সমপ্রতি দুর্নীতির বিষয়ে কঠোর বার্তা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে সরকার প্রধান বলেছেন, সে যে–ই হোক, দুর্নীতি করলে কারও রক্ষা নেই। যারাই দুর্নীতি করবে, আমরা তাদের ধরব। গত শনিবার জাতীয় সংসদে শুরু হতে যাওয়া ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের সাধারণ আলোচনায় দৃঢ়তার সঙ্গে এ কথা বলেন তিনি। বাংলাদেশের জনগণকে কর্মঠ ও সৃজনশীল আখ্যা দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, (জনগণের মধ্যে) কিছু কিছু মাঝখানে দুষ্টু প্রকৃতির থাকে; ওগুলোকে ধর্তব্যে নিই না।
প্রধানমন্ত্রী এর আগেও বলেছেন, কেবল আইন প্রয়োগ ও শাস্তির মাধ্যমে দুর্নীতি রোধ সম্ভব নয়। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করা হবে।
আমরা জানি, বর্তমান সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে দক্ষতা বৃদ্ধি, দুর্নীতি দমন ও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে। জনপ্রশাসনে নিযুক্ত কর্মচারীরা যাতে স্বচ্ছতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে নাগরিকদের সেবা দিতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে কার্যক্রম চলছে। সে লক্ষ্যে জনপ্রশাসনের আইন–কানুন বিধি–বিধানের পরিবর্তন ও সংস্কার করে আরও যুগোপযোগী করার চেষ্টাও চলছে।
এ অবস্থাতেও দুর্নীতি কমে নি। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, দুর্নীতির কারণে দেশের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতেই এগিয়ে চললেও সরকারের নানা বিভাগে তা হ্রাস পায়নি। এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তার নির্দেশনায় দেশজুড়ে চলেছে দুর্নীতিবিরোধী সর্বাত্মক অভিযান। যত প্রভাবশালী এবং সরকার কিংবা ক্ষমতাসীন দলের যত ঘনিষ্ঠই হোন না কেন, ছাড় দেননি কোনো অপরাধীকে। কারও ব্যক্তিগত অপরাধের দায় নিতেও নারাজ সরকার ও দল। সরকারের এই কঠোর অবস্থান সুধী সমাজসহ সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে।
দেশে দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান থাকার পরও দুর্নীতির হ্রাস না হওয়ায় অবাক হচ্ছেন লোকজন। অভিযোগ আছে, তাঁরা দুর্বল আর সমাজের সাধারণ মানুষের বিষয়ে যতটা সোচ্চার, ততটা নন ক্ষমতাবান রাজনীতিবিদ, আমলা কিংবা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে সেগুলো খুব কমই আমলে নেওয়া হয় বলে মনে করেন দেশের অনেকে। এ বিষয়ে সামাজিক আন্দোলন জরুরি। খোদ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যানও বলেছেন, শুধু আইন দিয়ে দুর্নীতি কমানো সম্ভব নয়। গেল বছর ১ হাজার ৮০টি অভিযোগ পর্যালোচনা করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যেসব অভিযোগ কমিশনে আসে, তার বেশিরভাগই তফসিলবহির্ভূত। আর বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে কথা বললেও সুনির্দিষ্ট তথ্য–প্রমাণ তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায় না। নাগরিক সচেতনতা সৃষ্টি না হলে, সামাজিকভাবে দুর্নীতিবাজদের বয়কট না করলে শুধু আইন দিয়ে দুর্নীতি কমানো সম্ভব নয়। দুর্নীতি রেখে দেশের উন্নয়নও সম্ভব নয়, হলেও সে উন্নয়ন টেকসই হবে না। দুর্নীতি সহনীয় পর্যায়ে আনতে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।’
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘দুর্নীতি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করে। তাই সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বার্থেই এর লাগাম কঠোর হাতে টেনে ধরা বাঞ্ছনীয়। দুর্নীতি রোধে রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা মনে করি, দুর্নীতি প্রতিরোধে সর্বক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ বাড়াতে হবে। কারণ দেশবাসীর জীবনমানের উন্নয়নের সঙ্গেও এর একটা বড় সম্পর্ক রয়েছে। কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে নিরপেক্ষ অনুসন্ধান ও প্রমাণসাপেক্ষে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এ বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়ানোর পদক্ষেপও নিতে হবে। দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কটের বিষয়টিও গুরুত্ব পাওয়া উচিত। তবে কোনো ভুল পদক্ষেপে নিরপরাধ ব্যক্তি যেন হয়রানির শিকার না হয়, কর্তৃপক্ষকে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। দুর্নীতি প্রতিরোধে দুদককে আরও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়ার বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া দরকার।’
তাঁরা মনে করেন, দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার মাধ্যমেই কেবল দুর্নীতিকে সহনশীল মাত্রায় কমিয়ে আনা সম্ভব। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী প্রতিরোধ গড়ে তোলার বিকল্প নেই। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান নিজের ঘর থেকেই শুরু করতে হবে। দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে।