চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কে প্রায় প্রতিদিন ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। ফলে এই সড়ক দিয়ে যাতায়াতকারীরা আতংকের মধ্যে থাকেন। দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপ্রশস্ত সড়ক, লবণ পানিতে মহাসড়ক পিচ্ছিল, অপ্রশিক্ষিত চালক, বেপরোয়া গতি, বিপজ্জনক বাঁক, ওভারটেকিং, মহাসড়কে নিষিদ্ধ ছোট যানবাহন চলাচল, ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত ওজন নিয়ে চলাচল ও সড়কের দুপাশে অসমান অংশসহ বেশ কয়েকটি কারণে ঘটছে এই সড়ক দুর্ঘটনা। তবে সাম্প্রতিক সময়ের দুর্ঘটনাগুলোর ধরন দেখলে বুঝা যায়, এর ৭০ শতাংশই ঘটেছে লবণ পানিতে সড়ক পিচ্ছিল হওয়ার কারণে।
জানা যায়, গতকাল শনিবার রাত ১টার দিকে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কে চুনতি ইউনিয়নে বনপুকুর এলাকায় বাস–লরি ও রাত দেড়টায় আধুনগর ব্রিজ এলাকায় বাস–ট্রাক মুখোমুখি সংঘর্ষে প্রায় ১৯ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া ভোর ৫টার দিকে লোহাগাড়া ও চকরিয়া উপজেলা সীমান্তবর্তী আজিজনগর এলাকায় কক্সবাজারগামী সিমেন্ট বোঝাই ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ব্রিজের সঙ্গে ধাক্কা লেগে উল্টে যায়। এতে চালক এরশাদ মন্ডল (৩০) ও হেলপার শিব্বির আহমদ মারুফ (১৯) ঘটনাস্থলে নিহত হয়েছেন। গত ৫ মার্চ একই স্থানে বিজিবির বাসের সঙ্গে যাত্রাবাহী লেগুনার মুখোমুখি সংঘর্ষে ৫ জন নিহত হন। স্থানীয়রা জানায়, গত দুই মাসে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের লোহাগাড়া অংশে ছোট–বড় প্রায় অর্ধশত দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে অনেকে হতাহত হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনার পেছনের কারণ খুঁজতে গিয়ে বের হয়ে আসে নিম্নোক্ত প্রধান চার কারণ–
ত্রিপল ছাড়াই খোলা ট্রাকে লবণ পরিবহন : লবণবাহী ট্রাক থেকে নিঃসৃত পানিতে পিচ্ছিল হচ্ছে চট্টগ্রাম–কঙবাজার মহাসড়ক। ফলে বিপজ্জনক এ মহাসড়কে প্রতিদিন ঘটছে দুর্ঘটনা। লবণবাহী গাড়িতে জিইওট্যাঙ (মোটা ত্রিপল) ব্যবহারের নিয়ম থাকলেও তা সঠিকভাবে মানছেন না। এতে লবণবাহী ট্রাক থেকে নিঃসৃত হচ্ছে পানি।
জানা যায়, লবণ উৎপাদন মৌসুমে কোনো ধরনের সুরক্ষা ছাড়াই উপকূলীয় এলাকা থেকে প্রতিদিন শত শত ট্রাকে করে এসব লবণ পরিবহনের কারণে প্রতিনিয়তই ঘটছে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। এতে মৃত্যুপুরী হয়ে উঠেছে মহাসড়কটির কঙবাজারের ঈদগাঁও থেকে চকরিয়া, লোহাগাড়া, চন্দনাইশ ও পটিয়া পর্যন্ত। শুধুমাত্র গত পনের দিনের ব্যবধানে মহাসড়কটির চকরিয়া উপজেলার ৩৯ কিলোমিটার অংশে ঘটে গেছে ৮টি ভয়াবহ দুর্ঘটনা। এতে অন্তত ১০ জনের প্রাণহানি হওয়া ছাড়াও আহত হয়েছেন অনেকে। এজন্য ত্রিপল ছাড়াই খোলা ট্রাকে লবণ পরিবহনের কারণে এসব দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন হাইওয়ে পুলিশ। সাম্প্রতিক সময়ের দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ৭০ শতাংশ ঘটেছে লবণ পানিতে সড়ক পিচ্ছিল হওয়ার কারণে।
এই তথ্য নিশ্চিত করে মহাসড়কের চকরিয়ার বানিয়ারছড়াস্থ চিরিঙ্গা হাইওয়ে থানা পুলিশের ইনচার্জ (ওসি) ইমন কান্তি চৌধুরী গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, রাতে ও ভোরে মহাসড়কটির অবস্থা দেখলেই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় পরিবহনের সময় ট্রাক থেকে গলে পড়া লবণ পানিতে মারাত্মক পিচ্ছিল হয়ে উঠেছে বিটুমিনের মহাসড়কটি। এতে একটু করে ব্রেক কষলেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মহাসড়ক থেকে ছিটকে পড়ছে যানবাহন। মোটর সাইকেল হলে তো আর কথাই নেই।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ চকরিয়ার উপ–সহকারী প্রকৌশলী মো. দিদারুল ইসলাম বলেন, খোলা ট্রাকে করে পরিবহনের সময় লবণ পানি নিঃসৃত হয়ে সরাসরি মহাসড়কের ওপর গিয়ে পড়ায় বিটুমিনের কার্পেটিংয়ের প্রলেপও উঠে যাচ্ছে। বিটুমিনাসের নিচের স্তর মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সড়কের আয়ুষ্কাল কমে যাচ্ছে। এ নিয়ে সড়ক বিভাগের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট স্থানীয় প্রশাসনকে পত্র দেওয়া হলেও কোনো কাজ হচ্ছে না।
নিরাপদ সড়ক চাই কঙবাজার জেলার সভাপতি জসীম উদ্দিন কিশোর বলেন, যদি ট্রাকে মোটা ত্রিপল বিছিয়ে তার ওপর লবণভর্তি করে পরিবহন করা হয় তাহলে আর লবণ পানি গলে সড়কে গিয়ে পড়বে না। আর এটি নিশ্চিত করতে হবে প্রশাসন এবং হাইওয়ে পুলিশকে।
ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক : চট্টগ্রাম–কঙবাজার মহাসড়কে রয়েছে বহু ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক। এর মধ্যে শুধু লোহাগাড়ায় রয়েছে প্রায় ১৪টি বাঁক। একদিকে অপ্রশস্ত সড়ক অন্যদিকে মহাসড়কে ঘন ঘন বাঁকের কারণেও প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। এছাড়া সড়কের দুপাশে রয়েছে অনেকগুলো হাট–বাজার। এ হাটবাজারে যানজটের কারণে বিভিন্ন সময় মহাসড়কের পটিয়ার শান্তির হাট, কলেজ বাজার, বাদামতল, মনসা চৌমুহনী, ভেল্লাপাড়া, মুন্সেফ বাজার, থানার মোড়, ডাকবাংলো, বাস স্ট্যান্ড, পোস্ট অফিস মোড়, চন্দনাইশের রৌশন হাট, বাগিচা হাট, দোহাজারী বাজার, সাতকানিয়ার কেরানীহাট ও লোহাগাড়া সদর বটতলী স্টেশন, পদুয়া তেওয়ারীহাট, আধুনগর খানহাট বাজার ও চুনতি বাজার এলাকায় প্রায় সময় যানজট লেগেই থাকে।
মূল সড়কের সঙ্গে দুপাশের দূরত্ব বৃদ্ধি : চট্টগ্রাম–কঙবাজার মহাসড়ক প্রতিবছর সংস্কারের ফলে মূল সড়কের সাথে দুপাশের দূরত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। মূল সড়ক সংস্কারের পর দুপাশের অসমান অংশ মাটি দিয়ে ভরাট করে দেয়ার কথা বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কাজের বাস্তবায়ন হয় না। ফলে মহাসড়কের দুপাশে অসমান অংশ হয়ে উঠেছে বিপদজ্জনক। যার কারণে প্রায় সময় ঘটছে দুর্ঘটনা।
‘জাঙ্গালিয়া’ দুর্ঘটনার হটস্পট : চট্টগ্রাম–কঙবাজার মহাসড়কে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি ইউনিয়নের জাঙ্গালিয়া এলাকায়। এটি সড়ক দুর্ঘটনার হট স্পট হিসেবে পরিচিত। ওইস্থানে সড়কের দুই পাশে ঘন বনাঞ্চল, বাঁক ও ঢালু রাস্তার কারণে প্রায় সময় দুর্ঘটনা ঘটে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটন নগরী কঙবাজার আসেন পর্যটকরা। দূর–দূরান্ত থেকে আসা চালকদের এই সড়কের ব্যাপারে অভিজ্ঞতা না থাকাও দুর্ঘটনার অন্যতম একটি কারণ।
নিরাপদ সড়ক চাই লোহাগাড়া উপজেলা শাখার সভাপতি মোজাহিদ হোসাইন সাগর জানান, চট্টগ্রাম–কঙবাজার মহাসড়ক চার লেন বা ছয় লেনে এখনো উন্নীত না হওয়া, বিপজ্জনক অসংখ্য বাঁক, লবণের পানির কারণে সড়কের পিচ্ছিলতা, মূল সড়কের সাথে দুপাশের দূরত্ব বৃদ্ধি, বেপরোয়া গতি ও চালকের অদক্ষতা কারণে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে।
চট্টগ্রাম–কঙবাজার মহাসড়ক প্রশস্তকরণ ও মহাসড়কের মূল অংশের সাথে দুপাশের অসমান অংশ ভরাট করার ব্যাপারে জানতে দোহাজারী সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীকে একাধিকবার ফোন করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।