চট্টগ্রাম নগরীতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ব্যাটারি চালিত রিকশা। ব্যাটারি রিকশার লাগাম টেনে ধরতে পারছে না কেউ। দিন দিন সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, অপরাধীরা যেমন জামিনে এসে পুনরায় একই অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, ঠিক তেমনি ব্যাটারি রিকশার বিরুদ্ধে জরিমানা করা হলে জরিমানা দিয়ে তারা পুনরায় গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নামছে। বিদ্যুৎ যতটুকু জুটছে, অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ তার একটি বড় অংশ কেড়ে নিচ্ছে। দিনে-রাতে লোডশেডিং কেড়ে নিচ্ছে কর্মচাঞ্চল্য।
সিএমপির সাবেক কমিশনার সালেহ্ মোহাম্মদ তানভীর ১৬ থানার ওসিদের নির্দেশনা জারি করেছিলেন, সংশ্লিষ্ট এলাকায় ব্যাটারি রিকশা চলাচল করলে দায় নিতে হবে ওসিকেই। একই সঙ্গে শুধু রিকশা জব্দ নয়, যেসব গ্যারেজে এসব রিকশা রাখা হয় ও ব্যাটারির চার্জ দেওয়া হয় সেসব গ্যারেজ মালিককেও আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু ব্যাটারি রিকশার দাপট কমানো যায়নি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ব্যাটারি রিকশা সবচেয়ে বেশি চলাচল করছে বন্দর, ইপিজেড, কর্ণফুলী, বায়েজিদ, চান্দগাঁও ও বাকলিয়া থানা এলাকার সড়ক ও উপ-সড়কে। অন্য থানাগুলোতে চলাচল করলেও সেটা আড়ালে আবডালে। মূলত উপ-সড়কেই। এসব রিকশাচালকের বেশিরভাগেরই দ্রুত গতিসম্পন্ন ব্যাটারি রিকশা চালানোর কোনো অভিজ্ঞতা নেই। অন্য জেলা ও বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা থেকে কাজের সন্ধানে নগরে এসে ব্যাটারি রিকশা চলাচলে নেমে যাচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে দরিদ্র প্রতিবন্ধীদের আয়ের উৎস হিসেবে এই সকল রিকশা চলতে দেওয়া হলেও বর্তমানে তা ব্যবহার করছে সকলে। এই যান চালাতে সহজ হওয়ায় অনেক সুস্থ মানুষ প্যাডেল চালিত রিকশা ছেড়ে বেছে নিচ্ছে এই রিকশা। ট্রাফিক আইন সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা না থাকায় এসব চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে প্রতিনিয়ত। গত ৫ সেপ্টেম্বর ও ১ জুন ব্যাটারি রিকশার ধাক্কায় দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, জামালখান, চেরাগী পাহাড়, আন্দরকিল্লা, জেল রোড, পাথরঘাটা, খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জ, চাক্তাই, আসকার দীঘির পাড়, চকবাজার ডিসি রোড, বাদশা চেয়ারম্যান ঘাটা, বাকলিয়া সৈয়দ শাহ রোড, আবদুল লতিফ হাট, বহদ্দারহাট খাজা রোড, খতিবের হাট, মুরাদপুর-অঙিজেন রোড, বায়েজিদ বোস্তামী রোড, চান্দগাঁও সিঅ্যান্ডবি এলাকার অলিগলিতে অবাধে ব্যাটারি রিকশা চলছে। প্রতিটি সড়কে গড়ে দশটি রিকশার মধ্যে অন্তত চারটি রিকশা ব্যাটারি চালিত।
তথ্য মতে, নগরীতে প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ হাজার ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করে। বৈদ্যুতিক মোটরচালিত এসব রিকশার প্রতিটির ব্যাটারি চার্জ দিতে দৈনিক খরচ হয় ৮ দশমিক ৭৫ ইউনিট বিদ্যুৎ। সে হিসেবে প্রতিদিন খরচ হয় ৮৭ হাজার ৫০০ ইউনিট বিদ্যুৎ। প্রতিদিন ৭০ টাকার বৈদ্যুতিক চার্জ দিতে হয় এসব রিকশায়। গতকাল বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে কাটাপাহাড় লেইন থেকে বঙিরহাট-চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ হয়ে পাথরঘাটা যাওয়ার পথে ব্যাটারি রিকশার চালক সুমন তার রিকশার অনুমোদন না থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, অনুমোদন না থাকলেও আমরা সড়কে গাড়ি চালাচ্ছি। এজন্য মালিককে দৈনিক দিতে হয় তিনশ টাকা। ব্যাটারি চার্জ দিতে খরচ হয় ৭০ টাকা। চার ঘণ্টা চার্জ দিলে আট ঘণ্টা চালানো যায়। তিনি জানান, দিনে অলিগলিতে চালান। আঁধার ঘনিয়ে এলে মূল সড়কে মাঝেমধ্যে ‘টেনে’ চলে যান। রাত ৯টার পর মূল সড়কে উঠেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ট্রাফিক সার্জেন্ট আজাদীকে বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশা ধরে ডাম্পিং ফি নিয়ে অনেক সময় ঘটনাস্থলে ছেড়ে দিই। মাঝেমধ্যে ডাম্পিংয়েও পাঠাই। কখনো প্রধান সড়কে চলে এলে মানবিক কারণে ছেড়ে দিই। মাঝে মাঝে একটু-আধটু পানিশমেন্ট করে র্যাকার বিল করি। যদিও র্যাকার বিল করার কোনো নিয়ম নেই। তবে অটোরিকশা ডাম্পিংয়ের নিয়ম আছে।
চালকদের দেয়া তথ্য মতে, সিরাজদ্দৌলা রোড থেকে বাকলিয়া পর্যন্ত এলাকায় ২০-২৫টি ব্যাটারি চার্জের গ্যারেজ খোলা হয়েছে। এর কোনোটি বস্তির মধ্যে, কোনোটি রাস্তার পাশের দোকানের পেছনে। একইভাবে হালিশহর, ছোটপোল, পাহাড়তলী আমবাগান, কর্নেলহাট এলাকায় এসব গাড়ির মালিকের অনেকে ঘরের সংযোগ থেকে নিজের একাধিক গাড়ি চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।
সিএমপির ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (দক্ষিণ-প্রসিকিউশন) অনিল বিকাশ চাকমা আজাদীকে বলেন, আমরা জরিমানা করতে পারি। জরিমানা দেয়ার পর গাড়ি আটকে রাখার এখতিয়ার নেই। জরিমানা পরিশোধ করছে, আবার রাস্তায় নামছে। আমরা আবার ধরে জরিমানা করছি। বিষয়টা আইনগত প্রক্রিয়ার মধ্যেই আছে। প্রধান সড়কে যেন এগুলো না আসতে পারে সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু অলিগলিতে আমরা সচরাচর যাই না। জনবল সংকট একটা বড় কারণ।
সিএমপির ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) বিপ্লব কুমার পাল আজাদীকে বলেন, ব্যাটারি রিকশার চলাচল অনেক আগেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ট্রাফিক পুলিশের জন্য তারা মূল সড়কে সচরাচর চলাচল করতে পারে না। তবে অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোতে চলছে। তিনি জানান, ট্রাফিক পুলিশের হাতে ধরা পড়লে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ফাঁকি দিয়ে যে চলছে না তা বলছি না। কিন্তু সার্জেন্টদের চোখে পড়লেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।