দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও প্রশাসন গড়তে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে

| বৃহস্পতিবার , ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৯:৩১ পূর্বাহ্ণ

জার্মানভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইএর দুর্নীতির ধারণাসূচক (করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স বা সিপিআই)-২০২৪ সালের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় গত মঙ্গলবার। এতে বলা হয়েছে, দেশে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে দুর্নীতি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির স্কোরে আরও পিছিয়েছে বাংলাদেশ। ১০০ নম্বরের মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ২৩। এ স্কোর ১৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ১৮০টি দেশের মধ্যে ২০২৪ সালে অধঃক্রম অনুযায়ী (খারাপ থেকে ভালো) বাংলাদেশের অবস্থান ১৪তম। সূচকের উচ্চক্রম অনুযায়ী (ভালো থেকে খারাপ) অবস্থান ১৫১তে নেমেছে। অর্থাৎ দুর্নীতি মূল্যায়নের তিনটি সূচকই বলছে, দুর্নীতি বাড়ছে।

বাংলাদেশে টিআইএর সহযোগী প্রতিষ্ঠান টিআইবি নিজস্ব কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তার মতে, ৫ আগস্টের পর দেশে চাঁদাবাজি চলছে। তবে ব্যানারের পরিবর্তন হয়েছে। এছাড়া দেশ থেকে অর্থ পাচারের অন্যতম গন্তব্য ভারত। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, বাংলাদেশের এ অবস্থান এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পঞ্চম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয়। এছাড়া বিশ্বে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দক্ষিণ সুদান এবং সবচেয়ে কম ডেনমার্ক। দুর্নীতি প্রতিরোধে বেশকিছু সুপারিশ করেছে টিআই। এগুলো হলোদুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দুদককে আরও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া এবং অবাধ গণমাধ্যম ও সক্রিয় নাগরিক সমাজ বিকাশে উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা।

টিআইএর প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে বলা হয়, সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ১৪তম। আগের বছর যা ছিল দশম। বাংলাদেশের চার ধাপ এগিয়ে যাওয়ার কারণ এ দেশে দুর্নীতি কমেছে, তা নয়। বরং অবস্থা খারাপ হয়েছে। গত বছর বেশি নম্বর পেয়েও বাংলাদেশের অবস্থান ছিল পেছনে। এ বছর কম নম্বর পেয়েও বাংলাদেশ ৪ ধাপ এগিয়েছে। এর কারণ হলোঅন্যান্য কয়েকটি দেশের অবস্থান খারাপ হয়েছে। ফলে তারা বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়েছে। এতে বাংলাদেশ সামনে এগিয়েছে। কিন্তু সামগ্রিক মূল্যায়নে বাংলাদেশ আগের বছরের চেয়ে নম্বর আরও কম পেয়েছে। অন্যদিকে উচ্চক্রম অনুসারে বাংলাদেশ দুই ধাপ পিছিয়েছে। ১৮০টি দেশের মধ্যে আলোচ্য বছরে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫১তম। ২০২৩ সালে যা ছিল ১৪৯তম।একই স্কোর নিয়ে তালিকার উচ্চক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ অবস্থানে কঙ্গো ও ইরান। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ পঞ্চম। এর আগে রয়েছে সিরিয়া, মিয়ানমার ও উত্তর কোরিয়া। সিপিআই অনুযায়ী, দুর্নীতির ধারণার মাত্রাকে ০ (শূন্য) থেকে ১০০ (একশ)-এর স্কেলে নির্ধারণ করা হয়। এ পদ্ধতি অনুসারে স্কেলের ০ (শূন্য) স্কোরকে সর্বোচ্চ এবং ১০০ স্কোরকে সর্বনিম্ন দুর্নীতি বলে ধারণা করা হয়। ২০২৪ সালে ১০০ স্কোরের মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২৩, আগের বছর পেয়েছিল ২৪। এর মানে হলো, দুর্নীতি বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশের স্কোর ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে এক ধাপ কমেছে। সিপিআই অনুসারে, ১০০ স্কোরের মধ্যে বৈশ্বিক গড় স্কোর ৪৩। সেখানে বাংলাদেশ পেয়েছে ২৩ অর্থাৎ বৈশ্বিক গড় স্কোরের তুলনায় বাংলাদেশ ২০ নম্বর কম পেয়েছে। এছাড়াও ২০১২ সালের পর অর্থাৎ ১৩ বছর পর এবার সর্বনিম্ন স্কোর।

দুর্নীতি আমাদের দেশের বড় সমস্যা হিসেবে বিবেচিত। দুর্নীতির মাধ্যমে অনেকের সীমাহীন সম্পদ গড়ার খবর দেশের মানুষের কাছে অস্বস্তিকর ধারণার জন্ম দিয়েছে। এদের দুর্নীতির খবর প্রকাশ হয়ে যাওয়ার কারণে জনসাধারণ তাদের বিষয়ে অবগত হয়েছেন। অনেকের ধারণা, দেশের অভ্যন্তরে এরকম অনেক দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ আছেন, যাদের জন্য দেশের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দুর্নীতির মাধ্যমে যারা সম্পদশালী হচ্ছেন কিংবা হয়েছেন, তাদের ব্যাপারে খোঁজখবর অব্যাহত রাখলে দেখা যাবেএকদিন না একদিন আসল তথ্য প্রকাশিত হয়ে যাবে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, দুর্নীতি আমাদের রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমনভাবে সংক্রমিত দুরারোগ্য ক্যানসারের মতো বিস্তার লাভ করছে যা থেকে বিপজ্জনক অস্ত্রোপচারের পরও আরোগ্য লাভ কষ্টসাধ্য। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সর্বত্র এ সমাজব্যাধি শক্ত শেকড় গেড়ে বসেছে। বিস্ময়ের ও একই সঙ্গে পরিতাপের বিষয় এই যে ব্যবসায়ী সমপ্রদায়ও ইদানীং অল্প কয়েকটি সমাজ প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোনো সামাজিক সংগঠন বা সুশীল সমাজের সদস্য কেউ প্রকাশ্যে এ কথা স্বীকার করছেন না যে আমাদের গোটা সমাজ অসম্ভব রকমের দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে, আমরা মারাত্মক সামাজিক ব্যাধিতে ভুগছি।

দুর্নীতি এমন এক ভয়ংকর সামাজিক ব্যাধি, যা নির্মূল করা মোটেই সহজ কাজ নয়। তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপামর জনসাধারণ দাঁড়ালে বা ভূমিকা পালন করলে দুর্নীতি নামক গভীর দুষ্টক্ষতের বিস্তার রোধ করা মোটেই অসম্ভব কাজ নয়। এছাড়া সরকার ও সুশীল সমাজের দুর্নীতি প্রতিরোধে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ, নতুন নতুন সামাজিক মূল্যবোধ, সুশাসন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দুর্নীতি বহুলাংশে কমিয়ে আনা যাবে। আমরা মনে করি, দুর্নীতি দমন বিষয়টি সকলের দায়িত্ব হওয়া উচিত। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও প্রশাসন গড়তে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে সনিষ্ঠ আন্তরিকতায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে