প্রখ্যাত উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ ইয়ং–এর মতে, উন্নয়ন হলো কোনো ব্যক্তি বা সমাজের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতির একটি জটিল প্রক্রিয়া। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন–এর মতে, উন্নয়ন মানে মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন, যে মান তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা আয়ু এবং আরো অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। আয় বৃদ্ধি সে লক্ষ্যে পৌঁছানোর একটি উপায় মাত্র। তার মতে, আয় বৃদ্ধি বা উৎপাদনের ওপর মানুষের অধিকার বা এনটাইটেলমেন্টের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। অমর্ত্য সেন উন্নয়নের আবশ্যিক পাঁচটি শর্তের কথা বলেছেন : ১. সামাজিক, ২. রাজনৈতিক, ৩. বাজার ব্যবস্থা, ৪. পদ্ধতিগত সুযোগ এবং ৫. অসহায় শ্রেণীর সুরক্ষার স্বাধীনতা।
উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদরা বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে প্রয়োজন প্রতিষ্ঠান ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশ। প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাদি শক্তিশালী না হলে বিধি–বিধান ও আইন–কানুন যাই থাকুক না কেন সেগুলো যথাযথভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। তাতে ব্যবসা–বাণিজ্যে লেনদেনের খরচ অনেক বেড়ে যায়। মোট উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। এ ছাড়া উন্নয়নের প্রতিটি পর্যায়ে বা স্তরে নতুন নতুন ধ্যান–ধারণা, নতুন প্রযুক্তি, নতুন ধরনের সহায়তা ও নতুন খাতে বিনিয়োগের প্রয়োজন দেখা দেয়। সমাজ ও দেশের নেতৃত্বদানকারীদের অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন এমন এক প্রক্রিয়া যাকে সর্বদা ক্রিয়াশীল রাখতে হলে ক্রমাগতভাবে ও যথাসময়ে যথাপ্রাসঙ্গিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সেগুলোর বাস্তবায়নে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যেমন উৎপাদন বাড়াতে হলে প্রয়োজন উন্নততর স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও উন্নতমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থা। সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলোর মতোই প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের প্রক্রিয়া কোনো বিচ্ছিন্নতার মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে পারে না। সে কারণেই নানা খাতের উন্নয়ন যুগপৎ চলতে হবে এবং তা হতে হবে কার্যত সুসমন্বিত ধারায় ও শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে। প্রবৃদ্ধির নকশা ও আদর্শ (মডেল) কী হবে তাও সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও সম্পদের সাথে তাল মিলিয়ে নেতৃত্বকে অবশ্যই বাস্তবায়নযোগ্য মডেল নির্ধারণ করে সেই মডেলের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে হবে। এর কারণ, উন্নয়নের নীতি–কৌশল ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে ইতিবাচক ফলাফল অর্জনে যথেষ্ট সময় প্রয়োজন। এ প্রক্রিয়া ধরে রাখতে হলে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান গড়া আবশ্যক। অন্য দিকে আবার দেশের রাজনীতি ও সমাজকে স্থিতিশীল রাখতে এবং প্রবৃদ্ধির হারে গতিশীলতা বাড়াতে প্রয়োজন হলো রাজনীতি ও অর্থনীতির মধ্যে একটা সমন্বিত রফা।
অর্থনীতিবিদদের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ হলো, কোভিড–১৯ মহামারীর ফলে সমগ্র বিশ্বের সব দেশের স্বাস্থ্য, আর্থ–সামাজিক, রাজনৈতিক সব ক্ষেত্রেই নতুন করে অনেক চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। সেই সঙ্গে পুরনো চ্যালেঞ্জগুলো আরও কঠিন হয়েছে। গতানুগতিক ধারায় সবকিছু আবারও স্বাভাবিক হবে এবং দেশ এগিয়ে যাবে। কিন্তু দারিদ্র্য, কর্মসংস্থান এবং অন্য সমস্যাগুলো যেগুলো কোভিড–১৯–উত্তর আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। দিন দিন ব্যক্তিগত আয় ও সম্পদের বৈষম্য বাড়ছে, কর্মসংস্থানের স্বল্পতাহেতু বেকার জনসংখ্য (বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে) বাড়ছে, মূল্যস্ফীতি বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্য এবং অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রীর (যাতায়াত, বাড়িভাড়া, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি) ব্যয়ভার বাড়ছে, যার ফলে দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, এমনকি মধ্যবিত্তদেরও আঘাত করছে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেশ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এগুলোর মধ্যে রয়েছে : ১. অবকাঠামোগত দুর্বলতা : ২. ঋণখেলাপিদের দৌরাত্ম্য : ৩. বৈদেশিক সাহায্য ও উন্নয়ন : ৪. বিদেশী পণ্যের আধিপত্য : ৫. কম সঞ্চয় : ৬. আমদানি নির্ভরতা : ৭. প্রশাসনিক জটিলতা : ৮. প্রতিকূল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি : ৯. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা : ১০.দুর্নীতি। এসব সমস্যা দূরীকরণে গুরুত্বারোপ করেছেন তাঁরা। ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আরো কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলেছেন তাঁর এক লেখায়। সেগুলো হলো : সরকারি অর্থায়নে গ্রহণকৃত বিভিন্ন প্রকল্প, বিভিন্ন প্রশাসনিক কার্যক্রমে দুর্নীতি অপচয় বন্ধ করা। প্রশাসনকে আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক করা। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারের রাজস্ব আদায় ও কর ব্যবস্থাকে আরও দক্ষ, কর্মতৎপর, ব্যবস্থা ও জনগণবান্ধব হিসেবে পরিণত করতে হবে। একই সঙ্গে এসব ক্ষেত্রে সব প্রক্রিয়া ও কার্যক্রম হতে হবে সুষম উন্নয়ন ও বৈষম্য হ্রাসের মাধ্যম হিসেবে। চতুর্থত, সরকারি প্রশাসন ও উন্নয়ন কার্যক্রম বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। তবে অনেকের মতো আমরাও মনে করি, সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের তুলনায় সন্তোষজনক অবস্থায় আছে, বিশেষ করে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায়। এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে যে কোনো উপায়ে।