(পর্ব-৪)
বেশ আগেভাগেই শুয়ে পড়েছিলাম আগের রাতে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নামাঙ্কিত দ্বিতীয় শ্রেণির কক্ষে চার্জে থাকা মোবাইলের বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে গেল মাঝরাতে। সাইক্লোন সেন্টার কাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভেতরের বারান্দায় দুইজনের তাঁবুতে তিনজন খানিকটা গাদাগাদি করে শুয়েছি। এইখান থেকে দ্বিতীয় শ্রেণির কক্ষের ফুট পনেরোর দূরত্বটুকু এখন অনেক! এর চেয়ে জড় পদার্থ হয়ে অনড় থাকাই শ্রেয়। ফোনের শব্দেই সম্ভবত সানির ঘুম ভেঙে গিয়েছে। খানিক বাদেই তাঁবুর বাইরে চানাচুরের প্যাকেট খোলার শব্দ পেলাম। বেচারার নিশ্চয় রাতের বেলা খিদে পেয়েছে। আরও খানিকক্ষণ খচর-মচর করার পর আমার নাম ধরে ডাকতে শুরু করলো। ততক্ষণে তানভীর ভাইও উঠে পড়েছে। রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে তাঁবুর বাইরে আসতেই দেখি মুদি দোকান থেকে কেনা প্যাকেট কেকের উপরে জ্বলছে মোমবাতি। দু’পাশ থেকে দুইজন বলে উঠলো, ‘শুভ জন্মদিন’। নানান ঝামেলায় নিজের জন্মদিন ভুলে বসলেও বাকী দ’ুজন মনে রেখেছে। বুড়ির ডাবর বাজার তন্নতন্ন করে খুঁজে নাকি কেনা হয়েছে মোমবাতি, কেক আর ছুরি!
বাবু বঙ্কিমচন্দ্র কৈলাসগঞ্জ সুন্দরবন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। সবে দিন পনেরো হলো অবসরে গিয়েছেন। এই বিদ্যালয়ের পথচলার সময়ের থেকেই তিনি এর সারথি। অবসরে গেলেও অবসরজীবনের সাথে এখনও একাত্ম হতে পারেননি। নিয়মিতই আসছেন স্কুলে। অবসর নিলেও বিদ্যালয়ের মূল ফটকের চাবি এখনো তাঁর কাছেই। তিনি স্কুল ছাড়লেও স্কুল তাকে ছাড়েনি! ভোরেই বিদ্যালয়ের দোর খুলতে নাতি রিকের সাথে হাজির তিনি। ততক্ষণে অবশ্য আমরা বের হবার জন্য প্রস্তুত। কাল রাতে থেমে থেমে বারকয়েক ভালোই বৃষ্টি হয়েছে। মাটির রাস্তা পরীক্ষা নেবে মনে হচ্ছে। বঙ্কিমবাবু অবশ্য শোনালেন আশার বাণী। কিছুদূর যাবার পরে নাকি রাস্তা ভালোই। তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পথে নামলাম। মাটির সোঁদা গন্ধটুকুই আগে নাকে লাগলো। খুব বেশি প্যাঁচপ্যাঁচে কাদা নেই। সাইকেল চালাতে খুব একটা বেগ পেতে হচ্ছে না। অল্প পরেই গাজী হ্যাচারি। খুলনার গাজী গ্রুপ বিশাল জায়গা নিয়ে হ্যাচারিটা স্থাপন করেছে একদম সুন্দরবন গা ঘেঁষেই। পথচলতি অল্প দু-চারজন বিস্ময় নিয়ে আমরা তিন সাইকেল আরোহীকে দেখছে। ‘এত সকালে এরা কোথা থেকে এলো?’- সেই জিজ্ঞাসাই এদের চোখে-মুখে।
রামনগরের অল্প পরেই পড়লাম ভয়াবহ কাদায়। এইদিকের মাটি সাইকেলের ভার নিতে শিখে ওঠেনি। প্রথমে সাইকেলের ফরকের উপরের অংশে কাদা জমে চাকা জ্যাম হয়ে গেল। বগলে জুতা, দুই হাতে সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে চলা- সে এক দৃশ্য! একজন অপরজনকে দেখেই হেসে গড়িয়ে পড়ার দশা। গেরস্থের উঠোন থেকে নারী আর শিশুরাও চাপা আনন্দ নিয়ে দেখছে আমাদের। একটু বাদে বাদেই সাইকেলের চাকা কাদা লেগে জ্যাম হয়ে গিয়ে চক্রাকারে ঘুরতে অসম্মতি প্রদান করছে। রাস্তার আশপাশ থেকে কাঠি কুড়িয়ে ফরকের উপরের অংশের কাদা সরিয়ে ফের চলা। কাঠি করতে এমনিতেই আমরা বাঙালিরা ওস্তাদ! সে সুনাম আমরা তিনজন ধরে রাখলাম। কিলোমিটার খানেক রাস্তা হবে খুব সম্ভবত। কিন্তু বেশ ভালো সময় কেড়ে নিল এইটুকু পথ।
ঠাকুরবাড়ি ঘাটে পৌঁছে রক্ষা। এইখানেই আমাদের নদী পেরোতে হবে। নদীর নাম ভদ্রা। ভদ্রার পাড়ে গিয়ে নিজেদের শরীরটাকে খানিকটা ভদ্রস্থ আর সাইকেলকে চলন উপযোগী করতে আরেক দফা নানান কসরতের পালা। সবার চেইনেই প্রচুর কাদা। আরেক দফা কাঠি করতে হলো। এইবার অবশ্য ছোট কাঠি! ঘাটের দোকানগুলোতে নাশতার ব্যবস্থা নেই। চা-বিস্কুটই ভরসা। এর মাঝেই চালনা যাবার ট্রলারটা ঘাট থেকে সরে যেতেই আমরা ওপারে যাবার খেয়ায় চড়ে বসলাম। ভদ্রার ওপারের অংশটার নাম শ্রীনগর। ঢুকতেই স্বাগত জানালো কাদামাখা রাস্তা। একটু আগের দগদগে ক্ষতের উপর আরেকটু নুন চড়বে কিনা সে আশঙ্কায় আমরা কাতর। স্থানীয় এক লোক জানালেন, আধা কিলোমিটার রাস্তায় কাদা বেশি। এরপর থেকে খুব একটা কাদা নেই। আবার সেই সাইকেল ঠেলা। তবে স্থানীয় লোকটার কথাই ঠিক। এইদিকের কাদা অত বেশি ভয়াবহ নয়। আধা কিলোমিটার বাদেই কাদার পরিমাণ আসলেই কমে গেলো। সাইকেল ঠেলার সময় এক যুবক আমাদের সাথেই হাঁটছিলো। একটা শর্টকাটের পথ বাতলে দিয়েছিল সে। ভদ্রার পাড় ঘেঁষা মূল রাস্তা ছেড়ে ওটা ধরার মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ফিরতি পথ ধরলাম! কাদা থেকে বাঁচতে গিয়ে কাদার অভয়ারণ্যে গিয়ে পড়লাম যেন। ওই যুবকের সাথে আমাদের কি শত্রুতা ছিল কে জানে!
মাটির মূল রাস্তা ধরেই আরও খানিক চলার পরে পেলাম সুতারখালী ফরেস্ট অফিস। বেশ পরিপাটি। মাঝে মাঝে কাদার দেখা পেলেও সেগুলো বিশেষ অসুবিধা করছে না আমাদের। এইদিকের কাদা মানুষের ভার নিতে অভ্যস্ত। হাল ছেড়ে দিয়ে দেবে যায় না এরা। ঠাকুরবাড়ি ঘাটের চা-বিস্কুট বাদে পেটে আর কিছু পড়েনি। চারপাশে এটা-সেটা দেখে চোখ ভরলেও পেট ভরছিল না। দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে বসা সদ্য শেষ হওয়া এক মেলার কোণে গরম গরম জিলাপী ভাজা হচ্ছিল। মেলা উঠে যাবার আগ মূহুর্তে আচমকা খদ্দের পেয়ে বিক্রেতা বেশ খুশি। সাথে থাকা চেয়ারে বসেই রসে মাখামাখি হয়ে বেশ একচোট খাওয়া হলো। বিক্রেতার পোষা মেকুরটার সাথে তানভীর ভাই কিছুক্ষণের মাঝেই ভাব করে ফেললেন। তানভীর ভাইয়ের বিড়ালকে আদর করা দেখে সানী একবার বলেই ফেললো, ‘‘এত সুন্দর করে বিড়ালকে ‘বাবা’ বলে ডাকেন, আমার নিজেরই বিড়াল হয়ে যেতে ইচ্ছে করে!” ভাইয়ের এই মেকুর প্রীতির পেছনে আছে তার বাসার বিড়াল ‘লিও’ এর অবদান। পুরো রাইডজুড়েই বাসায় ভাবীকে ফোন করেই নিজেদের কুশলাদি বিনিময়ের বদলে জিজ্ঞেস করতেন, ‘লিও কি করে? ঠিকঠাক খাইতেছে?’
পরের রাস্তাটুকু মাটি আর ঘাসে মোড়ানো। এইদিকে জনবসতি বেশ ঘন। সুন্দরবনের এত হাতছোঁয়া দূরত্বে এত লোক বাস করে জানা ছিল না। বেশকিছু নির্মীয়মাণ নৌকার কাঠামো ঘিরে লোকের ভিড়। পিচ্চিপাচ্চার দলে গভীর মনোযোগের সহিত কাজ দেখছে। শহরে লোকে যেমন রাস্তা খোঁড়ার কাজ দেখে, অবিকল তেমন দৃশ্য! সুন্দরবন একদম হাতছোঁয়া দূরত্বে এমন জায়গায় জমজমাট একটা বাজার দেখে চা বিরতির জন্য থামলাম। খানিকটা গরম লাগলেও চায়ে না বলতে নেই। চা তীব্র গরমেও অন্যতম শীতল পানীয়। কেওড়াতলা নামক এই বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতা ছাড়াও আছে ট্রলারের অপেক্ষায় থাকা বেশ কিছু যাত্রী। বাজারের লোকেদের কাছে কিছুক্ষণের জন্য কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলাম আমরা। ট্রলারের জন্য অপেক্ষমাণ যাত্রীদের একটা অংশও ভিড় করল আমাদের সাথে কথা বলার জন্য। এতকিছুর ফাঁক গলে চা পান করে আবার সাইকেলের প্যাডলে। এইবারের গন্তব্যে নলিয়ান। মাটির রাস্তার দুই ধারে দিগন্তবিস্তৃত মাছের ঘের। বেশকিছু জায়গায় মাটি ভরাটের কাজ চলছে নতুনভাবে। সেসব এড়িয়ে টানা চালিয়ে নলিয়ান ফেরী টার্মিনালে।
তানভীর ভাইয়ের বিড়ালকে আদর করা দেখে সানী একবার বলেই ফেললো, ‘‘এত সুন্দর করে বিড়ালকে ‘বাবা’ বলে ডাকেন, আমার নিজেরই বিড়াল হয়ে যেতে ইচ্ছে করে!” ভাইয়ের এই মেকুর প্রীতির পেছনে আছে তার বাসার বিড়াল ‘লিও’ এর অবদান। পুরো রাইডজুড়েই বাসায় ভাবীকে ফোন করেই নিজেদের কুশলাদি বিনিময়ের বদলে জিজ্ঞেস করতেন, ‘লিও কি করে? ঠিকঠাক খাইতেছে?’