দাবানলে হাজার হাজার বাড়িঘর গ্রাস

লস অ্যাঞ্জেলসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১০ ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াল ৫ হাজার কোটি ডলার, লুটপাট পুড়ছে হলিউড, বাড়িহারা বহু তারকা

আজাদী ডেস্ক | শনিবার , ১১ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৪:৪৪ পূর্বাহ্ণ

যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে ছড়ানো দাবানল তৃতীয় দিনেও নিয়ন্ত্রণহীন। দাবানলে প্রায় ১০ হাজার বাড়িঘর ও অন্যান্য স্থাপনা পুড়ে ছাই হয়েছে। দাবানলে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১০। তবে আপাতত স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, হারিকেনের মতো বাতাসের গতি কিছুটা কমেছে। এতে দমকলকর্মীরা কিছুটা নির্ঝঞ্ঝাটভাবে কাজ করতে পারছেন বলে জানিয়েছে রয়টার্স। দাবানাল প্যাসিফিক পলিসেডস অঞ্চলের পলিসেডস ফায়ার সান্তা মোনিকা ও মালিবুর মধ্যবর্তী পাহাড়গুলোর ১৫ হাজার ৮৩২ একর এলাকার ১০০০ স্থাপনা গ্রাস করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরটিতে কেন দাবানল এমন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, সেই প্রশ্নটি এখন সামনে আসছে। দেশটির কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘ সময় বৃষ্টি না হওয়ায় খরা আর প্রবল বাতাসের কারণে আগুন দ্রুত ছড়াচ্ছে। দাবানল এমন ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনকেও কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। যদিও ঠিক কোন কোন বিষয়গুলো এর জন্য দায়ী, সেটি এখন স্পষ্ট নয়। দাবানলের কারণে ঘরবাড়ি ছেড়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার মানুষ। খবর বিডিনিউজের।

এই দাবানল মঙ্গলবার টোপাঙ্গা ক্যানিয়ন থেকে এগিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের তীর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ইতোমধ্যে তা লস অ্যাঞ্জেলেসের ইতিহাসে অন্যতম ধ্বংসাত্মক দাবানল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর আগে অন্তত তিনটি ভিন্ন সূত্র আগুনে মোট ৭ জনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছে। যদিও লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টি শেরিফ রবার্ট লুনা সংখ্যাটি নিশ্চিত করেননি। তিনি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, তদন্তকারী দলগুলো যতক্ষণ পর্যন্ত ঘরে ঘরে তল্লাশি চালানোর সুযোগ না পাচ্ছে ততক্ষণ মৃত্যুর সঠিক সংখ্যা নিশ্চিত করা সম্ভব না। তবে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ দেখে তিনি ধারণা করছেন মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়বে। তিনি বলেন, চারপাশ দেখে মনে হচ্ছে এসব এলাকায় পরমাণু বোমা ফেলা হয়েছে। মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে পারে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি প্রার্থনা করি এই সংখ্যাটা আর যেন না বাড়ে।

পূর্ব দিকে সান গ্যাব্রিয়েল পর্বতমালার পাদদেশে ইটনে আরও ১০ হাজার ৬০০ একর, হাজার খানেক স্থাপনা পুড়ে গেছে। বেসরকারি আবহাওয়া পূর্বাভাসকারী অ্যাকুওয়েদারের প্রাথমিক হিসাবে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে আর্থিক মূল্যে তা পাঁচ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ডেমোক্র্যাট মেয়র কারেন বাস বলেন, আমরা লস অ্যাঞ্জেলেস দ্রুত এবং কার্যকরভাবে পুনর্নির্মাণের দিকে মনোনিবেশ করছি। খবর বিডিনিউজের।

এদিকে বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ফেডারেল সরকার আগামী ১৮০ দিনের জন্য ধ্বংসাবশেষ অপসারণ, অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র এবং প্রাথমিক উদ্ধারকারীদের পারিশ্রমিকসহ পুনরুদ্ধার ব্যয়ের শতভাগ বহন করবে। হোয়াইট হাউসে জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠকের পর বাইডেন বলেন, আমি গভর্নর ও স্থানীয় কর্মকর্তাদের বলেছি, দাবানল নিয়ন্ত্রণে যেখানে যা খরচ করা দরকার সবটাই যেন সরকারের বরাদ্দ থেকে করা হয়।

রয়টার্সের তথ্য মতে, সব মিলিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টিতে পাঁচটি দাবানল জ্বলছে। বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষী বিলাল তুখি ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে পাহারা দেওয়ার সময় বলেন, এই দৃশ্য তাকে তার আদি নিবাস, যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে সুপারিনটেনডেন্ট আলবার্তো কারভালহো জানান, ধোঁয়া, ছাই ও কণার কারণে বাতাস দূষিত হয়ে পড়ায় গতকাল দ্বিতীয় দিনের মতো স্কুল বন্ধ রাখা হয়েছে। ইটন ফায়ারের ভয়াবহতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। তবে রাতারাতি বাতাস আবার তীব্র হওয়ার পূর্বাভাস দিয়ে কর্মকর্তারা সতর্ক করে দিয়েছেন।

অবজারভেটরি এক বিবৃতিতে বলেছে, আমরা আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, অবজারভেটরির কাছে ইটন ফায়ারের আগুন আপাতত নিয়ন্ত্রণে আছে বলে মনে হচ্ছে। সবচেয়ে বড় দাবানলটি জ্বলছে প্যালিসেডস অঞ্চলে। দ্বিতীয় বৃহত্তম দাবানলটি জ্বলছে ইটন অঞ্চলে। সানসেট, হার্স্ট ও লিডিয়া এলাকাতেও এখনো আগুন জ্বলছে। প্যালিসেডস এবং ইটন ফায়ার নামে দুটি বৃহত্তম দাবানল শহরের চারপাশে এত বিশাল কুণ্ডলী তৈরি করেছিল যে এটি মহাকাশ থেকেও দৃশ্যমান ছিল।

প্যাসিফিক প্যালিসেডস একটি অভিজাত এলাকা। এই এলাকায় তারকাদের বাস। দুদিন আগের প্রাসাদোপম বাড়িগুলো এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বাতাসে শুধু পোড়া গন্ধ। কালো ধোঁয়ায় ভারী হয়ে আছে পরিবেশ। মুখে মাস্ক পরা বাসিন্দারা তাদের ধ্বংস হওয়া বাড়িগুলো এক ঝলক দেখার আশায় এসেছিলেন।

এদিকে, বিশ্বজুড়ে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের বিনামূল্যে খাবার সরবরাহের জন্য পরিচিত স্প্যানিয়ার্ড শেফ হোসে আন্দ্রেস প্যাসিফিক কোস্ট হাইওয়েতে প্যালিসেডস ফায়ারের কাছে একটি ফুড কার্ট বসিয়েছেন। তিনি বলেন, ধনী হোক বা গরিব, এই মুহূর্তে সবারই একটু সমর্থন ও ভালোবাসা প্রয়োজন।

হলিউড অভিনেতা জেমি লি কার্টিস বৃহস্পতিবার বলেছেন, তার পরিবার ত্রাণে ১০ লাখ ডলার দেবে। রয়টার্স জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কর্মী ও ম্যাটেরিয়াল ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধ ডজন রাজ্য ও কানাডার দমকল কর্মীদের ক্যালিফোর্নিয়ায় পাঠানো হয়েছে।

পুড়ছে হলিউড, বাড়িহারা বহু তারকা : ছড়িয়ে পড়া দাবানলের আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে হলিউডের অনেক তারকার বাড়ি। বহু অভিনেতাঅভিনেত্রী এবং সংগীতশিল্পীকে প্রাণে বাঁচতে এক কাপড়ে বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। স্থগিত হয়েছে চলতি বছরের অস্কার মনোনয়ন ঘোষণা ছাড়া আরো কিছু পুরস্কার অনুষ্ঠানও। এছাড়া চলতি সপ্তাহের প্রায় সব সিনেমার প্রিমিয়ারও বাতিল করা হয়েছে।

বিবিসি বলছে, শুক্রবার অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডসের মনোনয়ন ঘোষণার তারিখ থাকলে সেটি পিছিয়ে গেছে; এই অনুষ্ঠানের পরবর্তী দিন নির্ধারণ করা হয়েছে রোববার। দাবানলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে আল্টাডিনা, সিলমার এবং প্যাসিফিক প্যালিসেডস। আর এই এলাগুলোতেই বসবাস করেন হলিউডের বহু তারকা। আগুন ছড়িয়েছে হলিউড হিলসের পশ্চিমদিকেও।

অভিনেত্রী জেমি লি কার্টিস, প্যারিস হিলটন, ম্যান্ডি মুর, অ্যাড্রিয়েন ব্রডি এবং অস্কারের প্রাক্তন সঞ্চালক বিলি ক্রিস্টাল আগুনে তাদের বাড়ি হারিয়েছেন। দাবানলের ঝুঁকি এড়াতে প্যাসিফিক প্যালিসেডসের বাড়ি ছেড়ে সাবেক স্ত্রী অভিনেত্রী জেনিফার গার্নারের বাসায় উঠেছেন হলিউড তারকা বেন অ্যাফ্লেক। তবে দাবানলে বেনের বাড়িটি অক্ষত আছেন। গার্নারের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার পর নিজের বাড়িটি এই তারকা একবার দেখেও এসেছেন। বাড়িটি বেন ছয় মাস আগে কিনেছেন ২ কোটি ডলার খরচ করে। এর মধ্যে খবর এসেছে আদালতের রায়ে অভিনেত্রী জেনিফার লোপেজের সঙ্গে বেনের বিচ্ছেদ চূড়ান্ত হয়েছে।

গোল্ডেন গ্লোব, এমি ও সেগ পুরস্কারজয়ী ৭৩ বছর বয়সী হলিউড তারকা জিন স্মার্ট ইনস্টাগ্রামে এক পোস্টে বলেন, হলিউডে এ সময় অনেকগুলো পুরস্কার অনুষ্ঠান হয়। তবে আগুনের এই বিবেচনায় নিয়ে টেলিভিশন নেটওয়ার্কগুলোর প্রতি আমার একটি আবেদন আছেন । সেটি হলো তারা যেন দাবানলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ও ফায়ার ফাইটারদের সহযোগিতায় পাশে দাঁড়ান।

অস্কার, এমি ও গোল্ডেন গ্লোবজয়ী অভিনেত্রী জেমি লি কার্টিস ইনস্টাগ্রামে আগুনের ছবি পোস্ট করেছেন। অভিনেত্রী জানিয়েছেন তার পরিবার নিরাপদে থাকলেও, বাড়িটি রক্ষা করা যায়নি। ইনস্টাগ্রামের পোস্টে কার্টিস উদ্ধারকারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।

চলছে লুটপাট : বাংলানিউজ জানায়, ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ দাবানলে পুড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের লস অ্যাঞ্জেলেস শহর। বিনোদন জগতের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত শহরটির চারপাশে একাধিক দাবানল এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে। দাবানলে বিপর্যস্ত শহরে লুটপাটের খবরও পাওয়া যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত লুটপাটে জড়িত ২০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত মঙ্গলবার লস অ্যাঞ্জেলেসে এ দাবানলের সূত্রপাত হয়। প্রচণ্ড গতিতে বয়ে চলা ঝড়ে দাবানল চারদিকে হুহু করে ছড়িয়ে পড়ে।

এদিকে শহরটিতে লুটপাটে ব্যস্ত দুর্বৃত্তরা। স্থানীয় বোর্ড অব সুপারভাইজারদের প্রধান ক্যাথরিন বার্জার বলেছেন, আগুন থেকে বাঁচতে অনেকেই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। দুর্বৃত্তরা পরিত্যক্ত ওই বাড়িগুলোয় লুটপাট চালাচ্ছে। লুটপাটে জড়িত ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনা হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন তিনি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধটেকনাফে জালে ধরা পড়ল ২০০ কেজির পাখি মাছ
পরবর্তী নিবন্ধদাবানল এত ভয়ঙ্কর হলো কীভাবে