(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
চারদিকে মুগ্ধতার ছড়াছড়ি। যেনো পরতে পরতে বিস্ময়। আমি মুগ্ধ হয়ে চারদিক দেখছিলাম। দেখছিলাম মানে, না দেখে উপায়ও ছিল না। চারদিকের অপার সৌন্দর্য আমার চোখ টানছিল। তবে আমি কী মুগ্ধ নাকি বিস্মিত সেটিও বুঝতে পারছিলাম না। কিছু বুঝার যে ক্ষমতা তাও যেনো আমার লোপ পাচ্ছিল। বিভোর হয়ে আমি দেখছিলাম পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের একটি, চীনের মহাপ্রাচীর। প্রাচীরের উপর ঘুরতে ঘুরতে যেদিকে চোখ যাচ্ছিল সেদিকেই ছড়িয়ে ছিল মুগ্ধতা, বিস্ময়। ঘোরলাগা চোখে আমি কখনো ইট পাথর, কখনো প্রকৃতি কখনোবা আকাশ দেখছিলাম। দৃশ্যমান সবকিছুর পাশাপাশি আমি অদৃশ্যে থাকা লাখ লাখ মানুষের কষ্ট, ঘাম, স্বপ্ন এবং দক্ষতাও দেখছিলাম।
গ্রেটওয়াল কিংবা চীনের মহাপ্রাচীর সম্পর্কে আমার আগে তেমন কোন ধারণা ছিলনা। আমি মনে করতাম এটি একটি লম্বা এবং সুউচ্চ সীমানা দেয়াল মাত্র। আমার ধারণা ছিল চীনের মহাপ্রাচীর ‘বার্লিন ওয়ালে’র মতো কিছু একটা হবে। যেটি ডিঙ্গিয়ে এপার–ওপার করা মানেই নির্ঘাত মৃত্যু।
আমার প্রথম চীন সফরে এতকিছু দেখা হবে সেটিও আমার ধারণাতে ছিল না। চীনের মহাপ্রাচীর দর্শন আমার ট্যুর প্ল্যানেও ছিলনা। তবুও ভাগ্যক্রমে প্রাচীরের উপর চড়ার পর মনে হচ্ছিল এটি না দেখে চীন ছাড়লে আমার অন্য সবকিছু দর্শনই ব্যর্থ হয়ে যেতো।
প্রাচীর মানে দেয়াল, চীনের মহাপ্রাচীরও একটি দেয়াল। কিন্তু একটি দেয়াল যে কী পরিমাণ বিস্ময় জাগাতে পারে তা চোখে না দেখলে কল্পনা করাও কঠিন। দুনিয়ার দেশে দেশে বহু প্রাচীর নির্মিত হয়েছে। হয়েছে আপনার আমার বাড়ির পাশেও। কিন্তু চীনাদের সমান বড় প্রাচীর দুনিয়ার আর কেউ কখনো বানাতে পারেনি, বানায়নি। মঙ্গোলিয়ার দস্যুদের হাত থেকে নিজের দেশকে বাঁচাতে চীনের রাজারা এই দেয়াল নির্মাণ শুরু করেছিলেন। যিশু খ্রিস্টের জন্মের সাতশ’ বছর আগ থেকে শুরু হয় এর নির্মাণ কাজ। পরবর্তীতে বিভিন্ন ধাপে প্রাচীরটি নির্মাণ করা হয়েছে। ষোড়শ শতাব্দি পর্যন্ত শত শত বছর ধরে চলে আসা নির্মাণে প্রাচীরটি হয়ে উঠে মহাপ্রাচীর, পৃথিবীর দীর্ঘতম প্রাচীর। আগেই বলেছি যে, বিশ্বের সাতটি আশ্চর্য স্থাপনার একটি হয়ে উঠা এই মহাপ্রাচীর মানুষের তৈরি দুনিয়ার সবচেয়ে বড় স্থাপনা। এর থেকে বড় কোন স্থাপনা এর আগে কিংবা গত প্রায় আড়াই হাজার বছরেও আর কোথাও নির্মিত হয়নি, কেউ নির্মাণ করতে পারেনি।
চীনের মহাপ্রাচীর নির্মিত হয়েছে বহু বছর আগে। কিন্তু আজো দুনিয়ার মানুষের কাছে এই এক বড় বিস্ময়! কী করে এই প্রাচীর নির্মাণ করেছিল তারা? কি করে এত বড় দেয়াল নির্মাণ সম্ভব হলো! এই বিস্ময় থেকেই যা আজ বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। প্রতিদিন বিশ্বের হাজার হাজার পর্যটক চীনের গ্রেটওয়াল বা মহাপ্রাচীর দেখতে ভিড় করেন। চোখ কপালে তুলে চীনের মহাপ্রাচীর দেখেন। হয়রান হয়ে যান, তবুও প্রাচীর না দেখে ফিরতে চান না। হাজার হাজার মানুষ চীনের প্রাচীরের উপর ছুটেন, কষ্ট করে তৃপ্তি পেতে চেষ্টা করেন। মহাপ্রাচীর দর্শনে প্রতিদিন দর্শনার্থীদের কী পরিমাণ ঘাম যে ঝরে তার হিসেব পাওয়া মুশকিল। শুধু দেখতে যদি এভাবে ঘাম ঝরাতে হয়, নাজানি এটি নির্মাণে কী পরিমাণ ঘাম ঝরাতে হয়েছিল!
চীনের মহাপ্রাচীরের চাইনিজ নাম চাংছ্যাং, যার অর্থ লম্বা দেয়াল। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৬ হাজার ২৭৬ কিলোমিটার। এটির পুরুত্ব বা প্রস্থ ৩২ মিটার বা প্রায় ১০৫ ফুট। চীনের বিস্তৃত অঞ্চলের জনগণকে দস্যুদের হাত থেকে রক্ষা করতে নির্মাণ করা হয়েছিল এই প্রাচীর। প্রাচীরের উপর সীমান্ত রক্ষীদের রাতে দিনে তৎপরতা চলতো। প্রাচীরটি এতো চ্যাপ্টা যে এটির উপর অনায়াসে ১২টি ঘোড়া পাশাপাশি নেচে, দৌড়ে টহল দিতো। ঘোড়ার ওপর থাকতো প্রশিক্ষিত সৈন্যবাহিনী। যারা মঙ্গোলিয়ার দস্যুদের ঠেকানোর জন্য জীবনপণ করতো।
আগেই বলেছি, চীনের গ্রেট ওয়াল তৈরির মূল উদ্দেশ্য ছিলো প্রতিবেশী দেশ মঙ্গোলিয়ার যাযাবর দস্যুদের হাত থেকে চীনকে রক্ষা করা। নিজের দেশকে বাঁচানোর জন্য কী পরিমাণ পরিশ্রম যে চীনের মানুষ করেছিল তা ভাবতেই আশ্চর্য লাগে। আড়াই হাজার বছর আগে কোন ধরনের প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়া শুধুমাত্র শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে এমন বিস্ময়কর স্থাপনা নির্মিত হয়েছিল, নাকি এখানে অন্য কিছু গোপন রহস্য রয়েছে কে জানে!
সুউচ্চ পাহাড়ের উপর এত পাথর কোত্থেকে কিভাবে তুলে আনা হয়েছিল, এগুলোকে এভাবে স্থাপনও বা করা হলো কিভাবে? কিভাবে পাথরের পর পাথর এভাবে আটকে থাকলো সবই বিস্ময় সৃষ্টি করছিল। অসমান পাহাড়ে কিভাবে এত বড় স্থাপনা নির্মিত হলো তার কুলকিনারা করা আমার মতো অক্ষম মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। পিরামিডের মতো চীনের এই প্রাচীরও আমার কাছে এক রহস্যময় স্থাপনা হয়ে দেখা দিল।
চীনের গ্রেটওয়াল পুরোপুরি সমান নয়, সিঁড়ি। পাহাড়ে চড়ার সিঁড়ি। একটির পর একটি সিঁড়ি ভেঙ্গে ভেঙ্গে উঠতে হচ্ছিল। কিছুদূর পর পর সমতলের মতো জায়গাও রয়েছে। তবে তাও পাহাড়ের উপরে। ওই সমতল জায়গা থেকে আবারো উঁচুতে উঠতে হয়। আবারো পাহাড় ডিঙ্গাতে হয়। সুদীর্ঘ দেয়ালে কিছুদূর পর পর চেকপোস্টের মতো বেশ ঘর রয়েছে। তবে আকৃতিতে খুব একটা ছোট নয়। এসব ঘরের ভিতর দিয়ে সিঁড়ি চলে গেছে। সিঁড়ি আবার উপরেও উঠেছে। কোন দস্যুদল হানা দিতে ছুটে আসছে কিনা তা ওই ছাদ থেকে দেখা হতো। ছাদ থেকে বহুদূর দেখা যায়। পাহাড়ের পর পাহাড়, পরতে পরতে পাহাড়। আর ওই পাহাড়ী পথ মাড়িয়ে কোন দস্যুদলের হানা দেয়াও যে খুব একটা সহজ ছিল না তাও বেশ বুঝা যাচ্ছিল। আবার এই ঘরটির ভিতরে বিশ্রাম করতেন পাহারাদারেরা। ঝড় বৃষ্টিতে তারা এসব ঘরের ভিতরে আশ্রয় নিতেন।
প্রচুর হাঁটাহাঁটি হচ্ছে আমাদের। ক্যাবল কারের ল্যান্ডিং পয়েন্ট থেকে হাঁটতে শুরু করেছিলাম। মহাপ্রাচীর ধরেও হেঁটেছি বহুপথ। সামনে গেছি, পেছনেও গেছি। ছাদেও চড়েছি। কষ্টে কষ্টে বিবর্ণ হয়েছি, ঘামে গরমে জুবুথুবু হয়েছি। পাহাড় চড়ার মতো কষ্টকর হাঁটা অবলীলায় হজম করেছি। তীব্র গরমের মাঝে একটির পর একটি সিঁড়ি ডিঙ্গাতে বেশ হয়রান লাগছিল। তবুও আনন্দ নিয়ে আমি সামনে এগিয়েছি। কেউ টাকা–পয়সা দেবে বললেও এত কষ্ট করে পথ চলতাম না, শুধু চীনের মহাপ্রাচীর নিয়ে তৃপ্ত হবো বলেই অনেক কষ্ট সয়েও হাসিমুখে পথ চলেছি।
দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছিল। পাহাড়ের উপর প্রাচীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে কাহিল হয়ে উঠছিলাম। কিন্তু শখ যেনো মিটছিল না। একটির পর একটি সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে ঠিক কতদূর চলে এসেছি কে জানে! ফিরতি পথেও কী একইভাবে কষ্ট হবে!
আহা, আমাদের শুধু হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে, যারা নির্মাণ করেছিলেন তাদের না জানি কেমন লেগেছিল! বিশাল এই দেয়াল নির্মাণে কত জীবন যে বলি হয়েছে তার কি কোন হিসেবে নিকেশ আছে!
কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে মঙ্গোলীয় দস্যুদের ঠেকাতে বছরের পর বছর ধরে দেয়াল নির্মাণ করা হলেও দস্যুদের হানা কিন্তু নিয়মিত চলতো। বহুদফায় চীন আক্রান্ত হয়েছিল। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, দস্যুদেরও কোনদিন দেয়াল ভেঙে আক্রমণ করতে হয়নি, পাহারাদারদের ম্যানেজ করে ঠিকই তারা চীনের অভ্যন্তরে এসে ইচ্ছেমতো লুটতরাজ চালিয়ে ফিরে যেতো। তখনো ম্যানেজ করার সিস্টেম ছিল! নিজে নিজে হেসে উঠলাম।
আমাদের ফেরার তাগাদা দেয়া হলো। আমাদের গাইড বললেন, এবার ফিরতে হবে। পুরো দেয়ালই একই রকমের। তাই এখানে যা দেখছেন পাঁচ কিলোমিটার সামনে গেলেও তা–ই দেখবেন। তাই আর বেশি ঘোরাঘুরি না করে আমাদেরকে ফিরে আসতে বলা হলো। গাইড বললেন, বেইজিং শহর থেকে আমরা অনেকদূর চলে এসেছি। বিকেলে রাস্তায় প্রচুর ট্রাফিক। জ্যামও হবে। তাই সময় লাগবে। পথে দুপুরের খাবারও সারতে হবে।
গাইডের কাছে খাবারের কথা শুনে মনে হলো তীব্র ক্ষুধা লেগেছে। পাহাড়ের একটির পর একটি সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে ক্ষুধার তীব্রতা বেড়েছে। আমি বেশ দ্রুত ফিরতি পথ ধরে ক্যাবল কার স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। এখানেও ফিরতি মানুষের লম্বা লাইন। অনেকেই ফিরে যাচ্ছেন। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত টিকেট মিলে। কিন্তু সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি মহাপ্রাচীরে মানুষের আনাগোনা লেগে থাকে। যেনো মহাপ্রাচীর জুড়ে মানুষের মহামিলনমেলা! তাই এখানে সব সময় লাইন লেগে থাকে। টিকেট কাটা থেকে ক্যাবল কার কিংবা একটির পর একটি সিঁড়ি ভাঙ্গা সব জায়গা লাইন। লাইন ছাড়া এখানে কিছু করার কোন সুযোগ থাকে না। ফিরতি পথে ক্যাবল কারে চড়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছি আমরা। ক্লান্ত শরীরেও আমি ঘোরলাগা চোখে বার বার পেছনে ফিরছিলাম। যেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বের বিস্ময়, চীনের মহাপ্রাচীর।
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।