলেও আইন মেনে গাড়ি চালাতে হয়। ট্রাফিক আইন না মানার কোন সুযোগই হংকং এর অলি গলি কিংবা রাজপথে নেই। সেটি হোক এয়ারপোর্ট কিংবা মার্কেট,সর্বত্রই আইনের জয়–জয়কার!
এয়ারপোর্টের পার্কিং এরিয়াতে শত শত গাড়ি। ঠিক কোনটিতে যে আমাকে উঠতে হবে কে জানে! ড্রাইভার আমার ট্রলি ঠেলে ঠুলে সামনে এগুচ্ছে, আমি পেছনে পেছনে হাঁটছি। একেবারে লেটেস্ট মডেলের একটি প্রাডোর পাশে থামলো সাইফুল। ট্রলি থেকে আমার লাগেজ এবং কেবিনব্যাগ গাড়িতে সামলে নিল। আমাকে বসতে বলে সে খালি ট্রলিটি ঠেলে নির্দিষ্ট স্থানে রেখে আসলো। এখানেও আইন মানার একটি প্রবণতা টের পেলাম।
ছুটছিল আমার বাহন। গতির ঝড় তুলে এগুচ্ছিল সামনে। বিমানবন্দর থেকে শহরের দিকে ছুটছি আমরা। পৃথিবীর সবদেশেই বিমানবন্দর থেকে শহর দূরেই হয়। হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও শহর থেকে বেশ দূরে। সাইফুল জানালো, বিমানবন্দর থেকে শহরের দূরত্ব ৩৫ কিলোমিটার। এখানে ছোট্ট যে দ্বীপটিতে বিমানবন্দর গড়ে তোলা হয়েছে সেটি থেকে মুল শহর এতো দূরে হলেও যোগাযোগ ব্যবস্থার গতিশীলতা সেই দূরকে কাছে নিয়ে এসেছে। এখান থেকে শহরে যাওয়ার নানা পথ এবং পন্থা রয়েছে।
অবশ্য আমি পরে জেনেছিলাম যে, হংকং বিমানবন্দর দূরে হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল সুউচ্চ সব ভবন এবং পাহাড়। উঁচু ভবন এবং পাহাড়ের জন্য বিমান চলাচলে ঝুঁকি তৈরি হয়। তাই হংকং এয়ারপোর্ট শহর থেকে দূরে তৈরি করতে হয়েছে। হংকং শহরে এত বেশি উঁচু ভবন যে শহরের কাছে বিমানবন্দর করার কোন সুযোগই নেই। ৩৪/৩৫ হাজার ফুট উপর থেকে নেমে আসা বিমানগুলোকে এয়ারপোর্টের একটি নির্দিষ্ট দূরুত্বে পৌঁছার পর নিচের দিকে নেমে আসতে হয়। হংকং শহরে বড় বড় ভবন এবং বেশ কিছু পাহাড়ের জন্য ‘এই নির্দিষ্ট দূরত্ব’ রক্ষা করে বিমানকে ঠিকঠাকভাবে নামানো বেশ কঠিন। তাই শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে একটি দ্বীপের বুকে এয়ারপোর্ট নির্মাণ করে এই নিচে নামার গাণিতিক হিসেব রক্ষা করতে হয়েছে। এরপরও হংকং বিমানবন্দর পৃথিবীর হাতেগোনা কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ বিমানবন্দরের একটি। এই বিমানবন্দরে অবতরণ করতে পাইলটদের দক্ষতা লাগে। সেই ঝুঁকিপূর্ণ বিমানবন্দরে ভালোয় ভালোয় নেমে রাজকীয় এক গাড়িতে চড়ে শহরের পথে ছুটছি। নিজেকে কিছুটা ভাগ্যবান না ভেবে উপায় নেই বলেও মনে হচ্ছিল আমার।
বিমান থেকে নদী দেখেছিলাম। দেখেছিলাম হংকং পোর্টও। অসংখ্য জাহাজ সাগরে ভাসতে দেখেছি, দেখেছি সারি সারি কী গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ বন্দরের লাখো কন্টেনার। পৃথিবীর ব্যবসা বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠা হংকং বন্দর পৃথিবীর ব্যস্ততম প্রথম দশটি বন্দরের একটি। দৈনিক আজাদীর শিপিং নিউজ কাভার করার সুবাদে হংকং বন্দর সম্পর্কে টুকটাক কিছু তথ্য আমার জানা আছে। দক্ষিণ চীন সাগরে অবস্থিত এটি এমন একটি বন্দর যেটি বছরে পাঁচ লাখেরও বেশি জাহাজ হ্যান্ডলিং করে। এসব জাহাজে কয়েক কোটি কন্টেনার থাকে। মাত্র দশ ঘন্টায় একটি জাহাজ হ্যান্ডলিং করে এই বন্দর। এটি সক্ষমতা বিশ্বের শিপিং সেক্টরকে বহু আগ থেকে তাক লাগিয়ে আসছে। বন্দরটিতে অভাব নেই জাহাজের, ইকুইপমেন্টের। বিমান থেকে ভালোমতো দেখতে না পারলেও হংকং বন্দরের জৌলুশ বেশ বুঝতে পারছিলাম। এক পর্যায়ে মনে হচ্ছিল বিমানটি বুঝি নদীতে পড়ে যাচ্ছে, অথচ এখন বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে সুউচ্চ পাহাড় সারি নজর কাড়ছে।
বিমান মাটির কাছাকাছি আসার পর থেকে ঘোরলাগা চোখে সবকিছু দেখছিলাম। কখনো নদী, কখনো বন্দর, কখনো জাহাজ কখনো বা কন্টেনারের সারি দেখে অবতরণের পর দুর্দান্ত একটি টার্মিনাল ভবনও মুগ্ধ করেছিল। বিমানবন্দরের পরতে পরতে এত মুগ্ধতা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে যে খোলা চোখেও তা দেখা যাচ্ছিল। বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার পর চারপাশের প্রকৃতি যেনো কলকল করছিল। দারুণ উজ্জ্বল একটি দিন। অসাধারণ প্রকৃতি, পরিবেশ এবং প্রতিবেশ। চমৎকার রাস্তা ধরে এগুচ্ছি আমরা।
আগেই বলেছি যে, বিমানবন্দর থেকে হংকং শহরের দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। এই পথ এক্সপ্রেসওয়ে পাশাপাশি সাধারণ রাস্তা ধরেও যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। রয়েছে ট্রেন সার্ভিস। এক্সপ্রেস ট্রেন মাত্র ২৪ মিনিটে ৩৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে শহরে পৌঁছে দেয়। এছাড়া বাস রয়েছে, রয়েছে টেক্সিও। এছাড়া ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়েও হরদম মানুষ আসা যাওয়া করছে।
আমার বন্ধুর সাথে ফোনে কথা হলো। আমি হোটেলের কথা বলতেই উনি বললেন, আগে বাসায় চলে আসুন। ফ্রেশ হোন। খাওয়া দাওয়া করুন। পরে হোটেল দেখা যাবে। আমি হোটেলে লাগেজ রেখে আসতে চাইলে বন্ধু বললেন, আগে বাসায় চলে আসুন। লাগেজ তো সমস্যা নয়। গাড়ি তো রয়েছে।
আমার বন্ধুভাগ্য বরাবরই হিংসে করার মতো। পৃথিবীর দেশে দেশে এতোবেশি বন্ধু বান্ধবের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা অকাতরে পেয়েছি যে, একজীবনে সেই ঋণ শোধ হবে না। কত ঘরে যে পাত পেতেছি, কত ঘরেই যে ভালোবাসার মাখামাখিতে ব্রেকফাস্ট থেকে শুরু করে নিশুতি রাতে চা কফিও খেয়েছি। মাঝের লাঞ্চ ডিনার তো দিব্যি চলে গেছে। হংকং শহরেও কত ঘরে আমার খাবার ছিটিয়ে দেয়া হয়েছে তা কেবল বিধাতাই জানে!
গাড়ি ছুটছে। ৩৫ কিলোমিটার পথের এই যাত্রা এতোক্ষণে শেষ হয়ে যেতো। কিন্তু আমার অনুরোধে সাইফুল এক্সপ্রেসওয়েতে না গিয়ে সাধারণ রোডে ছুটছে। আমি হংকং এর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা দেখার জন্য এক্সপ্রেসওয়েতে চড়তে না করেছিলাম। ড্রাইভার বলেছিলাম তাহলে বেশি সময় লাগবে। এক দেড়ঘন্টা লেগে যেতে পারে। তাড়া তো নেই, বেড়াতে এসেছি। সুতরাং সময়ের কোন অভাব নেই। একুট ঘুরিয়ে টুরিয়ে নিয়ে যান।
শত শত গাড়ি রাস্তায়। দারুণ সব গতিতে এগুচ্ছে। লেটেস্ট মডেলের এক একটি গাড়ি চকচক করছে। গাড়িগুলোতে সুখী সুখী মানুষ! ফ্রন্ট সিটে বসেছি। এতে করে বাইরের সবকিছুই বেশ ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম।
দূরের সউচ্চ পাহাড়গুলোতে সবুজের হাতছানি। পাহাড়গুলোকে এত সবুজ লাগছিল যে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিল। চারপাশের কোন কিছুই আমাদের এ পোড়াদেশের মতো না হলেও সবুজে ঢেকে থাকা পাহাড়গুলো আমাদের মতো লাগছিল।
বিমান থেকে মনে হয়েছে হংকং পানিতে ভাসছে। আর এখন মনে হচ্ছে পুরো হংকং পাহাড়ের পাদদেশে বসে আছে। আবার সুউচ্চ এক একটি ভবন দেখে মাথা ঘোরানো শুরু হয়েছে। আসলে হংকং যে কোথায় চলে গেছে তা ঠিকভাবে ঠাহর করতে বেশ সময় লাগছিল। কয়েকশ’ দ্বীপের সমন্বয়ে গড়ে উঠা পৃথিবীর অন্যতম ছোট্ট একটি দেশ হংকং টানেল এবং সেতুর মাধ্যমে নিজেদের দারুণ এক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। চীনবিরোধী অবস্থানের কারণে হংকং আমেরিকার নেকনজরে রয়েছে। ফলে দেশটির উন্নয়নে আমেরিকান বলয়ের বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে। একটি সমৃদ্ধ এবং পর্যটন নির্ভর নৌপথের মাধ্যমেও হংকং দ্বীপ থেকে দ্বীপে যাতায়াতের ব্যবস্থা রয়েছে। শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া এক একটি নদী খাল ছোট্ট দেশটিকে কতভাবে যে বিভক্ত করেছে! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।