দারুচিনির দ্বীপ এখন জ্বলছে দাবানলে ও ক্ষুধায়

অনুপ দাশ গুপ্ত | মঙ্গলবার , ১৯ জুলাই, ২০২২ at ৫:৪১ পূর্বাহ্ণ

শ্রীলঙ্কা আজ অস্তিত্বহীনতায় ভুগছে। বিপন্ন শ্রীলঙ্কানরা মরা-বাঁচার লড়াই করছেন। সেখানে এখন আর আইনের অনুশাসন নয়, জনগণের অনুশাসনই শেষ কথা। গণতন্ত্রের কী নিষ্ঠুর পরিহাস! হঠাৎ কেন এমন হলো? রাষ্ট্রপ্রধানরা কিছু জানতেন না? নিকটবর্তী এমন প্রতিবেশী দ্বীপ রাষ্ট্র আমাদেরও মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে। দু’দেশের মধ্যে আমাদের শুধু মহাকাব্যিক সম্পর্ক নয়, এক সময় এই বাংলা ও ভারতবর্ষের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল সিংহল নামে। সে সময় চাঁদ সওদাগর সপ্তডিঙ্গা চড়ে ওই সমুদ্রদ্বীপে ব্যবসা করতে যেতেন। কবি জীবনানন্দ দাশ ওই ঘুম পাড়ানির দেশে গিয়ে তাঁর প্রেমিকা বনলতাকে খুঁজে পেয়েছিলেন মলয় নদীর হাওয়ায় ওই শান্ত ছায়াশ্রী দারুচিনি দ্বীপের মধ্যে। সমুদ্র, বন, পাহাড় ঘেরা রূপকথার মতো এমন সবুজদ্বীপ কবিতার দেশ না হয়ে পারে! শ্রীলঙ্কা আমাদের নষ্টালজিক এক ভালোবাসার দ্বীপ। আমাদের ইতিহাসে শ্রীলঙ্কা এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় দখল করে আছে। সম্রাট অশোক ওই দ্বীপ রাষ্ট্রকে বৌদ্ধ ধর্মে দিক্ষিত করেছিলেন। সেই ভালোবাসা, অহিংসার দেশে আজ ভালোবাসার সংকট, অহিংসাহীন সহিংসে মরণাপন্ন! একসময় জাতিদাঙ্গা দীর্ণ শ্রীলঙ্কা এখন নতুন সংকটে। সাক্ষাৎ সলিল সমাধির হাত থেকে লঙ্কাবাসীকে বাঁচাতে, এখনই মানবিকতার হাত বাড়ানো দরকার। শ্রীলঙ্কায় বর্তমানে যা ঘটছে, বিশ্ব ইতিহাসে তা বিরল। প্রবল জনরোষ সে দেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ পটপরিবর্তনের দ্বার খুলে দিয়েছে।

একনায়কতন্ত্রের অন্তিম পরিণতি লুটপাট ও বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়েই। ইতিহাস বা সাহিত্য-তার প্রমাণ দিয়েছে বারেবারে। রান্নাঘরে রান্না করছে কেউ। কেউ টেবিলে সেরে নিচ্ছে প্রাতঃরাশ। তকতকে বাথরুমের আয়নায় কেউবা চোখে মুখে পানি ঝাপটা দিচ্ছে। টলটলে সুইমিং পুলে গা ডুবিয়েছে অনেকে, সাঁতরেও নিচ্ছে জনাকয়েক। এই সমস্ত দৃশ্যে অসংগতির কিছু আছে কি? এ তো চোখে পচন-ধরানো বাসি দৈনিক দৃশ্যাবলি। কিন্তু যদি বলা হয়, এই ঘটনাগুলি ঘটে চলছিল শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতির বিলাসবহুল প্রাসাদে, এবং এই মানুষেরা, আসলে বিক্ষোভকারী, তাহলে? মানে, এই রান্নাঘর তাদের না, সুইমিং পুলও নয়, বাথরুমও নয়। তারা অনুপ্রবেশকারী। চূড়ান্ত বিক্ষোভের বশে এই প্রাসাদোপম বাড়িতে এসে পড়েছে আর তারপরেই এই হুলুস্থুল, লুটপাট ও আনন্দোচ্ছ্বাস। না-পাওয়ার ও শোষণের সর্বোত্তম গ্লানি নিয়ে চলা এই জনসাধারণ যখন এসে পড়ে তাদেরই রাষ্ট্রপতির প্রাসাদে, টের পায়, সাধারণের না-পাওয়ার একাংশও আসলে এই জনপ্রতিনিধি বহন করছেন না। দেশে যখন চূড়ান্ত অব্যবস্থা, জ্বালানি ও খাদ্য সংকট চরমে, তখনও এই প্রাসাদের অভ্যন্তর হয়ে রয়েছে এক সব পেয়েছির দেশ। সেই দেশেরই রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপাকশে। যে-দেশ জর্জরিত, যে-দেশ সংকটে ক্লান্ত, খিদেয় উম্মুখ সেই শ্রীলঙ্কার কেউ নন।

গণঅভ্যুত্থানে চিরকালই এই বিশৃঙ্খলার অন্তঃস্রোতটিকে স্পর্শ করা যায়। ইতিহাস ঘাটলেও এর পক্ষে সমর্থন মিলবে। সমপ্রতি, কিছুদিন আগে যেমনটা দেখা গিয়েছে আফগানিস্তানে। মানবিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক এই ত্রিমুখী বিস্ফোরণে জনজীবনে নেমে এসেছিল সেই অরাজক পরিস্থিতি। লাতিন আমেরিকার গল্প-উপন্যাসেও লেখা রয়েছে যে, একনায়কতন্ত্র আবছা হয়ে মিলিয়ে গিয়েছে এই গণঅভ্যুত্থানেই। এবং সেখানেও জনারণ্য প্রবেশ করেছে একনায়কদের চার দেওয়ালের ভিতর। আর প্রবেশের অব্যবহিত পরেই অনুভব করেছে জীবনাচারণের এই অসীম দূরত্ব। একদিকে সুখভোগের অনন্ত কেলি, অন্যদিকে কাজের, খাদ্যের অমিল, চিকিৎসার সংকট, বিবর্ণ জনজীবনের ধস্ত প্রবাহ। একনায়কের প্রাসাদ, প্রবেশ করতেই আসলে বেপর্দা হয়ে পড়ে, আবিষ্কৃত হয় জনমানুষ ও একনায়কের এই বিষম ফারাক জীবনবোধে, বিলাসিতায়। এবং তারপরই এই লুঠপাটের ক্রমবিক্রম। এতকালের তেলচিটে বির্মষতা হঠাৎই মারমুখী। একঝটকায় তাই ছিনিয়ে নেওয়া খানিক বিলাস, যা তাদেরই রক্ত ও পানির বিনিময়ে। অথচ যে জীবন তারা স্পর্শ করতে পারেনি কোনও দিনই।

ঔচিত্য বিষয়ক তর্ক-বিতর্কের শুকনো মালা এসে পড়তেই পারে আবারও সময়ের হাড় জিরজিরে গলায় কিন্তু একথা ফের প্রমাণিত হল যে, একনায়কতন্ত্রের অন্তিম পরিণতি এই বিশৃংখলায়, লুঠতরাজেই। প্রতিমুহূর্তে জনসাধারণকে অসুখী রেখে সেই আবর্ত থেকে বহুদূরে থাকার এই নিঃসংকোচ ভঙ্গিমা প্রতিবারেই হয়তো ভেঙে যাবে এই অবিন্যস্ত গণঅভ্যুত্থানে। একনায়কের একরোখামি, বেভুল সিদ্ধান্ত আর শাসকদের আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করার কাটাকুটি খেলায় ছিন্নভ্‌ন্ন শ্রীলঙ্কা। মানুষ রুজি হারা, অসহায়, নিঃসম্বল। এই লঙ্কাকাণ্ডের জন্য দায়ী কোন রাবণ?

সভ্যগজতে প্রাত্যহিক জীবনে যা যা অকল্পনীয়, যেমন-খাবারের জন্য লাইন, পেট্রোলের জন্য লাইন, কারেন্ট না থাকা সেই সমস্তই বাস্তব হয়েই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শ্রীলঙ্কায়। আর তার দাপটে রাস্তায় নেমে পড়েছে মানুষ। সেসব দৃশ্য এখন ভাইরাল। যদি ধরে নেওয়া হয়, আফগানিস্তানে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি ব্যর্থ হয়েছিল, এবং চীনের ইসলামাবাদের মাধ্যমে তালেবানদের মদত দেওয়ার কৌশল সফল ছিল, তাহলে শ্রীলঙ্কায় এবার বেজিং-ও পিছু হটছে। আর ওয়াশিংটন ‘ত্রাতা’-র ভূমিকায় দেখা দিতে পারে। মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব অ্যান্টনি ব্লিন্‌েকন, যিনি এই মুহূর্তে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সফররত, তাঁর দফতরের তরফে গত কয়েকদিন আগে, যে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকশদের বাদ দিয়ে সর্বদলীয় সরকার হলে মার্কিন সাহায্য মিলতে পারে। এই সঙ্গে ‘আইএমএফ’, যারা একদিন শ্রীলঙ্কার জন্য তেমন কোনও সাহায্য বা ‘বেস আউট প্যাকেজ’ঘোষণা করেনি, তাদের তরফেও সদর্থক ইঙ্গিত রয়েছে। আইএমএফ -কে কলম্বোর জন্য সদয় করার বিষয়ে অবশ্য বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ রনিল বিক্রমসিঙ্গের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। রাজাপাকশদের পাশে থেকে শেষ দু’মাস প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের জন্য যদিও গত ৯ জুলাই রাজধানী কলম্বোয় বিক্ষোভকারীরা রনিল বিক্রম সিঙ্গের ব্যক্তিগত বাড়িও পুড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু অস্বীকার করে লাভ নেই যে, রনিল যে নিরলস চেষ্টা করেছিলেন, তাতে হয়তো এবার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা সাড়া দেবে। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট ঠিক কতটা গভীর? আন্তর্জাতিক মহলের মতে, আগামী ছ’-মাসে শ্রীলঙ্কার অন্তত ৬ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দরকার। এই মুহূর্তে কলম্বোর হাতে রয়েছে মাত্র ২৫ মিলিয়ন ডলার। যা খুব, খুব জরুরি রফতানির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতে পারে। শ্রীলঙ্কার বিদেশী ঋণ ৫১ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে সিংহভাগ-ই চীনের থেকে নেওয়া চড়া সুদের ঋণ। গত কয়েক মাসে রাজাপাকশের সরকারের ভুল ভাল নীতির জন্য এই দ্বীপরাষ্ট্রে খাদ্যদ্র্যবের দাম বেডেছে ৫৭ শতাংশেরও বেশি। আর মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৮০ শতাংশ। এখন ১ ডলারের বিনিময়ে শ্রীলংকার ৩৬০ রুপি পাওয়া যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে শ্রীলঙ্কার গণমাধ্যম মন্ত্রী নালাকা গোদাহেয়া ব্রিটিশ সংবাদপত্র ‘গার্ডিয়ান’-কে যে বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছে, তা-ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেওয়ার মতো।

নালাকা গোদাহেয়া, যিনি দীর্ঘদিন শ্রীলঙ্কার শেয়ার বাজারের কর্তা ছিলেন। সিরিসেনা রনিল বিক্রমসিঙ্গের সরকার ২০১৫-য় ক্ষমতায় আসার পর নালাকাকে জেলে ভরলেও ২০১৮ থেকে তিনি গোতাবায়া রাজাপাকশের ছায়াসঙ্গী। রাজাপাকশেরা শ্রীলংকার কী ধরনের অর্থনৈতিক সর্বনাশ করেছেন, তার অনুসন্ধান করতে গিয়ে,‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’ শ্রীলঙ্কার এই প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের নিজেদের এলাকা, হামবানটোটা নিয়ে, একটি চমৎকার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই হামবানটোটার বন্দর-ই চীনের হাতে তুলে দেওয়া নিয়ে, এবং ভারত মহাসাগরে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি নিয়ে নয়াদিল্লী এবং ওয়াশিংটনের একগাদা উদ্বেগ ছিল। সেখানে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়েছে। ঝকঝকে ক্রিকেট স্টেডিয়াম হয়েছে, দুর্দান্ত এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু এসব পরিকাঠামোর ব্যবহার কী করে হবে, বা রাস্তা তৈরি করতে যে বিপুল অর্থ খরচ হয়েছে, তা কীভাবে ফেরত আসবে, সেসব পরিকল্পনা রাজাপাকশদের ছিল না। তাই রাজাপাকশরা কেবল প্যালেস ফেলে পালাননি, তাদের খাসতালুকও খাঁ খাঁ করছে। আর্থিক সংকটে শ্রীলঙ্কা ধুঁকছে। লঙ্কাবাসী খেতে পাচ্ছেন না। অথচ প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকশের সরকারি বাসভবনে লুকানো লক্ষ লক্ষ রুপী! রুপী ছাড়াও প্রেসিডেন্টের বাড়িতে গোপন বাঙ্কার রয়েছে। নিরাপত্তায় মোড়া। বাঙ্কারে বিলাসী জীবনযাত্রার সমস্ত উপকরণ মজুত। প্রেসিডেন্টের বাড়ি থেকে বস্তা বস্তা টাকা উদ্ধার করে প্রতিবাদকারীরা বলছেন-‘আমরা কষ্ট পাচ্ছি। আর ওরা ফুর্তি করছেন’। এখনও লাপাত্তা প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্ট প্যালেস ছেড়ে পগারপার। অর্থনীতি ধস। মানুষ দিশেহারা। খাঁ খাঁ করছে রাজাপাকশদের সাধের হাম্বানটোটা-ও। চীনের মুখে কুলুপ। শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার এই বিলাসী জীবনের গল্প ও গদিছাড়ার গল্প পড়তে পড়তে যে কোনো পাঠকের মনে পড়বে এই উপমহাদেশের বিখ্যাত গায়ক ভূপেন হাজারিকার গানের সেই বিখ্যাত কলি-‘ঘুমে চোখ ঢুলু ঢুলু রাজা মহারাজাদের, আমাদের ঘাম ঝরে পড়ে,/দু’চোখে জল এলে মনটাকে বেঁধে যে,/ তবুও বয়ে যায় দোলা …/ ঐ রাজা মহারাজাদের দোলা..’।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধএসির বিকল্প হতে পারে সবুজ ভবন সবুজ দেয়াল : কার্বন নির্গমন কমানোর হাতিয়ারও
পরবর্তী নিবন্ধপ্রদীপ-চুমকির বিরুদ্ধে রায় ২৭ জুলাই