দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২৬ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:৫০ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

কোথায় যাচ্ছি বুঝতে পারছিলাম না। আমাদের গাইড মিজ শিন চেন বললেন, সামার প্যালেস দেখতে যাচ্ছি। ‘সামার’ মানে গ্রীষ্মকাল, ‘প্যালেস’ মানে প্রাসাদ! গ্রীষ্মকালের প্রাসাদ দেখতে যাচ্ছি এটুকু বুঝলেও আসলে প্রাসাদটি কত বড়, সেখানে কি আছে, আমরা প্রাসাদের ভিতরে ঢুকতে পারবো কিনা নাকি বাইরে থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসা হবে তার কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। বেড়াতে এসেছি, তাই বেড়াচ্ছি। বেইজিং এর কিছুই যেহেতু চিনি না তাই কোত্থেকে কোথায় যাচ্ছি তা নিয়ে মাথা ঘামানোরও সুযোগ ছিল না। বাস চলছে। জানালায় চোখ রেখে বসে আছি। রাস্তা জুড়ে শত সহস্ত্র গাড়ি, অগুনতি মানুষ। রাস্তার পাশের চওড়া ফুটপাত ধরে এত বেশি লোক চলাচল করছে যে আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে যাচ্ছিল। আমাদের গার্মেন্টস শ্রমিকেরা যেভাবে পুরো রাস্তা দখল করে পথ চলেন, এখানেও তেমনি। পার্থক্য হচ্ছে আমাদের শ্রমিকেরা চলেন রাস্তার পাশ দিয়ে, মাঝ দিয়ে। এখানে চলছে ফুটপাত দিয়ে। একজন মানুষও মূল রাস্তায় নেই। রাস্তা গাড়ি চলার জন্য, আর ফুটপাত মানুষের হাঁটার জন্য। রাস্তা এবং ফুটপাত যে আলাদা কাজে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়েছে সেটি চীন নিশ্চিত করেছে। অবশ্য এখানে ফুটপাতজুড়ে কোন দোকান পাটও দেখা গেলো না! আরো একটি ব্যাপার খেয়াল করলাম যে, আমাদের গার্মেন্টস শ্রমিকদের প্রায় শতভাগই নারী। এখানে নারী পুরুষ প্রায় সমান সমান। পুরুষের পাশাপাশি ঘরবন্দি নারীদের বের করে উৎপাদনমুখী কাজে লাগানো গেলে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। যেমনটি হয়েছে চীনে।

তবে ফুটপাত ধরে ছুটে চলা মানুষগুলো গার্মেন্টস শ্রমিক কিনা সেটি আমি নিশ্চিত নই। ঢল নামা তরুণ তরুণীদের পোশাকপরিচ্ছদ খুই পরিপাটি, আমাদের গার্মেন্টস শ্রমিকের মতো বিবর্ণ নন। চীনের গার্মেন্টস শ্রমিকদের অবস্থা অনেক ভালো। তবুও ফুটপাত ধরে হেঁটে চলা সুসজ্জিত মানুষগুলোকে গার্মেন্টস শ্রমিক বলে মনে হচ্ছিল না। এরা কী বিভিন্ন কর্পোরেট অফিসে কাজ করেন! ব্লেজার পরিহিত বেশ কয়েকজন নারীকে দেখলাম ছুটে চলেছেন। এই পোশাকে গার্মেন্টসে যাওয়ার কথা নয়। নাকি চীনের গার্মেন্টস শ্রমিকেরাও আমাদের দেশের অফিসারদের মতো বেতন বোনাস পান, অফিসারদের মতোই চলাফেরা করেন!

রাস্তার দু’পাশের সুউচ্চ ভবনগুলো আমার চোখ টানছিল। কী যে সুন্দর এক একটি ভবন, কী যে পরিপাটি! ঠিক যেনো ফুটপাত ধরে ছুটে চলা তরুণীদের মতোই সুসজ্জিত!

দেখতে দেখতে পথ চলছিলাম। আমরা কী শহরের বাইরে চলে যাচ্ছি। অনেকক্ষণ ধরে গাড়ি চলছে, অনেক পথ পাড়ি দিয়েছি। কিন্তু সামার প্যালেসের দেখা এখনো মিলেনি। সেটি কতদূরে কে জানে!! রাস্তার পাশে চমৎকার একটি খাল। মিজ শিন চেন বললেন, কৃত্রিম এই খাল নৌ চলাচলের জন্য খনন করেছিলেন সম্রাট। কয়েকশ’ বছর আগের খালটির এখনো দারুণ নাব্যতা রয়েছে। এই খালে এখনো নৌকা চলে। অদূরে পাহাড় দেখা যাচ্ছিল। ঘন বনানীতে ঢাকা সবুজ পাহাড়। আহ, কী সুন্দর!

আমাদের বাস থামলো। একে একে বাস থেকে নামলাম আমরা। আমাদের গাইড মিজ শিন চেন বাস থেকে নামার সাথে সাথে আমাদের সকলকেই জড়ো করে হ্যান্ডমাইক নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। তিনি বললেন, এটি অনেক বড় জায়গা। অনেক সুন্দর জায়গা। আপনারা ঘুরে দেখলে বুঝতে পারবেন। আমরা ঘুরবো। সম্রাটেরা যে পথে ঘুরতেন আমরাও সেখানে হাঁটবো, নৌকায় চড়বো। রাণী যেখানে হাওয়া খেতেন আমরাও সেখানে হাওয়া খাবো। রাণী যে মন্দিরে পূজো করতে পাহাড়ে যেতেন আপনারা চাইলে সেখানেও যেতে পারবেন। কিন্তু সবাই একই সাথে থাকবেন। বোটে চড়তেও একই সাথে চড়বেন, লেকে ভাসতেও একই সাথে ভাসবেন। দলছুট হলে আপনাদের খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। এটি অনেক বড় একটি জায়গা, অনেক লোকজন। কেউ হারিয়ে গেলে তাকে খুঁজে নেয়া কঠিন হবে।

সামার হিলে পা দিয়েই একটি কথা আমার মনে হলো যে,

শুধু মোগল বা অটোম্যানই নয়, যুগে যুগে সব রাজা বাদশাহই ভোগ বিলাসে মত্ত ছিলেন। চীনের সম্রাটদের সামার প্যালেস দেখার পর এরাও কম যেতেন বলে মনে হয়নি। রানী বৈকালিক চা খেতেন সাদা মার্বেল পাথরের তৈরি অনন্য সুন্দর একটি জাহাজে। জাহাজটি ভাসছে একটি কৃত্রিম লেকে। পাথর কেটেকুটে বাড়ি ঘর করতে দেখেছি, কিন্তু শ্বেত পাথর দিয়ে যে আস্ত জাহাজ বানানো যায় তা চীনে সামার প্যালেসে প্রথম দেখলাম। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ধবধবে সাদা পাথরের সেই বোট কৃত্রিম লেকে ভাসছে! শুধু কী পাথরের বোট বা জাহাজ! এই জাহাজে রাণী প্রতিদিন বিকেলে চা খেতেন। সম্রাটের সাথে সময় কাটাতেন। আর রাণীকে বোটে আনা হতো পাল্কিতে চড়িয়ে। বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা একটি করিডোর ধরে পাল্কিতে চড়ে জাহাজে চড়তেন রাণী। ৭২৮ মিটার বা ২ হাজার ৩৮৮ ফুট লম্বা করিডোর ধরে রানীকে পাল্কিতে চড়িয়ে এই বোটে আনা হতো! লেকের পাড় ধরে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে পাল্কিতে চড়ে রাণী আসতেন জাহাজে। সেখানে আয়েশ করে চায়ে চুমুক টুমুক দিয়ে রাণী আবারো ফিরতি পথে প্রাসাদে ফিরতেন। মোগল সম্রাটদের বহু ভোগ বিলাসের কাহিনী আমাদের শোনা আছে, কিন্তু চীনা সম্রাটের ভোগ বিলাসের অবস্থা বুঝাতে আর কোন তথ্যের কি দরকার আছে! ছিন রাজবংশের প্রথম সম্রাটের এমনতর বিলাসিতার আরো বহু ঘটনা রয়েছে।

প্রেমাতুর সম্রাটের রাণী বন্দনার আরো তথ্য আছে!

রাণীর খুব ইচ্ছে করছিল বাপের বাড়ি যেতে। বাপের ভিটিতে গিয়ে জন্মস্থানে খোলা হাওয়ায় চুল উড়িয়ে ঘুরে বেড়াতে। খুব ইচ্ছে করছিল নদীর ঘাটে পা ডোবাতে। নৌকায় ভাসতে ভাসতে গান শুনতে। পাহাড়ের বন বনানীতে পাখীর কলকাকলীতে মন রাঙাতে। ইচ্ছে করছিল বাড়ির পাশের বাজারে গিয়ে ইচ্ছে মতো কেনাকাটা করতে। আরো কত কত্ত ইচ্ছে যে রাণীর করছিল! একজন কিশোরীর যা যা ইচ্ছে করে তার সবই রাণী করছিল। সম্রাটের সাথে বিয়ে হওয়ার পর প্রাসাদবন্দি রাণীর ইচ্ছে করছিল খোলা চত্বরে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নিতে।

কিন্তু সেই গ্রাম থেকে তুলে আনা কিশোরীতো এখন আর শুধু একজন কিশোরী বা তরুণী নয়। তিনি এখন সম্রাজ্ঞী, সম্রাটের প্রিয়তমা স্ত্রী। তাই রাণীর আকাশ বাতাস একাকার করতে উতাল পাথাল ইচ্ছেগুলোয় বাধা হয়ে দাঁড়ায় সম্রাটের অনিচ্ছা। সম্রাটের এক কথা, বাপের বাড়ি যাওয়া আসায় বহু বহুদিন সময় লেগে যাবে। অন্তত ছয় মাস। অতদিন রাণীকে ছাড়া থাকতে পারবেন না তিনি। বিয়ের পর এত বাপের বাড়ি বাপের বাড়ি করেই বা লাভ কি!! সম্রাটের পাগলকরা ভালোবাসার কাছে রাণীর ইচ্ছেগুলো ডানা ঝাপ্টায়, কিন্তু কিছুই করার থাকে না।

সময় গড়িয়ে যায়। পার হতে থাকে মাস। এক একটি বছর। রাণীর বাপের বাড়ি আর যাওয়া হয়ে উঠে না। এখন আর রাণী বাপের বাড়ি কথা বলেনও না। সম্রাটকে রেখে বাপের বাড়িতে যাওয়ার কথা বলতেও রাণীর কেমন কেমন লাগে! বাপের বাড়ির স্মৃতিগুলো আস্তে আস্তে ফিকে হতে শুরু করে। রাণীকে বাপের বাড়ি পাঠানোর ব্যাপারে সম্রাটও কিছু বলেন না, রাণীওরা করেন না। ততদিনে রাণী বুঝে গেছেন যে, তার জন্য পাগল হয়ে থাকা সম্রাট তাকে এতদিনের জন্য বাপের বাড়ি যেতে দেবেন না। তো মেনে নেন রাণী। কিছুই যেখানে করার নেই সেখানে জবরদস্তী করেই বা কি হবে। প্রাসাদেই থাকেন রাণী। সম্রাটের সাথে সময় কাটান, নিজেদের মতো করে আনন্দে ভাসেন। রাণী যখন বাপের বাড়ির কথা ক্রমে ভুলে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনি একেবারে আচমকা যেনো বসন্ত দেখা দেয় ফরবিডেন সিটির প্রাসাদে। একেবারে হঠাৎ করেই সম্রাট রাণীকে ডাকলেন। কাছে বসিয়ে আদর করে বললেন, ‘যাও, এবার বাপের বাড়ি থেকে ঘুরে আস।’ নিশ্চয় বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য তোমার প্রাণটা আনচান করছে। রাণী কিছুটা হোঁচড় খেলেন! হয়তো চমকেও উঠেছিলেন! সম্রাটের ভালোবাসা কি কমে গেল! নতুন কারো হদিশ পেয়েছেন সম্রাট! প্রাসাদে তো আর সুন্দরী তরুণীর অভাব নেই, গিজগিজ করে। দাসী উপপত্নীরা সম্রাটের সান্নিধ্যের আশায় থাকে। সম্রাটের কী কাউকে ভালো লেগে গেছে! পুরুষ মানুষের কখন যে কাকে ভালো লেগে যায় তার কী ঠিক আছে! (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগাছ লাগাই পরিবেশ বাঁচাই
পরবর্তী নিবন্ধপংকজ ভট্টাচার্য : ত্যাগী ও শুদ্ধ রাজনীতির বিরল প্রতিকৃতি