চট্টগ্রামের নাট্যাঙ্গনের মেধাবী স্বজন– প্রদীপ দেওয়ানজী ও সনজীব বড়ুয়া নাট্যকলায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ যথাক্রমে ‘জেলা শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা’ ২০২১ ও ২০২২ লাভ করেছেন।
দুই নাট্যসারথির এই অর্জনে অভিনন্দন জানাই।
প্রদীপ দেওয়ানজী
প্রদীপ দেওয়ানজী (১৯৫৪) একাধারে নাট্যকার, নির্দেশক, সংগঠক, বাচিক প্রশিক্ষক ও বিচারক। এ নগরীর প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী। বহুমাত্রিক সত্তা সত্ত্বেও শেষ বিচারে তাঁকে নাট্যজন হিসাবেই চিহ্নিত করতে হয়। গত চার পাঁচ দশক ধরে তিনি প্রধানত নাট্যকলায় নিমগ্ন। নাট্যাঙ্গনই তাঁর সৃজন চিন্তনের ক্ষেত্র। নাট্যমঞ্চই তাঁর অহংকৃত সাংস্কৃতিক ঠিকানা। তিনি চট্টগ্রামের সেই নিম্নকণ্ঠ নাট্যব্যক্তিত্ব– যিনি রচনা, অনুপ্রেরণা, বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা ও সাহস দিয়ে নাট্যাঙ্গনের শিরদাঁড়া মজবুতে ভূমিকা পালন করেছেন।
চট্টগ্রামের নাট্যঙ্গনে তরুণ নাট্যকর্মীদের কাছে প্রদীপ দেওয়ানজী অফুরন্ত অনুপ্রেরণার উৎস। তিনি নাট্যঙ্গনের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সেই বিচক্ষণ ব্যক্তি– যিনি নাট্য–সম্ভাবনার সামান্যতম সূত্র ধরে একজন তরুণ বা তরুণীর অসামান্য শক্তিকে জাগিয়ে দিতে পারেন। অতিপরিচয়ের যশোপ্রার্থী না হয়ে অন্তরালের বিশ্বস্ত শক্তি হিসাবে তিনি নিত্য অস্তিত্ববান। অহেতুক উচ্চকণ্ঠ বা আত্মপ্রচারে অনীহ এ নাট্যজন নাটকের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে বিশ্বাসী যে কারো কাজকে নিজের কাজ মনে করেন এবং তাতে অংশগ্রহণ অনিবার্য মনে করে নিজ থেকে এগিয়ে আসেন। বৈরীস্রোতেও তিনি সতত স্বপ্নবান। আশির দশকে যখন ঘনিয়ে এসেছিল ক্রান্তিকাল– স্বৈরাচার ও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির প্রচণ্ড উত্থানে দিশাহারা নাট্যাঙ্গন, বিভেদ বিভ্রান্তি আর চোরাবালিতে যখন সাংস্কৃতিক চিহ্নসূত্রসমূহ বিলীয়মান তখনো প্রদীপ দেওয়ানজী নাটকের সংলাপ নিয়ে ছিলেন গন্তব্য অভিমুখী– অনড়, অটল।
প্রদীপ দেওয়ানজী বহুবিধ বিষয়ে, বিবিধ আঙ্গিকে নাটক লিখেছেন। তাঁর প্রকাশিত নাটকের সংখ্যা ২০টি। এর মধ্যে সাতটির আখ্যান আবর্তিত হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের অনুষঙ্গকে অবলম্বন করে। তাঁর প্রতিনিধিত্বশীল অন্যতম নাট্যকীর্তি হলো– ‘দাবি’, ‘বধ্যভূমি’, ‘কাদামাখা মাইক্রোবাস’, ‘অপেক্ষা’ প্রভৃতি। নাটকগুলোতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকসেনা কর্তৃক সংগঠিত গণহত্যা, স্বাধীনতার অব্যবহিত পর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অবমাননার চিত্র উঠে এসেছে বিশ্বস্তভাবে। ‘দাবি’ নাটকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননার প্রেক্ষাপটে তিন জন মুক্তিযোদ্ধা মনের তীব্র ক্ষোভ গ্লানি ও অপরিসীম বেদনায় উপস্থিত হয়ে একাত্তরে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ফলে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অবক্ষয় নিয়ে রচিত ‘দাবি’–র বেদনাময় নাট্যচিত্র দর্শকদের দাঁড় করিয়ে দেয় নতুন এক জিজ্ঞাসার মুখোমুখি। একাত্তর সালে বর্বর পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক চট্টগ্রামে পারিচালিত নারকীয় হত্যাকাণ্ডের নির্মম সাক্ষী ফয়’স লেক বধ্যভূমি। বিশ থেকে পঁচিশ হাজার বাঙালিকে এখানে হত্যা করা হয়। এটিই বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বধ্যভূমি হিসেবে স্বীকৃত। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাট্যধারায় বধ্যভূমির প্রসঙ্গটি কিছুটা অনালোকিত ছিলো। ‘বধ্যভূমি’ নাটকে বিভিন্ন প্রামাণ্য গ্রন্থ, নির্ভরযোগ্য দলিলপত্র এবং তথ্য–উপাত্তের ভিত্তিতে ফয়’স লেক হত্যাযজ্ঞের নির্মমতাকে তিনি তুলে এনেছেন বিশ্বস্ত ভাষ্যে। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিয়ে রচিত ‘কাদামাখা মাইক্রোবাস’। বিজয়ের অব্যবহিত পূর্বে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নির্মম বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা মর্মস্পশী ভাষায় উঠে এসেছে নাটকটিতে। বিজয়ের একদিন আগে ঢাকা শহরে যমদূত হয়ে নেমেছিলো একটি কাদামাখা মাইক্রোবাস। সারা শহর থেকে বুদ্ধিজীবীদের ধরে এই মাইক্রোবাসে করে আনা হয়েছিলো ফিজিকেল ট্রেনিং সেন্টারে। এখানে অমানুষিক নির্যাতনের পর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তাদের হত্যা করা হয়। ‘কাদামাখা মাইক্রোবাস’ নাটকে বুদ্ধিজীবীদের বীভৎস ও নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনা দৃশ্যায়িত হয়েছে। ‘অপেক্ষা’ মুক্তিযুদ্ধে সন্তান হারানো এক মায়ের অন্তহীন অপেক্ষা ও হৃদয়মথিত বেদনার নাট্যভাষ্য। বিভিন্ন দলে নাটকগুলোর সফল মঞ্চায়ন সম্পন্ন হয়েছে।
বলা যায়– নাটকে প্রদীপ দেওয়ানজী মূলত মুক্তিযুদ্ধের ভাষ্যকার। তিনি মুক্তিযুদ্ধের নাটকে কল্পিত কল্পনার চাইতে পছন্দ করেন মুক্তিযুদ্ধের বেদনাদীর্ণ ও বীভৎস বাস্তবতার তথ্য উপাত্তভিত্তিক নিবিড় বিবরণ। তাঁর নাটককে বলা যায়– নাট্যকারের জীবন সত্যের রূপায়ন। কেননা, একাত্তরে যুদ্ধচলাকালীন নির্মম বাস্তবতার শিকার হয়ে, উত্তরকালে সে জীবনাভিজ্ঞতার ভাষ্য লিখেছেন সংলাপের আশ্রয়ে। একারণে তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটকগুলো হয়ে উঠেছে বিপন্ন বাস্তবতার বিশ্বস্ত বয়ান। দর্শক তাঁর নাটকে একাত্তরের অদেখা বাস্তবতাকে মঞ্চের বাস্তবতায় দেখে যুদ্ধের ভয়াবহতা অনুভব করে। নাটকে প্রতিফলিত একাত্তরের বীভৎস বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করে দর্শক শিহরিত হয়। তখন দর্শক চেতনায় ক্রমশ সঞ্চারিত হতে থাকে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির আত্মত্যাগের মহিমা ও মাহাত্ম্য। এটিই তাঁর নাটকের সার্থকতা।
সনজীব বড়ুয়া
সনজীব বড়ুয়া (১৯৫৮-) চট্টগ্রামের শিল্পসাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিবিধ অভিধায় চিহ্নিত হলেও তিনি মূলত নাট্যজন। নাটককে ঘিরে তাঁর প্রব্রজ্যা, নাটকেই তাঁর নির্বাণসুখ। গত পঞ্চাশ বছর ধরে এ নগরীর নবনাট্য আন্দোলনে নাটকের রচনা, নির্মাণ, প্রদর্শন, সম্মিলিন কর্মসূচি বাস্তবায়ন সহ নাটকের প্রতিটি পর্বে তিনি যুক্ত ছিলেন। নাটকের সাংগঠনিককর্ম, স্থানীয় ও জাতীয় মোর্চার নেতৃত্ব, নাটক ও নাট্যান্দোলন নিয়ে বৌদ্ধিক চর্চা, নাট্যরচনা, নির্দেশনা প্রভৃতি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও তাঁকে নিপুন অভিনেতা হিসাবে নাট্যাঙ্গনে সবিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন।
চট্টগ্রামের নাট্যাঙ্গনে সনজীব বড়ুয়া সেই অনিবার্য নাট্যকণ্ঠ যিনি স্বাধীনতোত্তর ফলবান শিল্পশস্য হিসাবে পরিচিত গ্রুপ থিয়েটার চর্চার উন্মেষকালের একজন বিশ্বস্ত সাক্ষী ও সারথি। গত পঞ্চাশ বছরের নিরবচ্ছিন্ন নাট্যযাত্রায় তিনি ক্লান্তিহীন পথিক। বিপুল বৈভবে, বহুমাত্রিক পরিচয়ে বিকশিত হয়েছে তাঁর সৃজন–চিন্তন। নাটকের বিস্তৃত আঙ্গিনায় তিনি বিবিধ বিষয়ের শিল্পিত কারিগর। উন্মেষকাল থেকেই তিনি নাটকের অধ্যয়ন, আলোচনা, রচনা, নির্মাণ ও নানা নাট্যকর্মকাণ্ডের একাগ্রচিন্তক ও পর্যবেক্ষক। চট্টগ্রামের নাট্যচর্চা বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজকের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। প্রতিটি বাঁক পরিক্রমায় রয়েছে তাঁর অবলোকন ও অংশগ্রহণ। নাট্যঙ্গনে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা, দুর্ঘটনা, প্রত্যাশা প্রাপ্তিসহ অজস্র কর্মসূচির আদ্যোপান্ত তিনি স্বতস্ফূর্তভাবে তুলে ধরেন সতীর্থ তরুণদের কাছে। তাঁর স্মৃতি ও শ্রুতির বিশ্বস্ততার কারণে চট্টগ্রামের নাট্যচর্চার মৌখিক ইতিহাস ও বিবিধ প্রামাণ্য তথ্যসূত্রের মান্য আকর হিসাবে একজন নির্ভরযোগ্য উৎস হিসাবে তিনি ব্যাপকভাবে উদ্ধৃত। সাংগঠনিক পরিচয়ে তিনি অঙ্গনকর্মী হলেও তাঁর নাট্যচর্চার সূত্রপাত গণায়নের ব্যানারে। এ দলের নাট্যপ্রযোজনাসূত্রে ১৯৭৬ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের প্রথম পথনাটক ‘যায় দিন ফাগুনো দিন’ নাটকে পর পর ছয়টি প্রদর্শনী করে তিনি চট্টগ্রামের নাট্যঙ্গনের ঐতিহাসিক এক সুবর্ণ মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে আছেন। এর পর ১৯৭৮ সালে নাট্যকার মিলন চৌধুরীর নেতৃত্বে গড়ে তোলেন অঙ্গন থিয়েটার ইউনিট। অদ্যাবধি তিনি এ দলের কর্মী।
মঞ্চের সুদক্ষ অভিনেতা তিনি– বচনে বাচনে বিশুদ্ধ। চট্টগ্রামের মঞ্চে অজস্র নাট্যকর্মী অভিনয় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। কিন্তু, সনজীব বড়ুয়া চট্টগ্রামের সেই নাট্যজন যিনি দীর্ঘ অভিনয়জীবনে বিচিত্র চরিত্রের রূপদান করে নিজের নামের সাথে অভিনেতা শব্দটি অলংকার হিসাবে যুক্ত করতে সমর্থ হয়েছেন। তাঁর উচ্চারণে সংলাপ প্রাণ পায়। তাঁর নিখুঁত বাচিক ও আঙ্গিক অভিনয়ে চরিত্র বাস্তব হয়ে ওঠে। মঞ্চে সনজীব বড়ুয়ার অভিনয় দর্শকের মনে অনির্বচনীয় মুগ্ধতা সৃষ্টি করে– যা মঞ্চের বাস্তবতাকে অবলম্বন করে পুরো নাটক শৈল্পিক উচ্চতায় সহজে পৌঁছে যায় দর্শকের মনে। অভিনয়ে তিনি নিজ দলে সীমাবদ্ধ থাকেননি। বিভিন্ন দলে, বিবিধ উদ্যোগে নির্মিত নাট্যকলায় তিনি পারঙ্গম অভিনয় প্রতিভা প্রদর্শন করেছেন। নাট্যনির্মাণে কুশলী নির্দেশক তিনি। বাস্তববাদী নাটককে তিনি নির্দেশনার জন্য বেছে নেনে। নাট্যরচনায়ও তাঁর ভূমিকা রয়েছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাট্যকীর্তি ‘বাজলো রাজার বারোটা’ ‘মহারাজ অসুস্থ’ প্রভৃতি। ব্যক্তির ক্ষত, সমকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট, মূল্যবোধের অবক্ষয় প্রভৃতি বিষয় তাঁর নাটকে ঘুরেফিরে এসেছে। নাটকগুলো অঙ্গনের মাধ্যমে সফলভাবে মঞ্চস্থ হয়েছে।
সনজীব বড়ুয়া চট্টগ্রামের নাট্যাঙ্গনে একজন পরিচ্ছন্ন ও মেধাবী নাট্যচিন্তক। তাঁর পরিচ্ছন্ন শিল্পবোধ শুধু পরিবেশনা শিল্পে নয়– তা প্রতিফলিত হয় তাঁর নিত্যদিনের যাপিত জীবনে, চিন্তনে, আচরণে, আভরণে। বিনয়ে বিনম্র তিনি বিদগ্ধ বক্তা। এই খ্যাতিমান নাট্যজন কালের বর্তমান প্রান্তে এসে উপনীত হয়েছেন অনিবার্য ব্যক্তিত্বরূপে গর্বিত অবস্থানে– তরুণ নাট্যকর্মীদের শ্রদ্ধার অলংকৃত আসনে।