দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১৯ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:২৭ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

স্যান্ডউইশ দিয়ে ডিনার সারলাম। ভেজিটেবল স্যান্ডউইশ। কিন্তু মাঝে আকৃতির স্যান্ডউইশটি খেয়ে আমার মন এবং পেট কোনটিই ভরলো না। খুবই অসহায় লাগছিল। দিনভর সবাই দলবেধে ঘোরাঘুরি করলেও রাতে এসে নিজের বড় বেশি একা একা লাগছিল। একটি কফি দেয়ার অনুরোধ করলাম, ক্যাপাসিনো। ধুমায়িত কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে টের পেলাম যে চীনে খাওয়া দাওয়া আসলেই বিরাট এক সমস্যা। ভাষা রপ্ত কিংবা স্থানীয় কেউ না থাকলে একা একা চীন ভ্রমণ খুবই কঠিন। অখাদ্য কুখাদ্য থেকে নিজেকে রক্ষা করে ঠিকঠাকভাবে বেঁচে থাকা বা খাওয়া দাওয়া করা যে কত কঠিন তা স্যান্ডউইশে ডিনার সারার আগ পর্যন্ত আমি টের পাইনি। আমার অসহায় ভাব দেখে হোটেলের ওয়েটার মেয়েটিরও বুঝি করুণা হচ্ছিল। আর কোনভাবে সাহায্য করতে পারেন কিনা মাথা ঝুকিয়ে জানতে চাইলেন তিনি। আমি মাথা নাড়লাম। রুম নম্বর বলে বিলে সাইন করে দিয়ে বেরিয়ে আসলাম।

রুমে এসে মনটি ভালো হয়ে গেল। অপ্রত্যাশিত এক প্রাপ্তি আমার মনটি ভালো করে দিল। কিন্তু ব্যাপারটি কী করে ঘটলো তা বুঝতে পারছিলাম না। রুমের সেন্টার টেবিলের উপর দারুণ একটি ফ্রুটস বাকেট। ঢাউশ সাইজের একটি কমলা, একটি আপেল এবং দুইটি কলার সাথে গোটাকয়েক আঙ্গুর। এই ধরনের ফ্রুটস বাকেট সকালের দিকে রুম ফ্রেশ করার পর দেয়। এখন এই রাতে কেন দিল? নাকি সকালে দিয়ে গিয়েছিল? কিন্তু আমি যখন বাইরে থেকে এসে রুমে ঢুকলাম তখন তো চোখে পড়েনি! নাকি খেয়াল করিনি!! বুঝতে পারছিলাম না।

রেস্টুরেন্টের মেয়েটি রুম সার্ভিসকে বলে কিছু করেন নি তো!! আমার যে ডিনার হয়নি তা মেয়েটি বেশ বুঝতে পেরেছেন। তাই বিশেষ দয়া দেখিয়ে রুম সার্ভিসকে বলে ফ্রুটস বাকেটের ব্যবস্থা করেছেন কে জানে! অবশ্য, মাত্র দুই তিনদিনের কোন কাস্টমারের প্রতি হোটেল কর্তৃপক্ষের এমন সদয় হওয়ার কথা নয়। নিশীরাতে এমন দয়াপরবেশ হয়ে ফল কেন পাঠানো হলো তা অনেক ভেবে চিন্তেও কিছু বুঝতে পারছিলাম না। আমি বেশ আয়েশ করে কমলার খোসা ছড়াতে শুরু করলাম। হৃষ্টপুষ্ট এক এক একটি কোষ আলতো আলতো করে খাচ্ছিলাম। টিভি চলছিল। দারুণ মারদাঙ্গা একটি ছবি দেখে একটু নড়ে চড়ে বসলাম। চীনারা সাংঘাতিক কংফুকারাতে জানে। হালকা পাতলা শরীর নিয়ে যেভাবে কসরত করছিল তাতে মেয়েটির শরীরে হাড্ডি আছে বলে মনে হচ্ছিল না।

কখন যে কমলার পুরোটা শেষ হয়ে গেছে টের পাইনি, আপেলও খেয়ে ফেললাম। কলাও খেয়ে ফেলতাম, কিন্তু রাতের বেলা নাকি কলা খাওয়া ঠিক নয়। মরুব্বীদের বলা কথাটি মানতে গিয়ে কলা দুইটি অনাদরে পড়ে থাকলো।

ফল খাওয়ার পর মনে হলো বেশি হয়ে গেছে। এত বেশি খাওয়া ঠিক হয়নি। ডিনার করতে না পারার যে কষ্ট ছিল তা উবে গেছে। আমি রুমে কফি খাওয়ার উদ্যোগ নিলাম। রুমের কফি মেকার থেকে হু হু করে ধোঁয়া বের হচ্ছিল, একই সাথে হু হু করে উঠছিল আমার অন্তর। নিজের স্বজন প্রিয়জনদের জন্য বুকের ভিতরটা কেমন যেনো করছিল।

মোবাইল বাজছিল। এতরাতে আবার কে ফোন করলো ? ‘হ্যালো’ বলতেই অপর প্রান্ত থেকে মিজ পিনং অপরাধীর মতো কণ্ঠে বললেন, ঘুমিয়ে গেছেন? আমার আরো আগে করা উচিত ছিল? সরি, দেরি করে ফেলেছি! ডিনার করেছেন? আমি কফি খাচ্ছি বলার পর তিনি যেনো কিছুটা আশ্বস্ত হলেন। তবে ঘুমের বারোটা বেজে যাবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন। বললেন, এত রাতে কফি খাওয়া ঠিক নয়। আমি যখন বললাম যে, কফি না খেলেই বরং আমার ঘুমের বারোটা বাজতোতখন পিনং কলকল করে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘যাক, যে জন্য ফোন করা। আপনাকে সকাল ৭টায় নয়, ৮টার সময় আমাদের বাস তুলে নেবে। রেডি থাকবেন।’

আমার জন্য সুবিধা হলো। আগে বলেছিল সকাল ৭টায় বাস আমার হোটেলের সামনে পৌঁছাবে। তাতে আমার ব্রেকফাস্টের অসুবিধা হতো। রিকুয়েস্ট করে আর্লি ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করতে হতো। এখন বাস ৮টায় হওয়ায় আমি বেশ আয়েশ করে নাস্তা করতে পারবো। ডিনারে যে বেহাল দশা গেছে তাতে সকালের ব্রেকফাস্ট স্বস্তির সাথে করতে না পারলে ভয়াবহ রকমের কষ্ট হবে, মন খারাপ হবে। বাস দেরি হওয়ায় মন ভালো করে দেয়ার মতো ব্রেকফাস্ট হবে। অতএব বাসের দেরি হওয়ায় মনে মনে পিনংকে ধন্যবাদ দিলাম।

ওয়েক আপ কলে যখন ঘুম ভাঙলো তখনও শরীর বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না। ফ্রেশ হওয়ার পরও কেমন যেনো আলসে ভর করে রাখলো। ব্রেকফাস্ট সার্ভ হবে সকাল ৭টায়। এখনো হাতে পনের মিনিটেরও বেশি সময় রয়েছে। রুমে চা কফি বানানোর সব আয়োজনই রয়েছে। আমি এক কাপ চা বানিয়ে চুমুক দিয়ে আলসে তাড়ানোর চেষ্টা করছিলাম। নির্দিষ্ট সময়ে রেস্টুরেন্টে গিয়ে হাজির হলাম। ব্যুফে ব্রেকফাস্ট, হরেক আয়োজন। নাস্তা নেয়ার আগে শুরুতে এক চক্করে সবকিছু দেখে নিলাম। এলাহী আয়োজন। রকমারি পদের খাবার থরে থরে সাজানো। আমি ঘুরেফিরে দেখলাম। অনেকগুলো খাবার চিনতে পারলাম। ব্রেড বাটারের সাথে ডিম, সালাদ, ছোলা, বিভিন্ন ধরনের বীজ, বাদামসহ হরেক খাবারের ছড়াছড়ি। রয়েছে কমলা আপেল কলা নাসপাতি আঙ্গুর ডালিমসহ প্রচুর ফল। ভাতের সাথে বেশ কয়েক ধরনের মাছ। সাত সকালে মাছ ভাত কে খাবে!! আমি ঘুরে ফিরে যা বুঝলাম তাতে অচিন খাবার থাকলেও যা আছে তা দিয়ে অনায়াসে এবং আয়েশের সাথে ব্রেকফাস্ট করা যাবে। আমি এক গ্লাস ফ্রেশ জুস নিয়ে টেবিলে রাখলাম। পরে প্লেটে খাবার নিয়ে নাস্তা করতে শুরু করলাম।

নাস্তার জন্য এক ঘন্টা অনেক সময়। এত সময় ধরে খাওয়া যায় না। আমি রয়ে সয়ে খাচ্ছিলাম। নাস্তা শেষে কফিও খেলাম। ঘড়ির কাঁটা ৮টা বাজার মিনিট পাঁচেক আগে আমি দ্বিতীয় মগ কফি নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আসলাম। নিচতলায় হোটেলের লবিতে আমি বাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম রমজানের তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ নামাজ
পরবর্তী নিবন্ধচিরঞ্জীব নাসিমুল গণি