(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
চারপাশ দেখতে দেখতে ফিরছিলাম। কী সমৃদ্ধ একটি শহর! কী সমৃদ্ধ এক জনপদ!! চীনের গুয়াংজু শহরের এমন জৌলুশ চোখ টাটিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। এই জৌলুশ চীনের প্রায় সর্বত্র। ইতোমধ্যে বেইজিং সাংহাইসহ চীনের যে কটি শহরে ঘুরেছি সবখানেই এমন জৌলুশ দেখেছি। আকাশছোঁয়া সব অট্টালিকায় লাখো কোটি মানুষের স্বপ্নের এমন নিখুঁত বুনন সত্যিই বিস্ময়কর। জুবায়ের চীনকে নিয়ে যত আশাবাদী আমি তার থেকে একটুও কম নই। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, চীন সাঁই সাঁই করে এগুচ্ছে, এগুচ্ছে শিল্প, প্রযুক্তি, অর্থনীতিসহ সবকিছুতেই। পুরো পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দেয়ার জন্য চীনের ভান্ডারে রসদের যে অভাব নেই তা বেশ বুঝতে পারছিলাম।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই। সন্ধ্যার বেশ পরে আমাকে ডেকে তোলা হলো। অফিস ফেরত জাহেদ ভাই চা খাওয়ার নাম করে আমার ঘুম ভাঙালেন। নাহয় আরো কতক্ষণ ঘুমাতাম কে জানে! বেইজিং থেকে হাইস্পিড ট্রেনে চড়ে আসলেও বেশ কাহিল হয়ে গিয়েছিলাম। তাই বাসায় ফেরার পর ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলাতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমাকে ভাত খাওয়ার জন্য ডাকা হলেও আমি নাকি সাড়া দিইনি। ঘুমের ঘোরেই হাত নেড়েছি, খাবো না।
নিজের বাসার মতো যে বাসাটি উঠেছি সেই বাসার বর্ণনা ইতোপূর্বেও দেয়া হয়েছে। এটা আমার বন্ধু, সীতাকুণ্ডের মোহাম্মদ ইউছুপ আলীর বাসা। তিনি হংকং থাকলেও ব্যবসা বাণিজ্য করেন চীন থেকে। আর গুয়াংজুতে উনার বিশাল অফিস এবং মানুষজন রয়েছেন। যাদের কেউ কেউ এই বাসাতেই থাকেন। ইউছুপ আলী ভাইর জন্য একটি বড়সড় কক্ষ আলাদা করে সাজানো গোছানো থাকে। যেটি আপাততঃ আমার দখলে। (আমার চীন ভ্রমণের কিছুদিন পরই আমার অতি আপনজন এই বন্ধুটি মারা গেছেন। পরম করুণাময় আমার অতি ভালো মানুষ এই বন্ধুটিকে জান্নাতবাসী করুন)।
চা খাওয়ানোর নাম করে আমার ঘুম ভাঙ্গানো হলেও টেবিল ভর্তি নানা খাবারে। কত ধরনের ফলমূল, কেক বিস্কিট, পেস্টি ও পিঠাপুলির আয়োজন যে করা হয়েছে!
নাস্তা করতে করতে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম আমরা। চীনের নানা অঞ্চলের নানাকিছু নিয়ে কথাবার্তা বলছিলাম আমরা। জাহেদ ভাই বহুবছর ধরে চীনে থাকেন। এতে করে চীনের বহুকিছুই তিনি জানেন। তবুও আমার কাছ থেকে নানা বিষয়ে জানতে চাচ্ছিলেন তিনি। কেমন বেড়ালাম, কেমন দেখলাম, কেমন লাগলো এসব। মায়ের কোলে বসে নানাবাড়ির গল্প বলার মতো আমিও চীনের নানা কিছুর গল্প শুনালাম।
আমার দেশে ফেরার সময় বেশ দ্রুত ঘনিয়ে আসছিল। জাহেদ ভাই বললেন, আপনি কি কোন শপিং টপিং করবেন না? খালি হাতে ফিরে যাবেন? কিছু চকলেট টকলেট তো নেবেন! আমি বুঝতে পারছিলাম যে,ইউছুপ আলী ভাই জাহেদ ভাইকে দিয়ে কথাগুলো বলাচ্ছেন। অর্থাৎ আমাকে কিছু শপিং করে দেয়া হবে। কিন্তু থাকা খাওয়ার এত বিশাল অত্যাচার হজম করার পর আবার শপিং এর যন্ত্রণা চাপিয়ে দেয়া খুবই অমানবিক হবে। তাই আমি বিদেশে কোনদিন শপিং করিনা বলে নাকচ করে দিলাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠার পর আমার হাতে আর কোন কাজ ছিলনা। জাহেদ ভাইসহ অন্যান্যরা অফিসে চলে গেছেন। শুধু জুবায়ের রয়ে গেছেন আমার জন্য। যদি কোন কিছু লাগে! একদিন পরই আমি চলে আসবো। তাই শেষবারের মতো গুয়াংজু ঘুরে দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করলাম। জুবায়ের আমাকে নিয়ে বের হলো। বললো, চলেন, হাঁটি। কাছেই একটি শপিং মল আছে। খুবই বিখ্যাত। ওখানেই সময় কাটাই, ঘুরে ফিরে দেখি।
আমরা যখন শপিং মলটিতে প্রবেশ করলাম তখন সেখানে মনে হলো কয়েক হাজার মানুষ। মানুষে মানুষে গিজগিজ করছে পুরো এলাকা। এক্সেলেটর সিঁড়ি ভেঙ্গে আমরা মার্কেটে ঢুকলাম। যেনো একটি ফুটবল খেলার মাঠ। পাঁচ তলা জুড়ে নানা পণ্য। সূঁচ থেকে গাড়ি পর্যন্ত সবই নাকি এই মলে রয়েছে। একটিই দোকান, সুপারশপের মতো। কিন্তু এত বড়!! যেনো পৃথক পৃথক স্টল। রকমারি পণ্যের পসরা। কত ধরনের পণ্য যে শোভা পাচ্ছে। জুবায়ের আমাকে একটির পর একটি স্টলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিল। দা ছুরি থেকে শুরু করে খুন্তি কাঁচি সবই। বিছানার চাদর, বালিশ, কোলবালিশ, কুশন, থালা–বাটি সবই দেখছিলাম। কত ধরনের আচার যে দেখলাম, চকলেটের পসরা চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিলো।
কিছু কিছু জিনিস এত সুন্দর, এত্ত সুন্দর যে আমার হাত নিশপিশ করতে লাগলো। আমি বাজার সদাই করতে শুরু করলাম। জুবায়েরের চোখেমুখে বিশ্বজয়ের হাসি। তার ভাবখানা এমন যে, বলেছিলাম না! তখনতো বিশ্বাসই করেননি!
সত্যিই আমি বিশ্বাস করিনি। এত ভালো মানের জিনিসপত্র যে চীনের শপিংমলে পাওয়া যাবে তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। আমি একটির পর একটি সদাই করতে লাগলাম। ঝুড়ি ভর্তি হয়ে গেলো। বহুভাবে বহুদেশে ভ্রমণ করলেও এভাবে লোভীর মতো সদাই আমি জীবনে কোনদিন করিনি। হয়তো আর কোনদিন করাও হবে না। আমাদের দুজনের চার হাতই ভর্তি নানা প্যাকেটে। কত কিছু যে কিনলাম!
বাসায় ফেরার পর জুবায়েরকে নিয়ে সব জিনিসপত্র নিয়ে লাগেজ করলাম। আলাদা একটি ব্যাগ হয়ে গেলো। বিদেশ ভ্রমণে জীবনে কোনদিন ওজন নিয়ে আমাকে চিন্তা করতে হয়নি। আমি শুধু কেবিন ব্যাগ নিয়েই বহু দেশ ভ্রমণ করেছি। এই প্রথম মনে হলো, বিমানবন্দরে আমাকে বাড়তি মাশুল দিয়ে সদাইগুলো দেশে নিয়ে যেতে হবে। এখন নিজের উপর রাগ হতে শুরু করেছে। কেন যে, এমন পাগলের মতো বাজার সদাই শুরু করলাম! মনে মনে হাসলামও। এমন সব জিনিস কিনেছি যা রেয়াজুদ্দীন বাজারেও পাওয়া যায়, টেরিবাজারেও। কয়েক সেট বিছানার ছাদর, বেশ কয়েকটি তোয়ালে, কুশন কাভার, ছুরি, কাঁচি, নেইল কাটার, চকলেট, কাঁচা মরিচের আচার, লাল মরিচের আচারসহ হরেক রকমের পণ্য। ওয়াশরুমে পা ঢলার জন্য এমন অদ্ভুত একটি জিনিস কিনলাম যে, যেটিকে ব্যাগে ঢুকাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এত অসাধারণ কয়েকটি টি শার্ট এবং প্যান্ট দেখলাম যে, রেখে আসতে ইচ্ছে করেনি। মোবাইলের চার্জারসহ বেশ কিছু ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইসও কিনেছিলাম। এখন সবকিছু ব্যাগে ভরতে গিয়ে মনে হচ্ছে এত লোভ না করলেও হতো!
গুয়াংজু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমি চেকইন করার সময় বেশ তটস্থ ছিলাম যে, এই বুঝি বাড়তি টাকা দাবি করবে। কিন্তু আশ্চর্য হলাম যে, এয়ারলাইন্সের কাউন্টারে বসা তরুণী লাগেজের ওজন নিয়ে আমাকে একটি কথাও বললেন না। লাগেজ দিয়ে দেয়ার পর বোর্ডিং কার্ড নিয়ে আমি ইমিগ্রেশনের দিকে অগ্রসর হলাম। ইমিগ্রেশনের বিশাল ডেস্ক, বহু অফিসার বসে আছেন। অধিকাংশই নারী। ফেরার সময় কোন যাত্রীকেই তেমন কিছু জিজ্ঞেস করা হয়না, সীল মেরে বিদায় করে দেয়। যেনো ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি, মানে তুমি যত তাড়াতাড়ি যাবে ততই ভালো। আমার দেশের চাল বাঁচবে! আমার পাসপোর্টেও তরুণী সীল মেরে সামনে যেতে ইশারা করলেন।
সামনেই হাঁটলাম। নানা পথ মাড়িয়ে বোর্ডিং ব্রিজের সামনে অপেক্ষা করতে লাগলাম। বিমান ছাড়ার এখনো দেরি আছে। ধারে কাছে ডিউটি ফ্রি শপে থরে থরে সাজানো নানা পণ্য। ডিউটি ফ্রি বলা হলেও এখানে এক একটি পণ্যের যা দাম তা বাইরের যে কোন শপিংমল থেকে বেশি। আমি কিছুক্ষণ দোকানে দোকানে ঘুরলাম। ঘড়ির দোকান, কলমের দোকান, ব্যাগের দোকান। কফির পোড়া পোড়া গন্ধ নাকে এসে লাগছিল। মন ভরিয়ে দেয়া গন্ধ। এদিক ওদিক তাকালাম। ওই তো কফিশপ! পকেট হাতড়ে দেখলাম যে, চীনের বেশ কিছু মুদ্রা রয়ে গেছে। খুচরো কয়েন এবং ছোট ছোট নোট দিয়ে এক মগ লার্জ সাইজের কফি নিলাম। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে সাতরাজ্যের ভাবনা ভাবছিলাম। কতগুলো দিন যে অচিন চীনে পার করে দিলাম! কত কিছু যে দেখলাম! আমাকে নিয়ে বিমানটি যখন পশ্চিমমুখে ওড়ছিল তখন ভিতরটিতে কেমন যেনো ডানা ঝাপ্টানোর শব্দ শুনছিলাম।
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।