(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
বাস চলছিল। চীনের বেইজিং শহরের রাজপথ ধরে ছুটছে আমাদের বাস। চল্লিশ সিটের বেশ লম্বা ট্যুরিস্ট বাস। যাত্রীও কম নয়, দেশী বিদেশী পর্যটকে ঠাসা। বাসটির অর্ধেকেরও বেশি সিটে বসে আছেন নারী পুরুষ। যুবক যুবতীর সংখ্যাই বেশি। এদের কেউ কেউ হানিমুন করতে এসেছেন। তারা বাসের ভিতরেও এমনতর আচরণ করছিলেন যে, চোখ দেয়া যাচ্ছিল না। ট্যুরিস্ট বাস, সবাই ট্যুরিস্ট। সুতরাং কাউকে কেউ কিছু বলতেও পারছিলেন না।
আবার কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে গল্প করছিলেন। শুধু বাইরে চোখ দিয়ে অলস বসে আছি আমি একা। গল্প করার মতো আমার কেউ ছিল না। পরিচিত কেউ যেমন নেই, তেমনি ভাষার গোলমালও যোগাযোগের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হয়ে উঠেছিল। বাসের ট্যুরিস্টদের মধ্যে দুই তিনজন পশ্চিমা ছাড়া বাকিদের চীন এবং সন্নিহিত অঞ্চলের দেশগুলোর বাসিন্দা বলে মনে হচ্ছিল। যাদের কাছে আমার রক্তে কেনা বাংলা ভাষা ঠিক কতটুকু পরিচিত তা জানি না। তবে তারা যে ইংরেজীর ধার খুব একটা ধারে না তা বেশি টের পাচ্ছিলাম।
শহরের ভিতর দিয়ে চলতে চলতে হঠাৎ মনে হলো আমরা শহরের বাইরে চলে এসেছি। এতো বড় বেইজিং শহর পার হয়ে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমাদের। সময়ও তো অনেকক্ষণ হয়ে গেলো। আর কতদূর গেলে মহাপ্রাচীরের দেখা পাবো!
আরো অনেকক্ষণ গাড়ি চলার পর আমাদেরকে জানানো হলো যে মিনিট কয়েকের মধ্যেই আমরা পৌঁছে যাবো। আমরা ৮০ কিলোমিটারের পথ এসেছি বলেও জানানো হলো। শহর থেকে ৮০ কিলোমিটার! বেশ দূরেই তো।
আমাদের বাস থামলো। আমাদেরকে নামানো হলো। কিন্তু যেখানে নামলাম সেখান থেকে চীনের গ্রেটওয়াল দেখা গেলেও তা বেশ দূরে মনে হচ্ছিল। সুউচ্চ পাহাড়ের উপর গ্রেটওয়াল। হায়, আল্লাহ, এত উঁচুতে যাবো কি করে! এত পথ এসে যদি গ্রেটওয়াল ছুঁয়ে না দেখি তাহলে কী ভালো লাগবে? তীব্র গরম টের পাচ্ছিলাম। এতো গরমের মাঝে ঘামে গরমে কিছুটা দিশেহারা আমি। এর মাঝে মোটা শরীর নিয়ে পাহাড়ে চড়ে গ্রেটওয়াল স্পর্শ করা আদৌ সম্ভব হবে কিনা বুঝতে পারছিলাম না। তবে ইতোমধ্যে চীনে বেশ সুউচ্চ কিছু পাহাড়ে চড়েছি আমি। তাই এখানেও পাহাড়ে চড়ার ব্যাপারে মানসিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম।
আমি যখন ভিতরে নানাভাবে যোগ বিয়োগ করছিলাম তখন আমাদের গাইড মাইক হাতে নিয়ে আমাদের সকলকে একসাথে থাকার অনুরোধ করলেন। বললেন, আপনারা এখানে অপেক্ষা করবেন। আমি টিকেট নিয়ে ফিরছি। পাহাড়ে চড়তেও টিকেট লাগবে! ঘাটে ঘাটে পয়সা হাতানোর কল করে রাখা হয়েছে। অপেক্ষা করছিলাম। অল্পক্ষনের মধ্যেই গাইড ফিরে আসলেন এবং আমাদের প্রত্যেকের হাতে একটি করে টিকেট ধরিয়ে দিয়ে বললেন, সবাই আমাকে অনুসরণ করুন। এই মহিলা পাহাড়ে চড়বেন! এত উঁচু পাহাড়ে উঠবেন কি করে!
কিছুপথ এগুতেই আমরা লাইনে পড়ে গেলাম। আস্তে আস্তে এগুচ্ছিল লাইনটি। আমরা একটি লিফটে চড়লাম। একটি ভবনের কয়েকতলা উচ্চতায় গিয়ে নামার পর আবারো সামনে হাঁটলাম। আবারো চড়ানো হলো একটি লিফটে। ওরে বাবা, আমাদেরকে কি লিফটে চড়িয়ে সুউচ্চ পাহাড়ে নিয়ে যাবে! চীনের প্রযুুক্তি, কিছুই অসম্ভব নয়। আমরা যা কল্পনা করছি, তা চীন বাস্তবায়ন করছে অনায়াসে। যাক আমরা বিশাল একটি লিফটে ত্রিশ জনের মতো মানুষ। সবাইকে নিয়ে লিফট উপরে উঠছিল। লিফট থেকে বেরিয়ে আমার চক্ষু গোল হয়ে গেলো। আসলেই তো, চোখের সামনে ক্যাবল কার। আমরা ক্যাবল কার স্টেশনে উঠে এসেছি। এখান থেকে ক্যাবল কারে চড়িয়ে আমাদেরকে পাহাড়ের শীর্ষে নিয়ে গ্রেটওয়াল দেখানো হবে। বিশাল কর্মযজ্ঞ, বিশাল আয়োজন। সবই চলছিল একেবারে সুশৃঙ্খলভাবে। শত শত মানুষ, কিন্তু কোথাও কোন গোলমাল দেখছিলাম না।
লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন পর্যটক। ক্যাবল কারের এক একটি বক্সে চারজন করে পর্যটক দেয়া হচ্ছিল। লোক বোঝায় করার পর অপারেটর হালকা করে ঠেলে দিচ্ছিলেন, আর বনবনানীর উপর দিয়ে ক্যাবল কারটি দ্রুতবেগে পাহাড়ের দিকে ছুটে যাচ্ছিল।
দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রচুর ক্যাবল কারে চড়ার সুযোগ হয়েছে আমার। সব ক্যাবল কারের চেহারা এবং ধরণ প্রায় অভিন্ন। চীনের গ্রেটওয়ালে যাওয়ার ক্যাবল কারেও খুব বেশি নতুনত্ব নেই। তবে গতি একটু বেশিই মনে হলো। আমাদের বক্সের চারজনের মধ্যে বাকি তিনজনকে আমি চিনি না। তারা চীনা ভাষায় কিচির মিচির করছিল। আমি বাইরে চোখ দিয়ে ক্যাবল কারে বসে আছি। কারটি বেশ দ্রুত গতিতে সামনের দিকে যাচ্ছিল। বক্সের কাঁচের ভিতর দিয়ে বিপরীত পাশ থেকে আসা বক্সও দেখছিলাম, দেখছিলাম আমার সামনের বক্সও। কি করে যে তারের সাথে চারজন মানুষ নিয়ে এক একটি খাঁচা ঝুলছে! ভয় লাগছিল ছিঁড়ে পড়লে আস্ত আর কিছুই থাকবে না। শরীরের সাথে লোহার খাঁচাটিও যাবে।
আমি কাঁচের ভিতর দিয়ে নিচের দিকে তাকালাম। সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। ওমা, কী ভয়ংকর! মনে হলো শত সহস্র ফুট উপর দিয়ে ছুটছি। নিচের বন–বনানী, গাছগাছালী এবং পাহাড়গুলোকে অনেক দূরের মনে হচ্ছিল। আবার সাথে সাথে চোখ নিয়ে গেলাম সেখানে। দুর্বার এক আকর্ষণে ফিরে গেলো আমার চোখ। কী যে সবুজ নিচের পুরোটা দৃষ্টি জুড়ে। ভয়ংকর সুন্দর মনে হয় একেই বলে! কী যে সুন্দর, নিচের পাহাড় এবং বন–বনানীকে মনে হচ্ছিল বিছানা। সবুজ বিছানায় যেনো কোন অপরূপা বাসর সাজিয়েছে। দিগন্তবিস্তৃত সবুজের ছড়াছড়িতে মন ভালো হয়ে যাচ্ছিল।
আমাদের ক্যাবল কার পাহাড়ের শীর্ষে একটি স্টেশনে গিয়ে থামলো। আবারো একে একে নেমে আসলাম। ঘুরপথ সিঁড়ি পেরিয়ে আমরা গ্রেটওয়ালের কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। কিছু সিঁড়িপথ পার হয়ে কয়েক কদম এগিয়ে ছুঁয়ে দিলাম বহুল প্রত্যাশার গ্রেটওয়াল।
মহাপ্রাচীরে আমি! বিশ্বাস হচ্ছিল না। কি ভয়ই না পেয়েছিলাম। এতো মোটা শরীর নিয়ে পাহাড়ের এত উঁচুতে কি করে চড়বো তা নিয়েও শংকা ছিল। কিন্তু চীনের প্রযুক্তি সবকিছু এত সহজ করে দিয়েছে যে, এত সহজ না হলেই যেনো ভালো ছিল। আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত রোমাঞ্চিত। গ্রেটওয়ালকে যেভাবে কল্পনা করেছিলাম এটি তেমন নয়। এত বড় দেয়াল পাহাড়ের উপরে কি করে যে নির্মিত হয়েছিল কে জানে। দুনিয়ার সপ্তাশ্চর্যের প্রায় সব কটি আমার দেখা হয়েছে। আসলে এগুলো কোনটিই শুধু শুধু সপ্তাশ্চার্য ঠাঁই পায়নি। পরতে পরতে এত বিস্ময় না থাকলে সপ্তাশ্চার্য ঠাঁই পাওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু আমার মাথায় ঢুকছিল না যে, এত বিশাল প্রাচীরটি কি করে নির্মাণ করা হয়েছিল! এতো ইট সুরকি সিমেন্ট বালি কিংবা পাথর কি করে পাহাড়ের এত উঁচুতে তুলে আনা হয়েছিল। শুধুমাত্র দস্যুদের হাত থেকে নিজের দেশকে বাঁচানোর জন্য এমনতর আয়োজন দুনিয়ায় আর কোথাও আছে কিনা জানি না। তবে এটি যে দুনিয়াতে মানুষের তৈরি সবচেয়ে বড় স্থাপনা সেটি জানি। পৃথিবীর হাজার বছরের ইতিহাসে বহু কিছু নির্মিত হয়েছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত এত বড় অবকাঠামো আর কোথাও হয়নি। ট্যুরিস্ট হিসেবে আমি একা। তাই একটি ছবি তুলে দেয়ার জন্যও আমাকে অপরিচিত মানুষের সহায়তা নিতে হচ্ছিল। কখনো একে, আবার কখনো ওকে বলছিলাম একটি ক্লিক করে দিতে। চীনের গ্রেটওয়ালে দাঁড়িয়ে শত শত ছবি তুলেও আমার ছবি তোলার তৃষ্ণা মিটছিল না। মনে হচ্ছিল, এখান থেকে পোজ দিলে মনে হয় আরো একটু ভালো হবে। ওখান থেকে পোজ দিলে পুরো প্রাচীর দেখা যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে চীনের গ্রেটওয়াল এতো বেশি গ্রেট যে, এটির পুরোটা ছবিতে ধরা সম্ভব হচ্ছিল না। পুরো প্রাচীরের ছবি তোলা যেমন অসম্ভব তেমনি চারদিকে এটির যে সৌন্দর্য তা লিখে বুঝানোও সম্ভব নয়। আমি মুগ্ধ হয়ে অপার বিস্ময়ে চারপাশ দেখছিলাম। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।