দীর্ঘ আঠারো মাস পর এসে চট্টগ্রাম রাউজান গহিরা চৌমুহনী চিনতে পারছিলাম না। মনে হলো এক খন্ডিত উপশহরে এসে পৌঁছেছি। গহিরা হাই স্কুল থেকে গহিরা মাদ্রাসা মাত্র দুই কিলোমিটার জায়গা। বর্তমান সরকারের উন্নয়নের ছোঁয়ায় আমূল পরিবর্তন। আমি চিনতে পারছিলাম না আমার নিজ গ্রামকে। আমার মনে হল আমি কোরআনে বর্ণিত আসহাবের কাহাফের একজন সদস্য। একটি নিবৃত্ত গুহায় ১০০ বছর মতান্তরে ৩০০ বছর ঘুমিয়ে ছিলাম। জেগে দেখি আমার গহিরা চৌমুহনী কই?
হিমাংশু লন্ড্রি, গাউছিয়া হোটেল, মনি বাবুর
সেলুন, জাফর ভাইয়ের ছোট্ট বাদাম চনা বুটের দোকান, গাফফারের মাইক সার্ভিস, অঙ্কুর ঘোনা রাস্তার পাশে ইসমতের দোকান সাহসী আওয়ামী লীগ কর্মী, ওরা কেউ নেই। নেই বঙ্গবন্ধু প্রেমিক পরিচিত মুখ বদিউর রহমান মেম্বার। একনিষ্ঠ বঙ্গবন্ধু প্রেমিক। কমিউনিস্ট পার্টির কমুদ রঞ্জন সিংহ। অনেক লম্বা চওড়া মানুষ। লাঠি হাতে নিয়ে বিশ্বাস বাড়ি থেকে আসতো। শত দুঃখের মাঝেও হাসি। সমাজতন্ত্রের জন্য মনে প্রাণে ভালোবাসতো লেলিনকে।
আমি চিনতে পারছিলাম না আমার পরিচিত গ্রামকে।
৭০ দশকে কত মিছিল মিটিং করেছি। দলবেঁধে শফী নাজিম সবাই মিলে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে রাউজান ফকিরহাটে যাওয়া, জননেতা আব্দুল্লাহ আল হারুনের বাসভবনে দৌঁড়ে যাওয়া। এক নজরে বঙ্গবন্ধুকে দেখা।
আহা! কোথায় হারিয়ে গেল আমাদের সোনার দিনগুলো।
শহর থেকে একটি মাইক্রোবাস নিয়েছিলাম, ভাইয়েরা যারা শহরে থাকে তাদেরকে এবং তাদের বউদের নিয়ে আমার এই গ্রামের যাত্রা। গ্রামে আমাদের সব ভাইদের মিলে দ্বিতল বাড়ি। সামনে কাছারি ঘর। মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি বিজড়িত আমাদের সামনের পাকা দালানটি।
সবাই শহরে থাকে বিধায় পুরানো স্মৃতি বিজড়িত দালানটি বহুদিনের ব্যবহার পুরানো গাড়ির মতো হয়ে গেছে। তেল মবিলের অভাবে অযত্নে পড়ে আছে।
একজন কেয়ারটেকার আছে। সেই দেখাশোনা করে।
আমাদের পুরানো রায়তী প্রজাগুলো তাদেরও জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কয়েকঘর ছিল আমাদের সামনে। মধ্যপ্রাচ্যের বদৌলতে সবাই মোটামুটি সচ্ছল। তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে এখন ৮২ জন। আমাদের বাড়ির প্রকৃত মালিক এখন তারাই। আমরা মেহমান।
গহিরা চৌমুহনিতে নেমেছি, বাজার করবো, আমার জেঠাতো ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা বিশিষ্ট সাংবাদিক শফিকুল আলম খান, (প্রাক্তন ডাইরেক্টর রেলওয়ে জনসংযোগ বিভাগ) আমরা একসাথে বেড়ে উঠেছি। তার মা আমার মা, আমার মা তার মা এইভাবে আমাদের বেড়ে উঠা। স্কুলে মানবিক বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয়ে উভয়ে অর্থনীতি বিভাগ, একসাথে বই পড়া, সিনেমা দেখা, মুক্তিযুদ্ধে যোগদান। আমাদের সবাই শফি মারুফ নামে অথবা মারুফ শফি নামে আমরা সমগ্র রাউজান থানায় পরিচিত ছিলাম। অনেকে মারুফ–শফি এক নাম মনে করত। বিশেষ করে আমি ভালো বক্তৃতা দিতে পারতাম বলে আমাকে মনে করত।
যেহেতু জুমাবার। মা–বাবার জিয়ারত করবো। শফি সাহেব এখন চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত। আমাদের বাড়িতে ছোটবেলায় তার ডাকনাম বাবুল এই নামেই বেশি পরিচিত আপনজনদের মাঝে।
এখন বাড়িতে বলতে গেলে কালের পরিক্রমায় আমরা দুজনেই বয়োজ্যেষ্ঠ। সুতরাং টেলিফোনে বলে তাকেও সঙ্গী করে নিলাম। গ্রামের বাড়িতে জুমা আদায় করবো।
দুপুরে একসাথে খাওয়া–দাওয়া করবো। নিজেই বাজার করার জন্য দায়িত্বে নিয়ে নিলাম। গহিরা চৌমুহনীতে নামে মাইক্রোবাস নামিয়ে আমার ইমিডিয়েট ছোট ভাই মাওলানা মামুনুর রশিদকে নিয়ে বাজার করছি। তীব্র গরম। ছোট ভাই মোকাররম রাঙ্গামাটি থাকে, সেইখানে ব্যবসা করে, তাকে বলছি মুরগি নিয়ে আসার জন্য।
গহিরা চৌমুহনীতে বাজার করছি। একটি লম্বা পাতলা দেহ একজন ভিক্ষুক আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।
বয়সের ভার বোঝা যাচ্ছিল। আমি তাকে চিনতে পারলাম। পশ্চিম গহিরা অঙ্কুর ঘোনা বাড়ি। বৌদ্ধ সমপ্রদায়ের। রিক্সা চালাত। তার রিকশায় মাইক বাজিয়ে অনেক জনসভার ঘোষণা দিয়েছি।
প্রায় মনে হয় ৪৫ বছর পর দেখা। আমি চিনতে পেরে তার হাতে ৫০ টাকা দিয়ে দিলাম। তার বাড়ি আমার বাড়ি অনেক তফাৎ। ৬৯–৭০–৭১ গণ আন্দোলনে সে আমাদের রাজপথে দেখেছি।
কৌতূহল বসত তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তার বয়স হয়েছে প্রায় ৮০ বছরের মত। এক সময় রিঙা চালাত গহিরা চৌমুহনী সত্তারঘাট এইসব জায়গায়।
আমি তাকে বললাম বলুন তো আমি কে?
সে আমার এক নজর দেখলো, বলল তুমি মারুফ শাহ।
আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম, ওরা আমাদের চিনে রেখেছে, কতদিন তাদের সাথে দেখা হয় নাই, সেই আমাদের কৈশোর দুনিয়া কাঁপানো দিনগুলোতে আমাদের দেখেছি। তারা আমাদের মনে রেখেছে।
একটু ডান পাশে তাকাতে সুন্দর আমার গ্রামের স্কুল চোখে পড়ল। মনে হলো দার্জিলিং এর কোনো কনভেন্ট স্কুল।
আকাশের দিকে চোখ মেলে তাকালাম। আমার মনের গভীরের ছায়া ছবিতে অনেক ছবি একের পর এক উদয় হচ্ছে। গরম পরছে খুব। বাজার নিয়ে মাইক্রোবাসে উঠে পড়লাম। উঠে বউয়ের ধমক। এতক্ষণ গরমে করছো কী? কী জবাব দেব। উনি তো বুঝবেন না এই গ্রাম আমার জন্মভূমি, আমার অফুরন্ত ভালোবাসা। আবার মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের অহংকার। মাইক্রোবাস ছেড়ে দিল। গহিরা হাই স্কুল থেকে মোবারক খীল কি সুন্দর পাকা রাস্তা। একসময় কাদামাটির জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। স্কুল আসার সময় আমাদের সবাইকে পা ধৌত করতে হতো, স্কুলের পুকুরে, অথবা কাজী জাফর ভাইদের সামনের পুকুরে।
দিন বদলে গেছে। আসহাবে কাহাফের সেই সদস্যের মতো চারিদিকে চোখ মেলে তাকালাম। এটা কী দেখছি? আবার কি ঘুমিয়ে যাব?
আবহমান জীবনের এইতো পথচলা। আসা যাওয়া পথের ধারে অথবা আমাদের পথ চাওয়াতে আনন্দ।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা