দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১০ মে, ২০২৩ at ৬:১৪ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

ঘোর লাগা চোখে সামার প্যালেসের হেথায় হোথায় ঘুরছিলাম। ‘ঘোর লাগা’ কথাটি যত সহজে লিখে দিলাম, বাস্তবে তত সহজ ছিল না। কি সর্বনাশা এক সৌন্দর্য যে চারদিকে তৈরি করা হয়েছে! কি করে যে এত নিখুঁতভাবে পাহাড়, লেক, দ্বীপ গড়ে তোলা হয়েছিল তা আমার মাথায় ঢুকছিল না। নান্দনিকতার ছড়াছড়িতে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছিল। আমার চোখে মুখে ভর করেছিল সাত রাজ্যের বিস্ময়! সত্যিই কী রাণীর জন্য এমন করে পাহাড় নদীসহ আস্ত এক জনপদ তৈরি করা হয়েছিল! শুধুমাত্র একজন রাণীর প্রতি ভালোবাসা দেখাতে সম্রাট এমন মাতোয়ারা হয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্ত পানি করে ফেলেছিলেন! আস্ত এক কৃত্রিম জনপদ তৈরি করেছিলেন শুধুমাত্র একজন নারীর জন্য! কিন্তু কী করে সম্ভব হয়েছিল প্রকৃতি নির্মাণের এমন মোহনীয় খেলা!

আগেই বলেছি বিশাল একটি লেক তৈরি করা হয়েছে। ছোটখাটো নদীর মতো। লেকের মাঝখানে চমৎকার একটি দ্বীপও বানানো হয়েছে। দ্বীপে বড়সড় অনেকগুলো গাছও রয়েছে। লেকের পানি টলটল করছে। ইচ্ছে করছে ঝাঁপিয়ে পড়ি। কিন্তু আমাদের ঝাঁপিয়ে পড়তে হলো না। ট্যুর অপারেটরের পক্ষ থেকে আমাদের লেক ভ্রমণের ব্যবস্থা রয়েছে। বেশ বসসড় একটি নৌকায় তোলা হলো আমাদের। ট্রলার টাইপের বোট, কাঠবডি। খুব সন্তর্পনে নৌকাটি চালিয়ে আমাদেরকে পুরো লেক ঘুরানো হলো। অনন্য সুন্দর লেকটির টলটলে পানি আমাদের মাতোয়ারা করে তুলছিল। এই লেকে কী রাণী সাঁতার কেটেছিলেন? সেই তথ্য কোথাও লেখা নেই। তবে রাজা এবং রাণী যে লেকের পাড়ে হাঁটাহাঁটি করতেন, কিংবা লেকের ঘাটে বানানো মার্বেল পাথরের জাহাজে বসে চা খেতেন তা আগেই লিখেছি।

আমরা অনেকক্ষণ ধরে নৌকা নিয়ে ঘুরলাম। আরো কয়েকটি গ্রুপের লোকজনও নৌকায় রয়েছেন। বিশ্বের নানা দেশের পর্যটকের মিলন মেলা হয়ে উঠা বোটটিতে কত ধরণের ভাষায় যে কথা হচ্ছিল তা বলে বুঝানো কঠিন। কোন কথা বুঝতে পারছিলাম না, তবুও সবাই যেনো কলকল করছিল। নানাজনের কথা না বুঝলেও একটি কথা বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, তারা সামার প্যালেসের এই লেকের সৌন্দর্য নিয়ে কথা বলছেন। তাদের চোখের মুখের বিস্ময় যেনো আমার মাঝে সংক্রমিত হচ্ছিল।

লেকের এপাড় ওপাড় ঘুরে আমাদেরকে ঘাটে এনে নামিয়ে দেয়া হলো। বলা হলো এখানে আমরা আরো কিছুক্ষণ থাকবো। আপনারা ঘুরে ফিরে দেখুন। আমাদের গাইড মিজ শিন চেন একটি সময় নির্দিষ্ট করে দিয়ে বললেন, এরমধ্যে ফিরে আসবেন। আমরা অন্য স্পটে যাবো।

সামার প্যালেস একসময় রাণীর মনোরঞ্জনে নির্মাণ করা হলেও পরবর্তীতে রাজ্য শাসনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল। এতে করে বহু স্থাপনা ও ঘরবাড়ি তৈরি করা হয়েছে। বাঘ সিংহসহ নানা ধরনের জন্তুর প্রতিকৃতিও রয়েছে নানা স্থানে। রয়েছে চীনের বিখ্যাত ড্রাগনের প্রতিকৃতি। আমি একা মানুষ, একা একা ঘুরছিলাম। প্রকৃতি এত নিবিড়ভাবে আমাকে ডাকছিল যে, কি করে যে পথের পর পথ মাড়িয়ে এত কিছু দেখছিলাম তা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। সামার প্যালেসের গাছগুলোও বিশাল। যেনো আকাশ ছুঁতে চাচ্ছে। বিস্তৃত হয়ে চারদিক ঢেকে ফেলেছে। এক একটি গাছ অত্যন্ত সুন্দরভাবে ঢালপালা বিস্তার করে ছায়া সুশীতল একটি আবহ তৈরি করে রেখেছে। লেক পাড়ের বড় বড় গাছগুলো যেনো সাঁতার কাটার জন্য বিগলিত। যে নারীর প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে সম্রাট এমন একটি লেক খনন করতে পেরেছিলেন কয়েকশ’ বছর পরে এসেও এক একটি গাছ যেনো সেই প্রেমকে কুর্ণিশ করতে মরিয়া!

অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আমি নির্দিষ্ট স্থানটিতে ফিরে এলাম। দেখলাম আমাদের গাইড একাই দাঁড়িয়ে আছেন। আমাদের দলের সদস্যদের অনেকেই তখনো ফিরেন নি। কাউকে কাউকে ধারে কাছে ছবি তোলায় ব্যস্ত দেখা গেলো। আমাদের দলটিতে জনা বিশেক নারী পুরুষ রয়েছেন। সকলেই তরুণ তরুণী। বিশ্বের নানাদেশ থেকে বেইজিং বেড়াতে এসেছেন তারা। ট্যুর অপারেটর থেকে প্যাকেজ কিনে দেখছেন বেইজিং এর দর্শনীয় স্থানগুলো। আমাদের গাড়িতে তোলা হলো। গাইড মিজ শিন চেন মাইক হাতে নিয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন লেগেছে আপনাদের? আমরা সমস্বরে চিৎকার করে অভিব্যক্তি প্রকাশ করলাম। যে অভিব্যক্তিই একটি কথাই জানান দেয় যে, ‘দারুণ, আমরা মুগ্ধ।’ আমরা অধিকাংশই ইংরেজিতে চিৎকার দিয়েছিলাম। কেউ কেউ চীনা ভাষায়ও নিজেদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে। আসলেই সামার প্যালেসের সৌন্দর্য মুগ্ধ হওয়ার মতো। এমন অসাধারণ একটি স্থান না দেখে চীন ছেড়ে গেলে খারাপ লাগতো।

আমাদের গাইড মিজ শিন চেনও আমাদের উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বসিত হলেন। বললেন, আপনাদের চমৎকার একটি জায়গা দেখাতে পেরে আমারও ভালো লাগছে। এখন আমরা এমন একটি জায়গায় যাবো যেখানে আপনাদের চোখ কপালে উঠে যাবে। রঙিন এক দুনিয়ায় নিয়ে যাবো আপনাদের। নিয়ে যাবো স্বপ্নের জগতে। আপনাদের অন্যরকম ভালো লাগবে। আমি ভিতরে ভিতরে আবারো পুলকিত হয়ে উঠছিলাম। আরো স্বপ্নের জগত আছে? সামার প্যালেসে যা দেখেছি একজীবনে এই স্মৃতি কোনদিন ম্লান হবে না, ভুলবো বলে মনে হয় না। নিজেকে বেশ ভাগ্যবান মনে হচ্ছে যে, এমন মন ভরানো স্মৃতি মানুষের জীবনে খুব বেশি থাকে বলেও আমার মনে হয় না। তবে আমি বুঝতে পারছিলাম না যে, এর থেকে এমন কি ভালো কিছু দেখাবে যে স্বপ্নের জগত বলা হচ্ছে! অবশ্য চীন বলে কথা! এদের স্বপ্নেরও অভাব নেই, অভাব নেই স্বপ্নের জগতের। নিজেদের স্বপ্নের মতো করে যা ইচ্ছে তা তৈরি করার ক্ষমতা এদের রয়েছে। আমি কিছু না বলে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

আমি আমার হোটেল কতদূর জানতে চাইলাম। গাইড বললেন, বেশ দূর। কেন? আমি ঠোঁট উল্টে বললামএমনিতেই।

আমার জন্য লায়ন আনোয়ারুল আজীম ভাই চীনের এই ট্যুর অপারেটরের কাছ থেকে প্যাকেজ কিনেছেন। এই প্যাকেজে কী আছে বা নেই সেটি আমি পুরোপুরি জানি না। কত টাকা দিয়ে কিনেছেন সেটাও জানি না। আমি দেশে ফিরে আজিম ভাইকে টাকা দেবো। এখন এসব নিয়ে আমাকে কোন ঝামেলা পোহাতে হবে না। ইউনিভার্সেল স্টুডিও দেখার বা বেড়ানোর জন্য নিঃসন্দেহে একটি দারুণ জায়গা। প্রথম দেখায় ভালোই লাগে। তবে বার বার দেখতে ভালো লাগবে বলে আমার মনে হচ্ছিল না। তাছাড়া পুরো ব্যাপারটি এত অলীক যে আমার সত্যি সত্যি আর স্টুডিওতে যেতে ইচ্ছে করছিল না। আমার হোটেল যদি কাছে হতো তাহলে আমি এখানে নেমে কোন একটি ব্যবস্থা করে হোটেলে চলে যেতাম। কিন্তু অনেক দূর বলায় সেটি সম্ভব হচ্ছে না। তাই অনেকটা মন খারাপ করে বসে থাকলাম।

শহরের রাস্তা দাবড়িয়ে ছুটছে আমাদের বাস। গন্তব্য ইউনিভার্সেল স্টুডিও। সেটি কতদূর কে জানে। একটি রাস্তাও চিনি না। একটি দোকানের নামও পড়তে পারছি না। একটিও পরিচিত মানুষ নেই ধারে কাছে। মন খুলে গল্প তো দূরের কথা, দুয়েকটি কথা বলার মতোও কেউ নেই। এর থেকে অসহায় অবস্থায় কি কখনো পড়েছিলাম! (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅহংকার সমাজের একটা বড় শত্রু
পরবর্তী নিবন্ধস্মৃতিতে অম্লান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ