দারিদ্র্য নির্মূলে উন্নয়ন সংস্থা ও রাষ্ট্রের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন

| শনিবার , ৬ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৫:৪২ পূর্বাহ্ণ

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) ‘ডিসিসিআই জার্নাল অব বিজনেস অ্যান্ড ইকোনমিক পলিসি’এর দ্বিতীয় সংস্করণ এবং ‘ট্যাক্স গাইড ২০২৫২৬’এর প্রকাশনা অনুষ্ঠান বক্তারা বলেছেন, সমপ্রতি সরকারিবেসরকারি বেশ কয়েকটি প্রতিবেদনে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হয়েছে, যা বেশ উদ্বেগের। সামগ্রিকভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করা সম্ভব হলে দারিদ্র্য বৃদ্ধির আশঙ্কা দূর হবে। তবে এ ক্ষেত্রে রপ্তানিমুখী শিল্পায়নের প্রতি বেশি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। এ জন্য বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নীতিমালাগুলো দ্রুত সংস্কার করতে হবে।

গত মঙ্গলবার ডিসিসিআই অডিটরিয়ামে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি উন্নয়নবিষয়ক নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করলেও, আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছায়নি, তাই এ বিষয়ে কাজ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।’

স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, ‘দেশের সার্বিক উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত রাখতে জিডিপিতে করের অবদান বাড়াতে করজাল সমপ্রসারণ, রাজস্ব প্রক্রিয়ার পুরোপুরি অটোমেশন নিশ্চিতকরণ এবং সংশ্লিষ্ট নীতিমালার সহজীকরণ ও সংস্কার প্রয়োজন।’

পিআরআইয়ের চেয়ারম্যান ড. জায়েদী সাত্তার বলেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি আরও সমপ্রসারণ করতে বাণিজ্য ও বিনিয়োগবিষয়ক নীতিমালাগুলো দ্রুত সংস্কার প্রয়োজন। তিনি বলেন, কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো গেলে দারিদ্র্যও দূর হবে। তবে এ ক্ষেত্রে রপ্তানিমুখী শিল্পায়নের প্রতি বেশি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। এনবিআরের সদস্য জি এম আবুল কালাম কায়কোবাদ বলেন, ‘ঢাকা চেম্বার কর্তৃক প্রকাশিত ট্যাক্স গাইডটি দেশের সর্বস্তরের করদাতাদের অনলাইন কর প্রদান প্রক্রিয়াকে আরও সহজতর করবে। ইতিমধ্যে প্রায় ২০ লাখ করদাতা অনলাইন প্রক্রিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে কর প্রদান করেছে এবং ৫০ লাখ মানুষ চলতি বছরে এ ব্যবস্থায় কর প্রদান করবে বলে এনবিআর প্রত্যাশা করছে।’

আবুল কালাম কায়কোবাদ আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘অনলাইনভিত্তিক কর প্রদান ব্যবস্থা জনগণের মাঝে স্বস্তি আনয়নের পাশাপাশি হয়রানি দূর করবে, সেই সঙ্গে দেশের সামগ্রিক রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে।’

বিশ্লেষকরা বলেন, দারিদ্র্য কমানোর ক্ষেত্রে পাঁচ দশক ধরে বাংলাদেশ সাফল্য দেখালেও হঠাৎ ছন্দপতন ঘটেছে। কোভিডের পর পর আবার দারিদ্র্য বাড়তে শুরু করেছে। তিন বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। তাতে বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। আবার কয়েক বছর ধরে দেশিবিদেশি বিনিয়োগ পরিস্থিতি থমকে আছে। ফলে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ কমেছে। ফলে কাজপ্রত্যাশীরা বিপাকে পড়েছেন। এটিও দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা।

এখানে উল্লেখ্য, দারিদ্র্য বিমোচনে সাফল্যের জন্য ২০১৬ সালে বাংলাদেশে শোকেস কর্মসূচি পালন করেছিল বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম ঢাকায় এসে ‘দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্বে বাংলাদেশ’ শীর্ষক গণবক্তৃতা দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন দারিদ্র্য বিমোচনের উল্টো পথে হাঁটছে বাংলাদেশ।

সমপ্রতি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) ‘ইকোনমিক ডায়নামিকস অ্যান্ড মুড অ্যাট হাউসহোল্ড লেবেল ইন মিড ২০২৫’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে এখন দারিদ্র্যের হার ২৭ দশমিক ৯৩ বা প্রায় ২৮ শতাংশ। গত মে মাসে এই গবেষণা করা হয়। এ ছাড়া ১৮ শতাংশ মানুষ যেকোনো সময় গরিব হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মানে হলো, গত তিন বছরের মধ্যে দরিদ্র লোকের সংখ্যা বেড়েছে প্রতি ১০০ জনে ১০ জন। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রতি ৪ জনে ১ জন দরিদ্র মানুষ। অথচ ২০১৬ সালের বিবিএসের হিসাবে, দেশে দারিদ্র্য হার ছিল ২৪ শতাংশের মতো। পিপিআরসির মতো সমপ্রতি বিশ্বব্যাংক তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলেছে, ২০২৩২৪ অর্থবছরে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল সাড়ে ২০ শতাংশ। ২০২৪২৫ অর্থবছরে এসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২১ দশমিক ২ শতাংশে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, সমপ্রতি অনেক অনুসন্ধানে দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়া গিয়েছে। শিক্ষিত বেকারত্ব হার বৃদ্ধির ফলে শিক্ষার মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাসের সম্ভাবনা কমেছে। শুধু তাই নয়, বিগত কয়েকটি শ্রমশক্তি জরিপ থেকে দেখা যায়, অধিকাংশ পেশায় গত কয়েক বছরে প্রকৃত মজুরি কমে গেছে। যেসব পেশায় উচ্চশিক্ষা দরকার সেখানেও কমেছে। সুতরাং দারিদ্র্য হার বেড়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। দারিদ্র্য নির্মূলে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাত, উন্নয়ন সংস্থা ও রাষ্ট্রের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। দারিদ্র্য দূরীকরণে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মানসম্মত শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির ওপর জোর দেয়া জরুরি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে