(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
গভীর রাত, চারদিকে শুনসান নিরবতা। ঢাকা শহরে বহু রাত কাটালেও এর আগে কোনদিন এত রাতে আমি বাইরে ঘুরিনি। রাতের ঢাকা দেখিনি। দিনের অতিব্যস্ত ঢাকা যে রাতে এমন শান্ত হয়ে উঠে তাও জানা ছিল না। বিশাল চওড়া এয়ারপোর্ট রোড, কিন্তু দিনের ব্যস্ততার ছিটেফোটাও কোথাও নেই। বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কিছু গাড়ি ছুটে চলছে। ছুটছে প্রাইভেট কার, জীপ। দামি দামি নানা ব্র্যান্ডের গাড়ির কোনটি এয়ারপোর্টের দিকে, আবার কোনটি এয়ারপোর্ট থেকে শহরের দিকে। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, বিমানবন্দরমুখী গাড়িগুলোতে বিদেশযাত্রী এবং শহরমুখী গাড়িগুলোতে বিদেশফেরত লোকজন রয়েছে। সবাই ব্যস্ত। সবাই ছুটছে। ছুটছি আমিও।
অল্পক্ষণের মধ্যে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে গেলাম আমি। ড্রাইভারের সালামের ধরনেই বুঝা যাচ্ছিল যে, তিনি কিছু বখশিস আশা করছিলেন। নিজে থেকে আমার লাগেজ নামিয়ে দিলেন, বেশ যত্ন করে একটি ট্রলিও যোগাড় করে দিলেন। আমাদের দেশে মাগনায় ট্রলি পাওয়া যায়, প্রয়োজনে দুইটি তিনটি বা আরো বেশিও নেয়া যায়। কেউ কিচ্ছু বলে না। অথচ বিশ্বের নানাদেশে এই ট্রলি নিতে কড়ি গুনতে হয়। ইউরোপ–আমেরিকায় মাগনায় ট্রলির কথা চিন্তাও করা যায় না। ওসব দেশের বিমানবন্দরে শত শত মানুষ ট্রলিব্যাগ ঠেলে বেরিয়ে যান, আলাদা ট্রলির ধার ধারেন না। জগতের দেশে দেশে কড়ির যথেষ্ট দাম আছে, শুধু ব্যাংক লুটেরা মানুষগুলো যাচ্ছেতাইভাবে কড়ি খরচ করে। সহজে কড়ি কামানোর নানা পন্থা থাকায় আমাদের বহু দাগী মানুষই বিদেশে গিয়ে মহারথী হয়ে উঠে!
মাঝে মধ্যে কি যে হয় আমার। ট্রলির চিন্তা গিয়ে ব্যাংকে ঢুকছে! কী দরকার এসব ভেবে! এসব নিয়ে আমার মাথা ঘামানোর কোন দরকার আছে কি! দেশের এসব শত্রুদের যারা শাস্তি দিতে পারবেন তারা হয়তো তাদের নিয়ে ভাবছেন, চিন্তা করছেন। আমি শুধু শুধু মাথা ঘামিয়ে শরীর নষ্ট করে লাভ কি!
থাই এয়ারের কাউন্টারে গিয়ে মাথা ঘুরে উঠলো। বিশাল লাইন, বহু মানুষ। অসংখ্য নারী পুরুষ ও শিশু। ইতোমধ্যে লাইন এত লম্বা হয়ে উঠেছে যে ঠিক কখন যে বোর্ডিং কার্ডের নাগাল পাবো কে জানে! এতোজনের পেছনে লাইনে দাঁড়িয়ে শেষতক নিজের পছন্দের সিট পাওয়া অসম্ভব। পেছনের দিকে সিট জুটবে। উইন্ডো তো দূরের কথা, আইল পেলেও হবে। তবে মাঝের সিটে পড়লে যে স্যান্ডউইশ হয়ে যাবো তা ভেবে বোর্ডিং করার আগেই আমার খারাপ লাগতে শুরু করে! কিছু করারও নেই। এত মানুষ আসলো কখন! এরা কী মধ্যরাত থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে!!
আমি থাই এয়ারের যাত্রী। ঢাকা থেকে ব্যাংকক হয়ে হংকং। আমি যেই লাইনে চেক–ইন করছি সেখানে শুধু হংকং এর যাত্রীই নয়, ব্যাংককেরও প্রচুর যাত্রী রয়েছে। এতে করে ধারণার চেয়ে কিছুটা বাড়তি যাত্রী রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। নিশ্চয় বড় ফ্লাইট। নাহয় এতো যাত্রী কিভাবে নেবে! কত যাত্রী নেবে তারা? কিছু জানি না, বুঝতেও পারছিলাম না। তবে প্রচুর লোক যে থাইল্যান্ড যায় সেটা বেশ বুঝতে পারছিলাম।
পর্যটনের তীর্থক্ষেত্র থাইল্যান্ড। কত কিছু যে তারা করে রেখেছে। এক একটি আইল্যান্ড যেনো এক একটি ভূস্বর্গ! মানুষের মন ভরিয়ে দেয়ার জন্য যা কিছুর দরকার তার সবই ছিটিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে থাইল্যান্ডে। চিকিৎসা শাস্ত্রেও চোখ ধাঁধানো উন্নতি করেছে দেশটি। কত লোক যে চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ড যায়! আমার সামনে বিশাল লাইনটির অধিকাংশ মানুষই মনে হয় বেড়াতে যাচ্ছে, কেউ কেউ চিকিৎসার জন্যও হতে পারে। এছাড়া থাইল্যান্ডের সাথে বাংলাদেশের ব্যবসা বাণিজ্যও রয়েছে। রয়েছে লাগেজ পার্টি নামের বিশেষ এক গোষ্ঠী। তারা থাইল্যান্ড যায়, শপিং করে ব্যাগ ভর্তি করে দেশে ফিরে। থাইল্যান্ড থেকে কেনা নানা পণ্য এখানের অভিজাত শপিং মলে ডেলিভারি দেয়, বেসাতি করে।
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর কে যে কোন উদ্দেশ্যে থাইল্যান্ডে যাচ্ছে কে জানে। তাদের উদ্দেশ্য জানার বিন্দুমাত্র আগ্রহও আমার নেই। আমি ভালোয় ভালোয় বোর্ডিং–টা করে নিতে পারলে হতো। বড়সড় কোন দলের সদস্য হলে গ্রুপ চেক–ইন করতে পারতাম। তাহলে এত লম্বা লাইনের পেছনে পড়ে থাকতে হতো না। সাথে সিনিয়র সিটিজেন থাকলেও সুবিধা নিতে পারতাম। এখন এই একা আমার জন্য বিশেষ কোন সুবিধা নেয়ার ইচ্ছে হলো না। আমি রয়ে সয়ে কচ্ছপের গতিতে একটু একটু করে সামনে যাচ্ছিলাম। খেয়াল করে দেখলাম যে, আমার পেছনেও বেশ কয়েকজন নারী পুরুষ রয়েছেন।
এক পর্যায়ে অপেক্ষার পালা শেষ হলো। থাই এয়ারের কাউন্টারের সুন্দরীর সামনে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়ালাম। বাড়িয়ে দিলাম পাসপোর্ট। বেশ আকুতি জানিয়ে বললাম, একটু সামনের দিকে এবং উইন্ডো প্লিজ। হাসি ঠিকঠাকভাবে ঝুলিয়ে রেখে বললাম, মোটা মানুষ। ঠেলে–ঠুলে পেছনে যেতে–আসতে খুব কষ্ট হয়। বাহ্, তরুণীর হাসিটাতো দারুণ। পটেছে বলে মনে হলো। দুইটি বোর্ডিং কার্ড ডেস্কের উপর রেখে আমি বুঝিয়ে দিলেন যে, ‘আপনার হংকং পর্যন্ত বোর্ডিং করে দিয়েছি। এটি ঢাকা–ব্যাংকক। এটি ব্যাংকক–হংকং। দুইটিই উইন্ডো এবং সামনের দিকে দিয়েছি। ভালো থাকবেন।’ বুঝতে পারলাম যে, তিনি আমাকে সামনে থেকে সরে যেতে বলছেন। তবুও আমাকে বেশ বিগলিত হয়ে উনাকে ধন্যবাদ দিয়ে সামনে এগুলাম। বোর্ডিং কার্ড হাতে নিয়ে সামনে এগুলাম। বহু কাজই বাকি। ইমিগ্রেশন করতে হবে। জুতা–মোজা, প্যান্টের বেল্ট, হাতের ঘড়ি, পকেটের কড়ি, চাবির রিংসহ সবকিছু খুলে চেক করা হবে। এরপর ম্যানুয়েলিও দেখা হবে মেটাল ডিটেকটর দিয়ে। এরপরই কেবল ভিতরে যেতে দেয়া হবে। তবে শুরুতে ইমিগ্রেশনের মোকাবেলা করে ফেলা ভালো। নিজেদের ইমিগ্রেশন। বাঙালী অফিসার। তবে মাঝেমধ্যে শুধু শুধু ঝামেলা করেন। কেন যাচ্ছি, কি কাজ, এনওসি কই ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্ন করেন। আবার কখনো কখনো কিছু না বলে ‘এক্সিট সিল’ মেরে দেন।
অল্পবয়সী একজন অফিসারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি আমার দিকে তাকালেন। আগের ছবি নিশ্চয় উনার কম্পিউটারে রয়েছে। তাই আমাকে আর ছবির কথা কিছু বললেন না। গোপনে ধারণ করেছে কিনা কে জানে! ক্যামেরা তো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। পাসপোর্টে সিল মেরে দিলেন। আমি সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম।
ঢাকা এয়ারপোর্টে বসার জায়গা অনেক। বিভিন্ন ব্যাংকের কার্ড হোল্ডারদের জন্য খাওয়া দাওয়া এবং বসার ব্যবস্থা রয়েছে। কার্ড না থাকলেও সমস্যা নেই। রেস্টুরেন্টেও দারুণ সব খাবার দাবার রয়েছে। তবে শুধু প্রচুর নয়, অস্বাভাবিক গলাকাটা দাম।
আমার ক্ষুধা নেই, তবে তৃঞ্চা আছে। কফির তৃঞ্চা। এতো ঝক্কি সহ্য করার পর গলায় একটু কফি পড়লে মন্দ লাগবে না। তাই এক কাপ কফি নেয়ার জন্য রেস্টুরেন্টের দিকে গেলাম। আমার হাতে কোন ‘ব্যাগ–ট্যাগ’ নেই। হাতের কেবিন ব্যাগটিও আমি লাগেজ হিসেবে দিয়ে দিয়েছি। ওজন নিয়ে কোন সমস্যা না থাকায় দুইটি ব্যাগ লাগেজে দিতে আমার কোন অসুবিধা হয়নি। ব্যাগ না থাকায় একেবারে ঝাড়া হাত–পা নিয়ে আমি হেলে দুলে হাঁটতে লাগলাম। শুধু পাসপোর্ট এবং দুইটি বোডিং কার্ড যত্ন করে পকেটে রেখেছি। আমাকে দেখে যে কেউই মনে করবে যে, বিদেশ যাচ্ছি না, বিমানবন্দরে বেড়াতে এসেছি। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।