দেশে জ্বালানি তেলের সরবরাহ নির্বিঘ্ন রাখতে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনকে (বিপিসি) প্রতিদিন ৬০ কোটিরও বেশি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। এই লোকসান অব্যাহত থাকলে বছর শেষে এর পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে বিপিসির লোকসানের পাল্লা ভারী হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কিছুটা কমেছিল। গত তিন দিন ধরে আবারো বাড়তে শুরু করেছে। মূল্যবৃদ্ধির ফলে প্রতি লিটার ডিজেলে ২৮ থেকে ৩০ টাকা, প্রতি লিটার অকটেনে ১০ থেকে ১২ টাকা এবং প্রতি লিটার জেট ফুয়েলে ২০ থেকে ২১ টাকা করে লোকসান দিচ্ছে বিপিসি।
দেশের জ্বালানি তেলের প্রায় পুরোটাই আমদানি নির্ভর। বিশ্বের নানা দেশ থেকে ক্রুড ও রিফাইনড অয়েল এনে চাহিদা মেটানো হয়। বিপিসি জ্বালানি তেলের একমাত্র নিয়ন্ত্রক সংস্থা। করোনা মহামারির কারণে গত বছর ডিজেলের ব্যবহার কম হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা ছিল প্রায় ৬৩ লাখ টন। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় তেলের চাহিদা বেড়েছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে এই চাহিদা আরও ৪ লাখ ৫০ হাজার টন বেড়ে ৬৭ লাখ ৫০ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে। গত ২০২০-২১ অর্থবছর দেশে ব্যবহৃত ৬৩ লাখ মেট্রিক টন জ্বালানি তেলের মধ্যে ডিজেলের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৬ লাখ টন। ফার্নেস অয়েল ছিল ৫ লাখ ৫৯ হাজার টন, অকটেন ৩ লাখ টন, পেট্রোল ৩ লাখ ৭৮ হাজার টন ও কেরোসিন ১ লাখ টনের বেশি। দেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের মধ্যে ৭৩ শতাংশ ডিজেল।
বিপিসিকে কোটি কোটি টাকা লোকসান দিয়ে জ্বালানি তেলের চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। এই খাতে বিক্রি যত বাড়ে লোকসানও সমানতালে বাড়ে বলে মন্তব্য করে বিপিসির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে প্রতি ব্যারেল ডিজেলের দাম ১৭৬ ডলার হয়েছিল। এর আগে কখনো তেলের দাম এত বাড়েনি। ২০০৮ সালের জুলাই মাসে ডিজেলের দাম সর্বোচ্চ ১৭২ ডলার পর্যন্ত ওঠার রেকর্ড ছিল। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির এমন পরিস্থিতিতে আমেরিকা তেল বিক্রির ঘোষণা দিলে বাজার পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়। দাম কমতে শুরু করে। ১৭৬ ডলার থেকে কমে ১১২ ডলারে এসে ঠেকে। স্বাভাবিক সময়ের ৮০ থেকে ৯০ ডলারের স্থলে ১১২ ডলার হলেও কিছুটা স্বস্তি মিলেছিল। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে আবারো বাড়তে শুরু করেছে দাম। গত এক সপ্তাহে তেলের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪৩ ডলারে। যুদ্ধ লাগাতার হলে এই দাম আরও বাড়তে পারে বলে শঙ্কা আছে।
বিপিসিকে প্রতিদিন ১৫ হাজার টন ডিজেল, ১১শ টন অকটেন ও প্রায় ৯শ টন জেট ফুয়েলসহ অন্যান্য জ্বালানি তেল সরবরাহ দিতে হয়। সংরক্ষণের সুযোগ কম থাকায় বিপিসিকে প্রায় প্রতি মাসে কয়েকটি করে চালান আমদানি করতে হয়। এতে করে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বাড়লে বিপিসিকেও বাড়তি দামে তেল আনতে হয়। দেশে তেলের দাম নির্ধারিত থাকায় বাড়তি দামে কেনা তেল লোকসানে বিক্রি করতে হয়।
চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল ডিজেলের দাম ছিল ৯৪ ডলার। তখন বিপিসির কেনাবেচা একই সমান ছিল। লোকসান গুনতে হচ্ছিল না। কিন্তু ১২ জানুয়ারি ডিজেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৯৫ দশমিক ৫৭ ডলারে উন্নীত হতেই বিপিসির লোকসান শুরু হয়। সেই থেকে বিপিসি কোটি কোটি টাকা লোকসান দিয়ে জ্বালানি তেল সরবরাহ করছে।
বর্তমানে প্রতি লিটার ডিজেলে ২৮ থেকে ৩০ টাকা লোকসান দিয়ে বিক্রি করার ফলে শুধুমাত্র ডিজেলে বিপিসিকে দৈনিক লোকসান গুনতে হয় প্রায় ৫৫ কোটি টাকা। প্রতি লিটার অকটেনে ১০ থেকে ১২ টাকা কমে বিক্রি করার ফলে বিপিসিকে দৈনিক লোকসান দিতে হয় প্রায় ২ কোটি টাকা। জেট ফুয়েলে প্রতি লিটারে অন্তত ২৫ টাকা কমে বিক্রি করতে গিয়ে বিপিসির লোকসান বাড়ে আরো অন্তত ৩ কোটি টাকা। এছাড়া পেট্রোল ও কেরোসিনসহ অন্যান্য খাতেও লোকসান গুনতে হয় বিপিসিকে। সব মিলে বিপিসির লোকসান হচ্ছে দৈনিক ৬০ কোটিরও বেশি টাকা। বিদ্যমান লোকসান অব্যাহত থাকলে বছর শেষে এর পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা।
বিপিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, লোকসান কমানোর কোনো পন্থা বিপিসির হাতে নেই। এটি পুরোপুরি সরকারি সিদ্ধান্তের ব্যাপার। সরকারকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। এখন সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।