দশ মাসে ১০ বারের বেশি ভূমিকম্প

অর্ধেকেরও বেশি চট্টগ্রামসহ আশেপাশের জেলায় ।। এই অঞ্চল কি বড় ঝুঁকিতে ।। ক্ষতি এড়াতে প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ২৫ অক্টোবর, ২০২০ at ৫:৩৩ পূর্বাহ্ণ

১৩ দিনের ব্যবধানে ভূমিকম্পে আবারো কেঁেপ উঠল চট্টগ্রাম। সর্বশেষ গতকাল শনিবার সকাল ৯টা ২১ মিনিটে অনুভূত হয় এই ভূমিকম্প। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপের (ইউএসজিএস) তথ্য বলছে, ৪ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্পটির উৎপত্তি ছিল খাগড়াছড়ি জেলায়। এর আগে গত ১১ অক্টোবরও ভূমিকম্প হয়েছিল চট্টগ্রামে। বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর, আমেরিকার ইউএসজিএস এবং ভারতের ন্যাশনাল সেন্টার ফর সিসমোলজির (এনসিএস) তথ্য পর্যালোচনায় জানা গেছে, গত ১০ মাসে বাংলাদেশে ১০ বারের বেশি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি মাসে কমপক্ষে একবার করে ভূমিকম্প হয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ভূমিকম্প চট্টগ্রামসহ আশেপাশের জেলাগুলোতেও অনুভূত হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘন ঘন এসব ভূমিকম্প বড় ধরনের ভূমিকম্পের পূর্বাভাস। বাংলাদেশ অনুভূত ভূমিকম্পগুলোর বেশিরভাগের উৎপত্তিস্থল ভারত-মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায়। বিভিন্ন সময়ে ভূমিকম্প বিষয়ক গবেষকরা সতর্ক করে বলেছেন, এই দুই সীমান্ত এলাকা থেকে রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৫ থেকে সাড়ে আট মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। যদি বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত অঞ্চল থেকে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়, সেক্ষেত্রে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার বেশি ঝুঁকিতে থাকবে। ঢাকার চেয়েও ক্ষয়ক্ষতি বেশি হতে পারে চট্টগ্রামে। তাই সম্ভাব্য ক্ষতি এড়াতে এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এক্ষেত্রে নতুন ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড অনুসরণ এবং পুরনো ভবনগুলোর শক্তি বৃদ্ধির ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত অঞ্চল থেকেই উৎপত্তি বেশি : বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সেখানে ২০০৮ সালের নভেম্বর থেকে ২০২০ সালের ২২ জুন পর্যন্ত ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, চীন, নেপালসহ আশেপাশের দেশগুলোতে হওয়া দেড় হাজার ভূমিকম্পের তথ্য সংরক্ষিত আছে। এসব তথ্য থেকে জানা গেছে, ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত অঞ্চল থেকে ৪১টি এবং বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে উৎপত্তি হয়েছে ১০টি ভূমিকম্প। এছাড়া বাংলাদেশে উৎপত্তি হয় ১৭টি। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ২৭ জুন ৪ দশমিক ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলা থেকে ২৪ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে।
এদিকে চলতি বছর অনুভূত ভূমিকম্পগুলোর মধ্যে গত ১১ অক্টোবর ১১টা ৩৮ মিনিটে রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৪ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয় চট্টগ্রাম ও ঢাকায়। ১৫ সেকেন্ড স্থায়ী এ ভূমিকম্পের উৎপত্তি বাংলাদেশ থেকে ৪০৫ কিলোমিটার দূরে ভারতের মনিপুর রাজ্যের মইরাং নামক স্থানে।
গত ২৭ আগস্ট বিকেল ৬টা ৭ মিনিটে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি ও বান্দরবানে মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ভারতের মিজোরাম রাজ্যের উত্তর ভানলাইপাইয়ে উৎপত্তি হওয়া এ ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৪। এছাড়া ২১ ও ২২ জুন ১২ ঘণ্টার ব্যবধানে দুইবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ২২ জুন ভোর ৪টা ৪০ মিনিট ৫২ সেকেন্ডে অনুভূত ভূমিকম্পের রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৮। এর উৎপত্তি ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায়। একই এলাকায় ২১ জুন বিকেল ৪টা ৪৬ মিনিটে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পের রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ১। এ দুটি ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি চট্টগ্রাম থেকেও অনুভূত হয়েছে।
এছাড়া ১৭ অক্টোবর সিলেটে ৫ দশমিক ৪ মাত্রার, ২৫ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলে ৩ দশমিক ৭ মাত্রার, ১৩ মার্চ সিলেটের গোয়াইনঘাটে ৩ দশমিক ৬, ২৯ মে টাঙ্গাইলে ৪ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল।
বিশেষজ্ঞের বক্তব্য : ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চট্টগ্রামের (ইউএসটিসি) উপাচার্য ড. জাহাঙ্গীর আলম আজাদীকে বলেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে ছোট ছোট যেসব ভূমিকম্প হচ্ছে তার উৎপত্তিস্থল মিয়ানমার-বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকায়। এখান থেকে ৭ দশমিক ৫ থেকে ৮ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার পূর্বাভাস আগেই দেওয়া আছে। এখন ঘন ঘন ভূমিকম্প হওয়া মানে বড় ধরনের ভূমিকস্প হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে এ ভূমিকমপ বিশেষজ্ঞ বলেন, যেহেতু বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা আছে, তাই আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। ভবন, ব্রিজ-কালভার্ট, হাসপাতালসহ যেকোনো স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা থাকতে হবে। এগুলো ভূমিকম্পরোধক করে নির্র্মাণ করতে হবে। এজন্য ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড মানতে হবে। এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, বড় বড় শিল্পকারখানাগুলো যদি ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা দেশের অর্থনীতিকেই ধ্বংস করবে। তাই শিল্পকারখানার ডিজাইনের সময় অবশ্যই প্ল্যান অনুযায়ী করতে হবে। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণের সময়ও সুচারুভাবে প্ল্যানমাফিক করতে হবে।
বিদ্যমান স্থাপনার ক্ষেত্রে কী করা উচিত জানতে চাইলে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এ উপাচার্য বলেন, ইতোপূর্বে যেসব স্থাপনা গড়ে উঠেছে সেগুলোর শক্তি বাড়াতে হবে। অ্যাসেসমেন্ট করে ভূমিকম্প সহনীয় করতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ ধরনের শক্তি বৃদ্ধি করা হয়। সেক্ষেত্রে সরকার চাইলে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে পারে।
যে কারণে ঝুঁকিতে চট্টগ্রাম : বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় ১৭৬২ সালে ৮ দশমিক ৮ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল। সাধারণত একশ বছর পর একই এলাকায় আবারও বড় আকারের ভূমিকম্প হয়। তবে গত ১৫৮ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্ব পাশ দিয়ে যাওয়া ফল্টলাইন ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় বড় ধরনের কোনো ভূমিকম্প হয়নি। ফলে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় যেকোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে বলে ভূমিকম্প বিষয়ক বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এক্ষেত্রে উৎপত্তিস্থলের অবস্থানগত দূরত্ব বিবেচনায় ঝুঁকিতে আছে চট্টগ্রাম।
১৯৭৯ সালে জিওলজিক্যাল সার্ভে অব বাংলাদেশ সিসমিক জোনিং ম্যাপেও চট্টগ্রামকে সবচেয়ে বিপদসংকুল অঞ্চল ঘোষণা করা হয়। দেশের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির (সিডিএমপি) বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামালও ২০১৫ সালে তাঁর গবেষণায় চট্টগ্রামের ঝুঁকির বিষয়টি তুলে ধরেন।
কয়েক বছর আগে করা চুয়েট ভূমিকম্প গবেষণা কেন্দ্রের সার্ভে রিপোর্ট সূত্রে জানা গেছে, ভূ-স্তরের ইউরেশিয়ান ও ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান প্লেটের ভূ-অবস্থানগত ভূমিকম্প জোনের মধ্যেই রয়েছে চট্টগ্রাম। প্লেট দুটি অতি মাত্রায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ফলে ঘন ঘন ভূমিকম্প দেখা দিচ্ছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৭ সালের ২১ নভেম্বর ভূমিকম্পে নগরের হামজারবাগে পাঁচতলা বিশিষ্ট সওদাগর ভিলা ধসে পড়ে ২৩ জন নিহত হন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঈদের পর সবচেয়ে কম রোগী শনাক্ত
পরবর্তী নিবন্ধসেন্টমার্টিনে আটকে পড়া ৪শ পর্যটক ফিরছে আজ