(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
বাস থেকে নামতে গিয়ে মনে হলো পা ব্যাথা করছে। বুঝতে পারলাম যে ইউনিভার্সেল স্টুডিওতে হাঁটাহাঁটি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়েছে। তার ধকল তো কিছুটা সামলাতে হবে। আমি মোটা মানুষ, ওভারওয়েট। শরীরের ওজন মনে হয় আমার পা দুইটি ঠিকঠাকভাবে নিতে পারে না। তাই বেশি হাঁটলে পায়ের তলায় এক ধরনের ব্যথা হয়। তবে খুব বেশিক্ষণ এই ব্যাথা থাকে না, অসহনীয় বা ভয়ংকরও হয়না। তাই বিষয়টিকে পাত্তা না দিয়ে কিছুটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে লবিতে গিয়ে উঠলাম। এক ঝলক এদিক ওদিক তাকালাম। লবিতে অনেকেই বসে আছেন। রিসিপশনে বসে আছেন চ্যাপ্টা নাকের চার সুন্দরী তরুণী। অবশ্য আমার দিকে কারো কোন ভ্রুক্ষেপ দেখলাম না। আমি লিফট ধরে রুমে চলে আসলাম। ইলেক্ট্রনিক্স কী পকেটে থাকায় রিসিপশনের কারো সাথে কথা বলার দরকার ছিল না।
বাহ, মনটি ভরে গেল। সত্যিই রুমে এসে আমার মনটি ভালো হয়ে গেল। সকালে যাওয়ার সময় রুমের বাইরে ‘মেকআপ’ সাইন ঝুলিয়ে দিয়ে গিয়েছিলাম। তারা শুধু রুমটি গুছিয়েই দেয়নি, চমৎকার করে সাজিয়েও দিয়েছে। কাপল বেডের উপর এত সুন্দর করে হাঁস বানিয়ে রেখেছে যে, মনে হলো এখনি হাসটি ডানা মেলবে। শুধু বিছানাই ঘুচায়নি, সেন্টার টেবিলে দারুণ একঝুড়ি ফলও রেখেছে। দুইটি আপেল, দুইটি কমলা, কয়েকটি আঙ্গুর, দুইটি কলা রয়েছে ঝুড়িতে। পলিতে মোড়ানো ফলগুলো এত টাটকা দেখাচ্ছিল যে, মনে হচ্ছিল এখনি বুঝি গাছ থেকে ছিঁড়ে আনা হয়েছে।
রুমেই চা–কফি বানানোর সরঞ্জামসহ পুরো আয়োজন রয়েছে। গত দুইদিন ধরে আমি এসব খেয়ে দিব্যি আরামে আছি। প্রচুর চা কফির প্যাকেটের সাথে দুধ, চিনি এবং জিরো ক্যাল দিয়ে রাখা হয়। এগুলো সব তারকাখচিত হোটেলেই দেয়, রুম সার্ভিসের অংশ! এগুলোর জন্য বাড়তি কোন টাকা–কড়ি পরিশোধ করতে হয়না। কাপল রুমে দুজনে খেতে পারে এমন বেশি পরিমানে চা কফির সরঞ্জাম থাকে। যেহেতু আমি একা থাকছি তাই প্রতিটি জিনিসই তুলনামূলকভাবে বেশি মনে হচ্ছিল। ফলের ঝুড়িতে সবকিছু ডাবল দেয়ার মানেও সেটি।
বেশ জমিয়ে এক মগ কফি বানালাম। মগের সাইজ স্বাভাবিক হলেও আমি মগ উপচে পড়ে এমনভাবে পানি নিলাম। ডাবল ডোজ। কফি পাউডার এবং দুধও দিলাম ডাবল করে। সাথে জিরো ক্যাল মিশিয়ে সোফায় গিয়ে আয়েশ করে হেলান দিলাম। বাহ, দারুণ কফি বানাইতো। কখনো কফিশপ খুলে বসলে মন্দ হবে না! রিমোট হাতের কাছেই ছিল। টিপ দিতেই অন হয়ে গেল টিভি! বিশাল টিভি। রুমের সাইজ অনুযায়ী টিভিটি বেশ বড়। ছবি এবং সাউন্ড সবই একেবারে ঝরঝরে, পরিচ্ছন্ন। চাইনিজ কোম্পানির টিভিগুলো আমাদের দেশে এনে কেন যে এমন গোলমাল করে কে জানে!
একটির পর একটি চ্যানেল ঘুরাচ্ছিলাম। এখানে অন্য কেউ নেই যে কারো পছন্দ অপছন্দকে তোয়াজ করতে হবে। নিজের মনের মতো করে চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিলাম। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। সিনেমা নাকি নাটক কে জানে! খবরেরও কোন আগামাথা নেই। মনে হচ্ছিল নিয়ন্ত্রিত খবর তবে আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না। কিচির–মিচির টাইপের অনুষ্ঠানও চলছিল কোন কোন চ্যানেলে। এগুলো দেশি নাকি বিদেশী চ্যানেল কে জানে! বন্ধ করে দিলাম।
কফি শেষ হয়েছে আগেই। রাতও বেড়ে যাচ্ছে। ডিনার করতে হবে। কিন্তু কিভাবে করবো বুঝতে পারছিলাম না। ডিনার কি দিয়ে করবো তা নিয়েও চিন্তা করছিলাম। হোটেলের রেস্টুরেন্টে যাবো নাকি বাইরে গিয়ে খেয়ে আসবো ভাবছিলাম। বাইরে গিয়ে হোটেলই বা খুঁজবো কোথায়, কিসের অর্ডার করবো, কি বলবো কি বুঝবে তার কুলকিনারা করতে পারছিলাম না। আমার ইংরেজী– বাংলায় তারা কি বুঝবে বা কিছু না বুঝে যদি সাপ ব্যাঙ খাইয়ে দেয়!!
ইন্টারকমে হোটেলের রেস্টুরেন্টে কথা বললাম। বলা হলো যে, রেস্টুরেন্ট খোলা আছে, ডিনার করা যাবে। আমি রুমে খাবার পাঠানো যাবে কিনা জানতে চাইলাম। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে রুম সার্ভিস চালু আছে এবং রুমেই খাবার দেয়া যাবে বলে জানালেন। আমি শুধু ভেজিটেবল দিয়ে এক বাটি স্যুপ করে দিতে পারবে কিনা জানতে চাইলাম। পই পই করে বুঝিয়ে দিলাম যে, ভেজিটেবলের সাথে অন্য কিছু মেশানো যাবে না। আমাকে আশ্বস্ত করা হলো যে, তাদের শেফ খুব ভালো ভেজিটেবল স্যুপ করে। শুধু ভেজিটেবলই ব্যবহৃত হবে স্যুপে। অন্য কিছু দেয়া হবে না।
আমি রুমের সেন্টার টেবিলে থাকা ফ্রুটস বাস্কেটের পলিপ্যাক সরাতে লাগলাম। আপেল কমলা আঙ্গুর কলা– সবগুলোই স্বাস্থ্যকর ফল। এতগুলো ফল খাওয়া সম্ভব হবে না। তবুও আমি চার ধরনের ফল থেকেই কিছু কিছু খেলাম। বেশ নষ্টও করলাম। আহা, খাবার নষ্ট করতে বুকের ভিতরে গিয়ে লাগে। পৃথিবীতে কত মানুষ একটু খাবারের জন্য হাহাকার করে। কত কোটি মানুষ প্রতিদিন না খেয়ে ঘুমায়, কত লক্ষ শিশু একটু খাবারের জন্য কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে যায়! বড় নিষ্ঠুর পৃথিবী!
আমার ফল খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই কল বেল বেজে উঠলো। বুঝতে পারলাম যে, স্যুপ চলে এসেছে। দরোজা খুলতেই এক তরুণী ঘাড় বাঁকা করে অভিবাদন জানালেন। তিনি বেশ সুন্দর করে ঢেকেঢুকে স্যুপের বাটি ও বিল নিয়ে এসেছেন। টেবিলের উপর স্যুপের বাটি রেখে বিলটি আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। সাইন করে থ্যাঙ্কস বলে বিদায় করলাম। ফল খাওয়া শেষ করে স্যুপের ঘোমটা খুললাম। মুখে দেয়ার আগে চামুচ দিয়ে নাড়িয়ে বাটির তলায় পড়ে থাকা সবজিগুলো দেখলাম। না, সবই নানা ধরনের গাছগাছড়া, শিকড় বাকড়ের মতো। সবজিই মনে হয়। মাংস বা মাছ জাতীয় কিছু দেখা গেলো না। বেশ আশ্বস্ত হয়ে মুখে দিলাম। বাহ, দারুণ স্বাদ। চমৎকার ঝাল করে স্যুপটি তৈরি করা হয়েছে। রকমারি ফল এবং এক বাটি স্যুপে এত তৃপ্তি পেলাম যে, মনে হলো কোন রাজকীয় ডিনার সারলাম। নিজের শরীরও বেশি হালকা লাগছিল। ভাত খাওয়ার পর নিজেকে যেমন ভারি লাগে ফলাহারের পর তেমনটি লাগছিল না। অনেক বেশি হালকা মনে হচ্ছিল।
কফির সরঞ্জামের দিকে চোখ দিলাম। ভাত খাওয়ার পর চা কিংবা কফি না খেলে তো আমার ঘুম হয়না। অতএব ঘুমানোর জন্য হলেও চা খেতে হবে। দারুণ করে এক কাপ চা বানানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। চীনে ভালো চা পাতা হয়। তাদের চাও দুনিয়ার অন্যতম সেরা। কিন্তু চা বানাতে গিয়ে মনে হলো, দুধ কম। এত কম দুধ দিয়ে ভালো চা হবে না। দুধের আরো দুয়েকটি প্যাকেট পেলে ভালো হতে। ইন্টারকমে রুম সার্ভিসে ফোন করলাম। এক তরুণী ফোন ধরলেন। তাকে বেশ কষ্ট করে বুঝাতে সক্ষম হলাম যে, চা খাওয়ার জন্য আমার দুয়েক প্যাকেট দুধ লাগবে। পানি গরম হতে সময় লাগলো না। কিন্তু দুধের অপেক্ষায় থাকায় চা বানাতে পারছিলাম না। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। একটু পরেই দুধের প্যাকেট নিয়ে এক তরুণ হাজির হলো। দুধের বেশ কয়েকটি প্যাকেট একটি প্লেটে করে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরা হলো। যা চেয়েছিলাম তার থেকে ঢের বেশি প্যাকেট দেয়া হয়েছে। আমি মনে মনে সকালে এক কাপ বেড টি বানানোর প্ল্যানও করে ফেললাম।
ভালো করে ঘুমানোর কথা বলে গাইড আমাকে বিদায় দিলেও ঘুম তো দূর অস্ত! বিশাল বিছানায় বহুক্ষণ এপাশ ওপাশ করেও আমি নিদ্রাদেবীকে বশ মানাতে পারছিলাম না। কেমন যেন অনাহুত এক অস্থিরতায় ছটফট করছিলাম। জানালার ভারী পর্দা সরিয়ে বাইরে চোখ দিলাম। স্ট্রিট লাইটের আলোতে সবকিছু দেখা যাচ্ছিল। রেলওয়ে স্টেশনের কাছেই আমার হোটেল। তাই রাত বাড়লেও এলাকার রাস্তায় গাড়ি এবং মানুষের বেশ চলাচল ছিল।
সকালে আমাকে চীনের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা দেখাতে নিয়ে যাবে বলে গাইড বলেছিলেন। কোথায় যাবো কাল সকালে! একটি ট্যুর প্ল্যান থাকলে ভালো হতো। কিন্তু সেটি আমাকে দেয়া হয়নি। চট্টগ্রাম থেকে লায়ন আনোয়ারুল আজিম ভাই যে প্যাকেজ নিয়েছেন তাতে কি কি আছে কে জানে! আমি আজিম ভাইকে আর জিজ্ঞেস করিনি। কত টাকায় এই প্যাকেজ নেয়া হয়েছে তাও জানা হয়নি। পুরোপুরি ভাগ্যের উপর নিজেকে ছেড়ে দিয়েছি। তবে ইতোমধ্যে বেইজিং শহরে যা দেখেছি বা যা আমাকে দেখানো হয়েছে তা অতুলনীয়। একটি ট্যুর অপারেটেরের কাছে এর থেকে বেশি কিছু চাওয়ার থাকে না।
রাতের বেইজিং দেখে আসবো নাকি! বাইরে গিয়ে কিছুক্ষণ হেঁটে আসলে মন্দ হতো না। টাকা কড়ি কিংবা পাসপোর্ট রুমে রেখে রাস্তায় রাস্তায় কিছুক্ষণ হাঁটলে খারাপ লাগবে না। আমি হোটেলের একটি বিজনেস কার্ড সাথে নিয়ে বেরিয়ে আসলাম। জগিং ড্রেস পরিহিত আমাকে দেখে কেউই ট্যুরিস্ট ভাববে না। মনে হবে পাশের ভবনের স্থায়ী বাসিন্দা। ডিনারের পর কয়েক কদম হাঁটতে বেরিয়েছে। তাছাড়া আমার চেহারায় মঙ্গোলীয় একটি ভাব থাকায় চীনে কিছুটা বাড়তি সুবিধা পাবো বলেও মনে হচ্ছিল। চীনা ছিনতাইকারীরা অন্তত নিজেদের মানুষের পকেট হাতাবে না। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।