ডিভোর্স! সহজ বাংলা ভাষায় যার নাম বিবাহ বিচ্ছেদ কিংবা আরবীতে তালাক। পাশ্চাত্য সমাজের মত ইদানীং প্রাচ্যেও যার রেশ লেগেছে মারাত্মক আকারে, বাংলাদেশও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। আমাদের শ্যামল দেশে পারিবারিক বন্ধনকে বরাবরই গুরুত্ব দিয়ে দেখা হতো, মান্য করা হতো। কথায় আছে ,‘যে সহে, সে রহে।’ এখন কি আর সে যুগ আছে? ডিজিটাল যুগ, স্মার্ট যুগে এসব কেউ আর মানে না। এখন যুগ হচ্ছে –থাকলে থাকো, না থাকলে নেই এরকম, নারী–পুরুষ উভয়ের মন–মানসিকতা এমন। আসলে অস্থির এই যুগে অভিভাবকদের অত্যন্ত যত্নশীল হওয়া উচিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদানের পাশাপাশি সন্তানদের পারিবারিক মূল্যবোধ শিখানো, প্রতিটি সম্পর্কের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য।
ঠুনকো কারণে সম্পর্কের প্রতি বীতশ্রদ্ধ না হয়ে ধৈর্য্য প্রদর্শনের মাধ্যমে তা সমাধানের পথ বের করার জন্য অভিভাবকরা যেন উস্কানিমূলক বক্তব্য না দিয়ে আশার আলো দেখান, সন্তানদের হতাশার পথ থেকে সরিয়ে আনার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালান। তবে এর ব্যতিক্রম ও যে নেই তা কিন্তু নয়। ধৈর্য্য ধারণ করে সংসার টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার মত কঠিন কিন্তু ভালোবাসায় বিশ্বাসী দম্পতি এখনো আছে, যারা শেষ পর্যন্ত হাল ছাড়ে না, সংসারটি যদি টিকে যায়, আর যদি সন্তান থাকে তাহলে সন্তানদের ভবিষ্যত ভেবেও সমঝোতায় আসার চেষ্টা করে। কিন্তু সমাজে এমন সংখ্যা অনেক কম।
দাম্পত্য জীবনে স্বামী স্ত্রী একের প্রতি অপরের শ্রদ্ধাবোধ, পারস্পরিক সহমর্মিতাবোধ প্রমাণ করে তাদের দাম্পত্যের ভালোবাসার গভীরতা। আজকাল কথায় কথায় সংসার ভাঙছে ঠুনকো সব কারণে, ধৈর্য্য ধরে খানিক অপেক্ষার সময় কারো নেই যেন। যুক্তি সঙ্গত কারণ ছাড়া অকারণ বিচ্ছেদ সত্যিই বেদনাদায়ক।
মতের অমিল, ইগো প্রবলেমে যদি আলাদাই হবেন তাহলে সেসব দম্পতির কোনো অধিকারই নেই সন্তান জন্মদানের!
তাদের কোনো অধিকার নেই ‘ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তান’ সাইনবোর্ডটি একজন সন্তানের গায়ে ঠুকে দেওয়ার সারা জীবনের জন্য। বাবা–মা হতে হলে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, ভাবতে হয় সন্তানকে নিয়ে, নিজেদের নিয়ে আর নয়।
শখের বশে পুতুল খেলার মতো বিয়ে করে সন্তান জন্ম দেন, আবার ইচ্ছে করলো না, মিললো না মত, তথাকথিত সেপারেশন আর ডিভোর্স এর শরণাপন্ন হলেন –উচ্চ শিক্ষা আপনাদের এই শিখিয়েছে? তাহলে যুগল জীবন নিয়ে পাঁচ বছর এক্সপেরিমেন্ট করে তারপর সন্তান নিতেন!
কেন সন্তানকে তার সমস্ত প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করবেন? বাবা–মা এর স্নেহ–মমতা– ভালোবাসা প্রতিটি সন্তানের প্রাপ্য, বাবা–মা এর সম্পদে সন্তানের হক–কেন স্নেহের পুতুলটাকে জীবনের জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরিতে ধাক্কা দিয়ে তাকে জ্বলতে দিয়ে সরে যান আপনারা? কেন পনেরো বছর বয়সের সন্তানের লাশ সামনে নিয়ে ডিভোর্সী বাবা–মা শোকে পাথর হয়ে বসে থাকেন–তাদের সন্তান তো দাদা বাড়ি আর নানা বাড়ি করেই ছোট জীবন কাটিয়ে দিলো, অনুশোচনা কি তখন একটুও তাদের স্পর্শ করে না? আরো একটু নিজেদের সংশোধন করার সময় কি দেওয়া যেত না নিজেদের? কেন চার বছরের ছোট শিশুকে বাবার নাম জিজ্ঞেস করলে সে তার নানার নাম বলে, বাবাকে চেনে না, বাবা কি তা সে বোঝে না! তার দুই বছর বয়সেই বাবা–মায়ের মনোমালিন্যের কারণে তাদের সংসার টেকেনি, সেই থেকে মা মেয়েকে নিয়ে তার বাবার বাড়িতে আছে, এখনো বিয়ে করেনি আর। কেন পাঁচ বছরের সন্তানকে দেখার জন্য একজন বাবা বুক ভরা অস্থিরতা আর লুকোনো চাপা কান্না নিয়ে অপেক্ষা করেন কখন তার ছেলেকে একপলক দেখতে পাবেন, বুকে জড়িয়ে ধরবেন !
তার মা যে মিথ্যে ইগোর বশবর্তী হয়ে তথাকথিত সেপারেশনে গিয়ে ডিভোর্সের প্রস্তুতি নিচ্ছেন নতুন জীবনের হাতছানিতে! বাবা এখনো প্রতীক্ষায় কখন তার সন্তানের মায়ের মারাত্মক এই ভুল ভাঙবে!
আদৌ কি আর এই ভুল ভাঙে? একবার আদালতপাড়ায় গেলে আর কি সমঝোতায় আসা যায় ? তখন তো সমাজ–সংসার–মান– সম্মান–জেদ সন্তানের চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ায়। বিচ্ছেদই যখন শেষ গন্তব্য হয়ে যায়, তখন পারলে সাথে থেকে যান সন্তানকে সঙ্গ দিয়ে, জীবনে বিয়ে কতবার করতে হয় একজন মানুষকে? অন্তত সন্তানের জীবন গড়া পর্যন্ত সাথে থাকুন।
নারী পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই এরকম হয়ে থাকে। মাধবীলতার মতো সন্তান আপনাকে জড়িয়ে বাঁচবে, বাবা–মা দুজনকেই বলছি আপনিও মায়ার আকর হয়ে থাকবেন সন্তানের জীবনে।সমাজকে উপেক্ষা করুন, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী বদলে দিন, সে সন্তানের কথা ভাবুন দয়া করে, বেলাশেষে ও যে সন্তান ভুলতে পারে না তার বাবা–মায়ের দেওয়া সেই উপাধি–ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তান, ১ম ঘরের সন্তান! এ এক নীরব কষ্ট। আপনারা আপনাদের জীবন আর নতুন সঙ্গী নিয়ে সরে যান নতুন যাপিত জীবনে সুখী হওয়ার অভিনয় করে, আসলেই কি সুখী হন? একবারও গভীরভাবে চিন্তা করে দেখেছেন, তারপর কী যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে ঐ সন্তান পুরো জীবনকে জড়িয়ে নেয় বেঁচে থাকায়, দাম্পত্য বিচ্ছেদের বলিদান হয়ে? কেন শেষ জীবনে সন্তানের কাছে অপরাধবোধ থেকে ক্ষমা চাইবেন কেঁদে কেঁদে আর তাকেও কাঁদাবেন যন্ত্রণায় রক্তাক্ত করে? সময় তো পেয়েছিলেন অনেক, অথচ তখন ভাবেননি রক্তগরমের জোয়ারে! আর যখন শেষ মুহূর্তে অঙিজেন এর প্রয়োজন, বিবেকের দংশনে ভুলে যাওয়া রক্তের স্মৃতি মনে পড়ে, তাকে খুঁজে ক্ষমা চাওয়াতেই কি সব ঠিক হয়ে যায়? সর্ব শক্তিমান একজন আছেন, তিনিই সাক্ষী সব কিছুর, ফিরে যে যেতেই হবে তাঁর কাছে আমাদের সবার। নিজেকে পরিবর্তন আসলেই করা যায়, আমরা চাইলেই পারি নিজের ভুল–ত্রুটিগুলো সংশোধন করতে। কিন্তু আমরা করি না তা, জেদের কিংবা ইগোর বশবর্তী হয়ে -‘আমিই বা কম কীসে’ এই মনোভঙ্গি নিয়ে। তাই যৌবনের জোয়ারে ইচ্ছায়–অনিচ্ছায় কবুল বলার আগে ভাবুন দুজনেই শতবার, সন্তান জন্মদানের আগে ভাবুন সহস্রবার, মুখে তালাক বলার আগে জিভকে সংযত করুন, তালাকনামায় স্বাক্ষর করার আগে ভাবুন লক্ষবার, সন্তানকে বঞ্চিত করার আগে ভাবুন কোটিবার, বিবেকের দংশনে।
আমাদের সমাজ–সংসার বিচ্ছেদের এই আগ্রাসী দংশন কাটিয়ে উঠুক, বোধোদয় হোক প্রতিটি যুগলের, শুভ্রতায়–স্বচ্ছতায় সুন্দর হয়ে উঠুক সবার জীবন, বুক জুড়ে থাকুক সবার ভালোবাসা।
লেখক: কবি, শিক্ষক।