অবস্থা কিন্তু খারাপ হচ্ছে এবং হতেই থাকবে। সমাজ কোন দিকে এগুচ্ছে তার কয়েকটি সাম্প্রতিক নিদর্শন লক্ষ্য করা যাক। এদেরকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে হবে, কিন্তু এরা তা নয়; খুবই সংলগ্ন, এবং হাওয়া কোন দিকে বইছে তারই ইঙ্গিতবহ।
একটি ঘটনা রাজধানীর এক বস্তি এলাকার। সেখানে ১৪ বছরের এক কিশোর তার ৪ বছরের বোনটিকে গলা টিপে হত্যা করেছে। কারণ কি? ঈর্ষা! ছেলেটির ধারণা তার বাবা-মা তার বোনটিকে বেশী ভালোবাসে। ভাইয়ে বোনে ঈর্ষা অস্বাভাবিক কিছু না; হলেও বাবা-মায়ের ভালোবাসার ভাগাভাগি নিয়ে খুনোখুনি এটা অভিনব বটে। বোঝা যায় সহিংসতা কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে এবং ব্যক্তিগত মালিকানার বিষয়টি কিশোরবয়সীদের মধ্যেও কেমন হননকারী রূপ নিয়েছে। নিজেরটা ছাড়া অন্যকিছু বোঝাবুঝি নেই।
দ্বিতীয় ঘটনা ভাঙনের। গণফোরাম ভাঙছে। এই রাজনৈতিক দলটির যাত্রা খুব হৈ চৈ করে শুরু হয়েছিল। গত নির্বাচনে গণফোরামকে কেন্দ্রে রেখেই সরকারবিরোধী একটি ঐক্যফ্রন্ট গড়ে উঠেছিল। সেটা এখন আর নাই। নির্বাচনের পরে ঐক্যফ্রন্টের ছোট শরিকদের এক নেতা বলেছিলেন, ঐক্যফ্রন্টকে তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। এখন গণফোরাম নিজেই মনে হয় হারিয়ে যাবে।
হেফাজতে ইসলামের ভেতরও ভাঙনের লক্ষণ খুবই পরিষ্কার। আনুষ্ঠানিক ভাবে হেফাজত কোনো রাজনৈতিক দল নয়, কিন্তু রাজনৈতিক শক্তি বটে। ছোটখাটো শক্তি নয়। ২০১৩ সালে শাহবাগ চত্বরে গণজাগরণ মঞ্চের বিপরীতে শাপলা চত্বরে হেফাজত যে সমাবেশ ঘটিয়েছিল তা ছিল আয়তনে বিশাল, এবং স্বভাব চরিত্রে যুদ্ধংদেহি। আহমদ শফীর মৃত্যুর পর হেফাজতের যে অংশ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার মধ্য দিয়ে দাবীদাওয়া আদায় ও সুযোগসুবিধা বৃদ্ধির পথ ধরেছিল, অন্য অংশ মনে হয় তার বিপরীত ধারায় এগুবে। হেফাজতের অনেক দাবীই ছিল উগ্র, সবচেয়ে ভয়াবহ দাবীটি ব্লাসফেমি আইন পাশের। আহমদ শফীর বিরুদ্ধবাদীরা এখন উগ্রপন্থায় এগুবে বলেই ধারণা। জামায়াতে ইসলামী এখন আর তেমন তৎপর নয়, তবে তাদের অনুসারীরা হয়তো হেফাজতী ধারার সঙ্গে যুক্ত হয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠবে। মোট কথা, হেফাজত যদি ধর্মীয় মৌলবাদী উগ্রতার আবাদের জন্য উর্বর ভূমিতে পরিণত হয় তবে আমরা মোটেই বিস্মিত হবো না।
তৃতীয় ঘটনাটা বেচাবিক্রির। এটা জানায় ছিল যে অবস্থা খারাপ হবে এবং নিম্নআয়ের মানুষ পুঁজি-পাট্টা ভাঙিয়ে বাঁচতে চেষ্টা করবে। বিক্রি করবে জিনিসপত্রও। জুলাই মাসেই খবর পাওয়া গেছে ১০০টি স্কুল বিক্রি হবে। (ডেইলী স্টার, ২১-০৭-২০২০) স্কুলগুলো প্রাইভেট, আয়-রোজগার হয়তো খারাপ ছিল না। কিন্তু স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে, আয় নেই, অগত্যা স্কুল বিক্রি করে সংসার চালানোর চেষ্টা।
বিদ্যসাগরের কালে পেশাদার স্বামী পাওয়া যেত। ওই ব্যবস্থা এখনও আছে। বিয়ের নাম করে ধর্ষণ ও প্রতারণা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। নতুন সংযোজন পেশাদার স্ত্রী। এই বস্তু পশ্চিমে চালু আছে, এখন বাংলাদেশে এলো। পশ্চিম পূর্বকে আগেও জয় করেছে, এখনও ছাড়বে না। জিনাত সাদিয়া নামে একটি মেয়ে কাগজে বিজ্ঞাপন দিত পাত্র চাই বলে। পাত্রীর পরিচয় : ডিভোর্সি, কানাডা-প্রবাসী, কানাডায় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিক। দশ বছরে সে কমপক্ষে একশ’ জন বিবাহার্থী পাত্রকে সাফল্যের সঙ্গে ঠকিয়েছে। মেয়েটি ডিভোর্সি নয়, প্রথম বিয়ে ভাঙার পর দ্বিতীয় বিয়ে করেছে, তবে তার এই নতুন স্বামী তার প্রতারণা উদ্যোগের একজন সহযোগী বটে। পাত্র-ঠকানোর ব্যবসাটা ভালোই চলছিল। শেষ পর্যন্ত আটকে গেছে এক জায়গায় এসে। সত্তর বছর বয়সী এক ভদ্রলোক তার ফাঁদে পড়েছেন; সোয়া এক কোটি টাকা খরচ করে ফেলেছেন, কিন্তু কোনো ফল পাচ্ছেন না দেখে সন্দিগ্ধ হয়েছেন, এবং অনুসন্ধানে টের পেয়েছেন যে তিনি প্রতারিত হয়েছেন। তিনি পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের শরণাপন্ন হয়েছেন এবং তাতে মেয়েটির ব্যবসায়ী তৎপরতার কাহিনী উন্মোচিত হয়েছে।
কম চাঞ্চল্যকর নয় অপর একটি খবর। ভয়াবহই। এতে দেখা যাচ্ছে ভয়ঙ্কর এক বীরত্বের অভ্যুত্থান। খবরের শিরোনাম : ‘জামিনে-মুক্ত ধর্ষক-বৃদ্ধকে ফুল দিয়ে বরণ’। ভেতরের বিবরণ এই রকমের যে আখাউড়ায় শিশু-ধর্ষণ প্রচেষ্টায় ধরা পড়েছিলেন এক বৃদ্ধ, বয়স তাঁর ৮০। আক্রান্ত মেয়েটি এতিম। মামার বাড়িতে থেকে মাদ্রাসায় পড়ে। দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী। তার মামা একজন কৃষক। এতিম মেয়েটিকে আক্রমণ করেছিলেন ওই বৃদ্ধ, নাম তাঁর মুক্ত মিয়া। মেয়েটির মামা মামলা করেছে। ফলে মুক্ত মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু তিনি জামিনে মুক্ত হয়েছেন। তারপরে তাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিয়ে গাড়ি বহরসহ আনন্দ উল্লাসে নিজের এলাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। বাদ যায় নি মিষ্টিবিতরণও। এতে নাকি আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে মেয়েটির মামাবাড়িতে। মুক্ত মিয়ার সম্বর্ধনার গাড়িবহরে কয়েকটি প্রাইভেট কার ছিল, আর ছিল দশবারোটি মোটর সাইকেল। সমস্ত আয়োজনে নেতৃত্ব দেন মুক্ত মিয়ার পুত্র, যিনি একজন আইনজীবী। মুক্ত মিয়ার লোকেরা মেয়েটির মামাবাড়ির পাশ দিয়ে মিছিলও করেছে। (দেশ-রূপান্তর, ১৭-০৯-২০২০) তা ধর্ষণের আসামী যদি বীরের মর্যাদা ও সম্বর্ধনা পায় তাহলে তো বুঝতে বাকি থাকে না আমাদের অগ্রগতি কোন পথে ঘটছে এবং ঘটতে থাকবে।
যে ঘটনাগুলোর প্রত্যেকটিই তাৎপর্যবহ। বাবা মা’র ভালোবাসা একচ্ছত্র দাবীতে কিশোর হত্যা করেছে তার চার বছর বয়সী আপন ছোট বোনটিকে। উদারনীতিক রাজনীতির একটি দল বিলুপ্তির পথে, কট্টরপন্থী একটি দলের শক্তিসঞ্চয়। একশ’টি প্রাইভেট স্কুল বিক্রি। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে বিত্তবান পুরুষ মানুষকে ঠকানো। ধর্ষণের বৃদ্ধ আসামীর বীরোচিত সম্বর্ধনা, তাও আবার পুত্রের উদ্যোগে। সবমিলিয়ে খবর কিন্তু একটিই। সেটা হলো বিপদ ধেয়ে আসছে।
প্রশ্নটা পুরাতন। আমরা কি অন্ধকারের এই হওয়াটাকে মেনে নেবো? মেনে নেওয়া তো হবে নৈতিক ভাবে আত্মহত্যার শামিল। নাকি উঠে দাঁড়িয়ে রুখে দাঁড়াবো? দাঁড়াতে চাইলে সমষ্টিবদ্ধ হতে হবে।
দুঃসংবাদ শেষ হবার নয়। শেষ হয় না। ২৬ সেপ্টেম্বর বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বি’শতবার্ষিকী। ওই দিনের বাংলাদেশের খবরের কাগজে খবর এসেছে : “সিলেটে ছাত্রলীগ নেতাদের কাণ্ড : এম সি কলেজ ছাত্রাবাসে গৃহবধূকে গণধর্ষণ”। (ভোরের কাগজ, ২৮-০৯-২০২০)। সিলেট শহরের নববিবাহিত এক দম্পতি সন্ধ্যায় বেড়াতে বের হয়েছিলেন। এম সি কলেজের এক ছাত্রাবাসের সামনে পড়লে ছাত্রলীগের এক দঙ্গল কর্মী তাদেরকে ধরে নিয়ে যায় ছাত্রাবাসে। সেখানে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণ করে ছাত্রলীগের ওই ক্যাডাররা। স্বামী স্ত্রী দু’জনেই আর্ত চীৎকার করেছেন। শুনবার কেউ ছিল না। দুর্বৃত্তরা চলে গেলে অবশ্য আশেপাশের কোয়ার্টার্স থেকে শিক্ষক ও কর্মচারীরা কেউ কেউ এসে জড়ো হন।
সিলেটের এম সি কলেজ পুরানো, ১২৮ বছর তার বয়স। কলেজের ইতিহাস গৌরবের। সুনামে আঁচ পড়বার ঘটনা যে ঘটেনি, তা নয়, কিন্তু এবার যা ঘটলো তা অকল্পনীয়। একাত্তরে হানাদাররা এসব কাজ আকসার করেছে, কিন্তু তারা তো হানাদার ছিল। যুদ্ধ করে আমরা তাদেরকে তাড়িয়েছি। এখনকার হানাদাররা স্বদেশী। দম্পতিটি সিলেটের, ধর্ষকরাও স্থানীয়। ছাত্রাবাসে ধর্ষকদের নেতার কামরায় একটি পাইপগান, চারটি রামদা ও দু’টি লোহার পাইপ পাওয়া গেছে। সরকারিভাবে কলেজ এখন বন্ধ, ছাত্রাবাসও বন্ধ, কিন্তু ছাত্রলীগ সক্রিয় আছে; ওই কামরায় নাকি নিয়মিত জুয়ার ও মদ্যপানের কার্যক্রম চলতো।
২৭ তারিখের প্রথম আলোর প্রথম পাতায় ছাত্রলীগের এই নেতাকর্মীদের ছবি ছাপা হয়েছে। ভয়ঙ্কর সব চেহারা। পত্রিকাটির প্রথম পাতাতে এটিই প্রধান খবর, পাশে আরও দু’টি খবর আছে। একটি হলো ‘মা-বাবাকে বেঁধে পাহাড়ি তরুণীকে ধর্ষণ।’ আরেকটি : ‘যুবলীগের নেতার নেতৃত্বে ভয়ঙ্কর কিশোর গ্যাং’। সাভারে। খুঁটির জোর আছে, তাই দাবড়ে বেড়াচ্ছে।
সিলেটের ঘটনার প্রতিবাদ হয়েছে, সিলেটে এবং দেশব্যাপী। সামাজিক মাধ্যমে ঝড় উঠেছে। কিন্তু এই ঝড়ে তো দুর্বৃত্তরা উড়ে যাবে না, পুরানোরা গেলে নতুনরা আসবে। ভালো মানুষেরা দেখেও দেখবেন না, এবং কিছু মানুষ প্রতিবাদ করবেন। তাতে ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটবে না।
ওদিকে ছাগল দেখছি এখানেও আছে। বেচারা! শেয়ালের হাত থেকে তার নিষ্কৃতি নেই। প্রথম আলোর সংবাদদাতা জানাচ্ছেন যে ধর্ষকরা সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক রণজিৎ সরকারের অনুসারী। তার অনুসারীদের একদল গত ১১ মে এম সি কলেজের পেছনে টিলাগড় এলাকায় সরকারি ছাগল উন্নয়ন খামারে গিয়ে রণজিতের কথা বলে একটা পাঁঠা দাবী করে। না-দেওয়ায় তারা জেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তাকে মারধর করে। এতে মামলা করা হয়। ওই মামলায় যারা অভিযুক্ত তাদের মধ্যে ধর্ষকের মামলায় অভিযুক্ত দু’জনও রয়েছে। আটকে রেখে নারী ধর্ষণ যেমন, হত্যা করে পাঁঠার মাংস ভক্ষণও তেমনি, একই ক্রীড়া ও কৌতুক, খুঁটির জোরওয়ালা এই রাজনৈতিক কর্মীদের জন্য। বুয়েটের ছাত্রাবাসে আবরারকে হত্যা করাটাও কিন্তু ক্রীড়া-কৌতুকই ছিল, এই খুঁটির জোরওয়ালাদের জন্য।
২৬ তারিখের পত্রিকাতেই জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন-এর একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্ব পরিস্থিতি দেখে তিনি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। মনে হয় কণ্ঠ তাঁর বাষ্পরুদ্ধ। কোনো মতে বলেছেন, “নতুন বিশ্ব গড়তে বহুপক্ষকে এক পক্ষে আসতে হবে।” এটা খুবই খাঁটি কথা। ভালো মানুষদের ঐক্য চাই। ভালোর পক্ষে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু কার বিরুদ্ধে? শত্রুটা কে? শত্রু যে পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও মতাদর্শ সেটা তো বললেন না। সব খবর জানা গেল, শুধু এই খবরটাই রইলো লুকিয়ে। আর কতকাল এই অপরাধী গা-ঢাকা দিয়ে থাকবে?
দুঃস্বপ্ন কিন্তু ভাঙবে না স্বপ্ন যদি না জাগে। মাঝখানে কিছু নেই। শেয়ালেরা ধেয়ে আসছে। এই শেয়ালেরা বনের শেয়ালদের তুলনায় অনেক ধুরন্ধর, হিংস্র ও লোলুপ; কারণ এরা পুঁজিবাদী। সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে তবে ছাড়বে, গৃহস্থরা যদি ধাওয়া না দেয়।
লেখক : শিক্ষাবিদ; ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়