(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
কফির কাপে আয়েশি চুমুক দিচ্ছিলাম। ছোট্ট কাপ, দ্রুত ফুরিয়ে যায়। এতে কফির তৃপ্তিটা ঠিকভাবে পাওয়া যায় না। কাপটি একটু বড় হলে ভালো হতো। আসলে কফি খেতে হয় মগভর্তি করে, রয়ে সয়ে। আমি জানালায় চোখ রাখলাম। মেঘের উপর দিয়ে উড়ছি আমরা। নিচে অনেক কিছু দেখা যাচ্ছে, কিন্তু কোনটিই স্পষ্ট নয়। আরো কিছুক্ষণ উড়ার পর বুঝতে পারলাম যে বিমান নামতে শুরু করেছে। ব্যাংককের সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামতে যাচ্ছি আমরা। নিচের দৃশ্যগুলো এখন যেনো ঝকমক করছে। আলোকোজ্জ্বল দিন। সকাল এগারটা নাগাদ ভর যৌবনে সূর্য। নিচের প্রতিটি জিনিসই যেনো সূর্যের যৌবনে উদ্ভাসিত। ধানের ক্ষেত, ফসলের মাঠ, মানুষের বাড়িঘর, পুকুর দীঘি, খাল বিল সবই বেশ স্পষ্ট। অপরূপ প্রকৃতি চোখের সামনে। কয়েকশ’ ফুট নিচে। বত্রিশ হাজার ফুট উপর থেকে ক্রমান্বয়ে নামতে নামতে বিমানটি তখন মাটির কাছাকাছিতে উড়ছিল। আহা, সবকিছুকেই বুঝি মাটিতেই ফিরে আসতে হয়। ফিরে যেতে হয়।
ব্যাংককের সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আগেও অনেকবার আসা হয়েছে। থাইল্যান্ডে যতবারই এসেছি এই বিমানবন্দরেই অবতরণ করেছি। শুধু থাইল্যান্ডেই নয়, একাধিকবার মালয়েশিয়া যাওয়ার সময়ও এই বিমানবন্দরে ট্রানজিট ছিল। স্টিল স্ট্রাকচারের অসাধারণ স্থাপত্য এই বিমানবন্দর। মোট কতবার এসেছি তা হিসেব কষার চেষ্টা করলাম। না, পাসপোর্ট দেখতে হবে। তবে যতবারই আসি না কেনো, এটি তার আকর্ষণ হারায় না। প্রতিবারই নয়া জৌলুশ যেনো চকচক করে।
মাত্র বছর কয়েকের মধ্যে সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বিশ্বের অন্যতম সেরা বিমানবন্দরের তালিকায় নিজেদের অবস্থান পোক্ত করে নিয়েছে। দেশীয় রাজনীতির রোষানলে না পড়লে এই বিমানবন্দর বিশ্বের সেরা বিমানবন্দর হয়ে উঠার পথে যাত্রা শুরু করেছিল। বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম এই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পুরোদমে যাত্রা শুরু করেছিল ২০০৬ সালের শেষদিকে। মাত্র বছর কয়েকের মধ্যে এটি এশিয়ার ৬ষ্ঠতম এবং বিশ্বের দশম ব্যস্ত বিমানবন্দর হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে থাইল্যান্ডের একটি অনন্য স্থাপনা সুবর্ণভূমি বিমানবন্দর। বছরে ছয় কোটিরও বেশি যাত্রী হ্যান্ডলিং করা এই বিমানবন্দরে বিশ্বের প্রায় একশ’টি এয়ারলাইন্স ফ্লাইট অপারেট করে। বছর কয়েক আগে থাইল্যান্ডের সরকারবিরোধী আন্দোলনে এই বিমানবন্দর এবং দেশীয় বিমান পরিচালনাকারী সংস্থা থাই এয়ার যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার ধকল সামলাতে বহুদিন সময় লেগেছে। অনেক ক্ষত এখনো শুকায়নি। থাই এয়ার তাদের বন্ধ করে দেয়া বহু রুট আর চালু করতে পারেনি। এরমধ্যে চট্টগ্রাম একটি।
যাক, দুর্দান্ত এক ল্যান্ডিং করলেন আমাদের পাইলট। সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অনন্য স্থাপনার পুরোটি চোখের সামনে। সূর্যের আলোতে পুরো ভবনটি চকচক করছে। অসাধারণ একটি ভবন, যেনো হাজার হাজার স্টিল পাইপের উপর ঠেস দিয়ে টার্মিনাল ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। এটি পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম টার্মিনাল। ভবনটির আয়তন শুনলে পিলে চমকে যায়, মাত্র ৬০ লক্ষ ৬০ হাজার বর্গফুট!
টার্মিনাল ভবনে পৌঁছে আমি আয়েশি ভাব নিয়ে হাঁটতে লাগলাম। এখানে আমার কোন কাজই নেই। হংকংমুখী বিমান ধরা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। চেক ইন নেই, লাগেজ দেয়ার ঝামেলা নেই, নেই লাগেজ টানাটানির ব্যাপার স্যাপারও। নিরাপত্তা তল্লাশীর যন্ত্রণা নেই। ইমিগ্রেশনের মুখোমুখি হওয়ার দরকার নেই। ইচ্ছেমতো ঘুরে টুরে কিছু খাওয়া দাওয়া করে নির্দিষ্ট গেটে গিয়ে বিমানে চড়লেই হবে। আমার হংকং এর ফ্লাইট ছাড়তে এখনো চার ঘন্টারও বেশি বাকি। এই চার ঘন্টা সময় আমাকে বিমানবন্দরে ঘুরে কিংবা বসে কাটাতে হবে। আমার লাগেজ ঢাকা থেকে হংকং এর জন্য দিয়ে দেয়া হয়েছে। ঢাকায় থাই এয়ারের কর্মকর্তা আমাকে ব্যাংকক–হংকং রুটের বোর্ডিং কার্ডও দিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং আমি নির্দিষ্ট গেটে যাওয়া ছাড়া আর কোন কাজ নেই। হাতে যথেষ্ট সময় আছে, গেট খোঁজাখুঁজির দরকার নেই। পরে দেখা যাবে। তবে বিমানে চড়ার আগে একটি কাজ মনে করে করতে হবে যে, গেটে বোর্ডিং কার্ড চেক করার সময় আমার লাগেজটি বিমানে তোলা হয়েছে কিনা সেটি চেক করে নিতে হবে। ক্যাচ মিস মাসে ম্যাচ মিস। আর লাগেজ মিস মানে বিদেশে বেড়ানোর আনন্দ শেষ। লাগেজ অন্য বিমানে অন্য রুটে চলে গেলে কষ্টের অন্ত থাকে না। ট্রানজিট রুটে যেখানে বিমান পাল্টে যায় সেখানে যাত্রীদের মাঝে মধ্যে এই ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এই বিমানবন্দরে ট্রানজিট নিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় একবার আমার লাগেজ সিংগাপুর চলে গিয়েছিল। হেসে উঠলাম, ওই লাগেজে চট্টগ্রামের বড় বড় চিংড়ী মাছ ভাজা ছিল। আমার এক আত্মীয় তাঁর মালয়েশিয়ায় অধ্যয়নরত মেয়ের জন্য বড় বড় চিংড়ি ভাজা করে দিয়েছিলেন। তিনদিন পর লাগেজ ফেরত পেয়েছিলাম, ভাগ্য ভালো যে, ভাজা চিংড়ি কী করে যেনো নষ্ট হয়নি। ঠিকঠাক ছিল। শীতাতপ নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থায় থাকায় লাগেজের ভিতরে থাকা চিংড়িভাজা ফ্রিজের আনন্দে ছিল বলেও আমার মনে হয়েছিল।
সুবর্ণভুমি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বেশ দর্শনীয় একটি স্থাপনা। পর্যটনের তীর্থভূমি থাইল্যান্ডের অনন্য এই স্থাপনাটি নিজেই যেনো ভর যৌবনে অবস্থান করছে। এই বিমানবন্দর এত নান্দনিক যে, লাখ লাখ মানুষের থাইল্যান্ড সফর শুরু হয় অনন্য এই স্থাপনা দেখে। একেবারে চকচকে ঝকঝকে রাখা হয়েছে পুরো বিমানবন্দর। নানা আয়োজন রয়েছে বিমানবন্দরের পরতে পরতে। জমকালো শপিং মলের মতো সুবিধাও রয়েছে বিমানবন্দরের ভিতরে। ডিউটি ফ্রি শপে থরে থরে সাজানো হরেক রকমের পণ্য। আমি একটি ঘড়ির দোকানে ঢুকে ঘড়ি দেখতে লাগলাম। কিনবো না জানি, তবুও একটির পর একটি ঘড়ি দেখছিলাম। ঘড়ির সাথে লিখে রাখা দামগুলোও। এক একটি ঘড়ির দাম দেখে হার্টবিট মিস করছিলাম! দোকানের সেলগার্ল চোখ দেখে বুঝতে পারেন যে, এসব কেনার সাধ্য আমার নেই। এগুলো মধ্যবিত্তের ঘড়ি নয়। কিন্তু কি আশ্চর্য! মেয়েটি একটু বিরক্ত না হয়ে আমাকে সময় দিচ্ছিলেন। এটিই মনে হয় কর্পোরেট ব্যবসার নিয়ম। মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাখতে হয়!
হঠাৎ আমার মনে হলো গেটটি খুঁজে বের করে রাখি। অনেক বিশাল এয়ারপোর্ট, পরে গেট খুঁজতে যদি এক ঘন্টা লেগে যায় তাহলে ঝামেলায় পড়ে যাবো। আমি ব্যাংকক–হংকং রুটের বোর্ডিং কার্ডটি হাতে নিয়ে গেট নম্বর দেখলাম। কত নম্বর গেটে আছি দেখতে গিয়ে টের পেলাম যে, একটু খানি পরেই আমার প্রত্যাশিত গেট। ওখান থেকেই আমাকে হংকং এর ফ্লাইটে চড়তে হবে। মজার ব্যাপার হলো, আমি ঢাকা থেকে এসে যেই গেট দিয়ে বের হয়ে এলাম, ঠিক পাশের গেটেই হংকং এর ফ্লাইট। জীবনে কম ট্রানজিট করিনি, কিন্তু এর আগে কোনদিনই ৬ নম্বর গেট দিয়ে এসে ৭ নম্বর গেট দিয়ে বাইরে যাওয়ার ঘটনা ঘটেনি। ব্যাপারটি কাকতালীয় হলেও আমার হয়রানির মাত্রা একেবারে শূণ্যে নেমে গেলো। ‘হাঁফ ছেড়ে বাঁচা’র কথা বহুদিন বহুভাবে লিখেছি কিন্তু এই যে পাশের দুয়ারকেই কাঙ্খিত দুয়ার হিসেবে পাওয়ায় আমার বুকটি কেমোন যেনো হালকা বোধ হতে লাগলো। ট্রানজিটের সময় অচিন বিমানবন্দরে প্রত্যাশিত গেটটি খুঁজে নিতে কত পথ যে মাড়াতে হয়। অনেক সময় হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ব্যথাও হয়ে যায়। বাসে ট্রেনে চড়ার মতো ব্যাপার স্যাপারও রয়েছে বহু বিমানবন্দরে। এবারের যাত্রায় থাই এয়ার এই কী আনন্দ দিল আমাকে!!
আমাকে যেহেতু কোন কিছু খোঁজাখুঁজি করতে হবে না, পাশের দুয়ার দিয়েই বের হয়ে যাবো সুতরাং মনের আনন্দে আরো কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করার সিদ্ধান্ত নিলাম। সুবর্ণভুমি বিমানবন্দর বছরে ছয় কোটিরও বেশি যাত্রী হ্যান্ডলিং করে। দিনে প্রায় ১ লাখ ৬৫ হাজার যাত্রী এই বিমানবন্দর ব্যবহার করে। হিসেবটি বুঝতে পারছেন!! দিনে ১ লাখ ৬৫ হাজার মানুষ! এত মানুষ আমাদের বহু ‘জনসমুদ্র’ জনসভায়ও হয় না। সুতরাং গিজগিজ ভাব না থাকলেও বিমানবন্দরের হেথায় হোথায় বহু মানুষ অবস্থান করছিলেন। কেউবা ছুটছিলেন, কেউবা সোফায় ঘুমাচ্ছেন আবার কেউ কেউ চেয়ারে হেলান দিয়ে অলস সময় কাটাচ্ছেন। শপিং করছেন অনেকেই। প্রতিটি দোকানেই কমবেশি ভিড় লেগে আছে। কত ধরনের জিনিস যে সাজিয়ে রাখা! জামাকাপড় থেকে শুরু করে কসমেটিকস,পারফিউম,ঘড়ি, চশমা, কলম কি নেই। সবই থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আমি কার্টিয়ার, টিশর্ট এবং রোলেক্সের শোরুমে অনেকক্ষণ চক্কর মারলাম। মাউন্ট ব্ল্যাঙ্ক (মোঁ ব্লঁ) কলম নিয়েও ঘাটাঘাটি করলাম। এসব দোকানে তেমন কোন মানুষই নেই। বেচাবিক্রি হয় বলেও মনে হলো না। তবে কি করে যে এমন শানদার সব শোরুম এরা সাজিয়ে রেখেছে কে জানে!
অনেকক্ষন ধরে ঘুরলাম, কিন্তু সময় যেনো ফুরায় না। পাশের দুয়ারই গন্তব্য হওয়ায় চার ঘন্টা অনেক বেশি লম্বা মনে হচ্ছিল। আমি আবারো একটির পর একটি দোকানে ঢুঁ মারতে লাগলাম। হাতে গ্লোরিয়া জিন্সের কফির মগ নিয়ে হেলে দুলে পা চালাতে খুব একটা খারাপ লাগছিল না। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।