কক্সবাজারে জেলা প্রশাসন আয়োজিত ডিসি গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট ২০২৫–এর ফাইনাল ম্যাচে ভয়াবহ তাণ্ডব চালিয়েছে দর্শকরা। তাদের দফায় দফায় ব্যাপক হামলায় ফাইনাল খেলা লণ্ডভণ্ড হয়ে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় কক্সবাজার বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন স্টেডিয়াম। হামলায় কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিলুফা ইয়াসমিন এবং পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন। স্টেডিয়ামের মূল ভবনে ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়েছে হামলাকারীরা। এছাড়া গ্যালারির ব্যাপক ক্ষতি করেছে। এসময় অগ্নিসংযোগও করা হয়। গতকাল শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দফায় দফায় এই ঘটনা ঘটে। আহতদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর।
প্রত্যক্ষদর্শী ও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কক্সবাজার ডিসি গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে ফাইনালে উত্তীর্ণ হয় টেকনাফ উপজেলা ও রামু উপজেলা। দুই শক্তিশালী দলের ফাইনাল খেলার দেখতে কয়েকদিন ধরে জেলার ফুটবল প্রেমীদের মধ্যে উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়ে। তারই আলোকে বৃহস্পতিবারই বিভিন্ন উপজেলা থেকে দর্শকরা কক্সবাজারে শহরে অবস্থান নেয় এবং ওইদিন রাত থেকে খেলার টিকিট বিক্রি শুরু হয়। শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে স্টেডিয়ামে ঢুকতে শুরু করে দর্শকরা। এতে দুপুরের মধ্যে ১০ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার সব গ্যালারি পূর্ণ হয়ে উঠে। কিন্তু আরো বেশি দর্শক ঢুকতে চাইলেও স্থান সংকুলান না হওয়ায় গেট বন্ধ করে দেয় প্রশাসন। টিকেট করেও ঢুকতে না পারায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে দর্শকরা। এক পর্যায়ে তারা গেট ভেঙে মাঠে ঢুকে। এতে নিরাপত্তা শঙ্কা তৈরি হয় এবং পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। পরে সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ ও আনসারের বিপুল সদস্য মোতায়েন করা হয়। তারা নিরাপত্তা শঙ্কা থাকায় মাঠে ঢুকে পড়া দর্শকদের বের করে দিতে দফায় দফায় চেষ্টা চালায়। এক পর্যায়ে জোর করে তাদেরকে বের করে দেয়া হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে বাইরে বের হয়ে স্টেডিয়ামের মূল ভবন লক্ষ্য ব্যাপকহারে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে দর্শকরা। ইট–পাটকেলের আঘাতে ভবনের সব গ্লাস ভেঙে চুর্ণবিচুর্ণ হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে ব্যাপক লাঠিচার্জ করে আইনশৃক্সখলা বাহিনী। তারা সরে গেলে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়। তবে ততক্ষণে সময় কমে যাওয়ায় খেলতে অনাগ্রহ প্রকাশ করে দুই দলের খেলোয়াড়রা। কমিটি বহু চেষ্টা করেও খেলা আয়োজন করতে পারেনি। এতে তখন গ্যালারিতে থাকা দর্শকরা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। খেলা না হওয়ার পরিস্থিতি বুঝতে পেরে তারা এক পর্যায়ে গ্যালারির লোহার ঘেরা ভেঙে মাঠে ঢুকে পড়ে এবং কমিটির লোকজন, পুলিশ, র্যাব ও আনসার সদস্যদের ওপর হামলে পড়ে। এতে পিছু হটে তারা। তারপরও ক্ষুব্ধ হাজার হাজার দর্শক একযোগে স্টেডিয়াম ভবন ও গ্যালারিতে ব্যাপক হামলা শুরু করে। তারা ভবনে ঢুকে পড়ে লাঠি ও ইট–পাটকেল দিয়ে প্রতিটি কক্ষে ব্যাপক ভাঙচুর করে। ওই সময় দুই দলের খেলোয়াড়রা ড্রেসিংরুমে আটকা পড়েন। অন্যদিকে বাইরে বের হয়ে শত শত লোকজন বাইর থেকে ব্যাপকহারে ইটপাকেল ছুঁড়ে। এতে ভবনে গ্লাস দিয়ে তৈরি সব দেয়াল ভেঙে চুর্ণবিচূর্ণ হয়। এসময় র্যাব ও পুলিশ ধাওয়া দিলে তারা পিছু হটে। এর মধ্যে মাঠে থাকা ব্যানারগুলো খুলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এতে ভবনে আটকা পড়া খেলোয়াড় ও লোকজন আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার করতে থাকেন। তবে আগুন ছড়িয়ে পড়েনি। এর মধ্যে থেমে থেমে ধাওয়া দিলে হামলাকারীরা চলে যায়।

পুলিশ ও জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, প্রথম ধাপের হামলায় গ্লাসের ভাঙা অংশ ছিটকে পড়ে হাত কেটে যায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিলুফা ইয়াছমিনের। একই সাথে ইট–পাটকেলের আঘাতে আহত হন দুই পুলিশ সদস্য। দর্শকসহ সব মিলে প্রথম ধাপে অন্তত ২০ জন আহত হয়। দ্বিতীয় ধাপের হামলায় ইট–পাটকেলের আঘাত এবং গ্লাসের ভাঙা অংশ ছিটকে পড়ে পুলিশ সদস্য এবং সংবাদিকসহ অন্তত ৩০জন আহত হয়। আহতদের কয়েকজনের অবস্থা বেশ গুরুতর হয়েছে। তাদেরকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
দর্শকরা অভিযোগ করেছেন, স্টেডিয়ামের ধারণ ক্ষমতার অন্তত ৫ গুণ অতিরিক্ত টিকেট বিক্রি করা হয়েছে। টিকেট বিক্রি হয়েছে অতিরিক্ত মূল্যে। ৫০ টাকার টিকেট বিক্রি করেছে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। অতিরিক্ত টিকেট বিক্রির ফলে বসার জায়গার অভাবে বিশৃক্সখলা সৃষ্টি হয়। এই বিশৃক্সখলা থেকে বড় ধরনের অঘটন ঘটে গেছে।
এই অভিযোগ প্রসঙ্গে টুর্নামেন্ট কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ইমরান হোসাইন সজীব বলেন, ‘আমাদের সন্দেহ ইজারাদারের অতিরিক্ত টিকেট বিক্রি ছাড়াও কালোবাজারে জাল টিকেট বিক্রি হতে পারে। আগের দিন রাতে মক্কা প্রিন্টার্স নামের একটি দোকান থেকে তিন হাজার জাল টিকেট উদ্ধার করা হলেও ওই চক্র আরো বহু জাল বিক্রি করে থাকতে পারে। তবে যারা গেট ভেঙে ঢুকেছে তাদের বেশিরভাগই টিকেট কিনেনি।’
টুর্নামেন্ট কমিটিসহ সংশ্লিষ্টরা দাবি করেছেন, ফাইনাল খেলা দেখতে আসার জন্য টেকনাফের দর্শকদের কয়েকশ’ গাড়ি সরবরাহ করেছেন জেলা বিএনপি নেতা ও উখিয়া–টেকনাফ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেতে আগ্রহী মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। নির্বাচনী মনোভাব ধারণ করে এই বিপুল সংখ্যক গাড়ি দিয়েছেন তিনি। এতে বিনা ভাড়ায় গাড়ি পেয়ে টেকনাফ থেকে কয়েক হাজার লোক এসেছে। তাদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা রয়েছে। টেকনাফ থেকে আসা লোকজনই প্রথমে হামলা করেছে। পরের ধাপে রামুসহ বিভিন্ন এলাকার লোকজনও হামলায় অংশ নিয়েছে।
অন্যদিকে এত বড় আয়োজনে নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রশ্নও উঠেছে। মাত্র কয়েকজন পুলিশ ও আনসার দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়। এই অল্প সংখ্যক পুলিশ–আনসারকে অবজ্ঞা করে গেট ভেঙে মাঠে ঢুকে পড়ে হাজার দর্শক। পরে ডাকা হয় সেনাবাহিনী ও র্যাবকে। এছাড়া আরো বিপুল পুলিশ সদস্যও মোতায়েন করা হয়। কিন্তু পরিস্থিতি আর নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি।
এই প্রসঙ্গে জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) মো. জসিম উদ্দীন চৌধুরী বলেন, ‘হামলাকারীরা অত্যন্ত ভয়াবহভাবে হামলা চালিয়েছে। তারা কোনো কিছু দেখেনি। যে যেভাবে পেরেছে সেভাবে হামলা করেছে। তারা পুলিশ ও আইন–শৃক্সখলাবাহিনীর সদস্যদের টার্গেট করে হামলা করেছে। হাজার হাজার হামলাকারীকে নিয়ন্ত্রণ করতে বেগ পেতে হয়েছে। দফায় দফায় ধাওয়া ও লাঠিচার্জ করে তাদের সরিয়ে দেয়া হয়।’
জেলা ক্রীড়া সংস্থার আহ্বায়ক কমিটির সদস্য এমআর মাহবুব বলেন, ‘স্টেডিয়াম ভবনের পাকা দেয়াল ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট রাখেনি হামলাকারীরা। গ্ল্লাসের সব ভেঙে চুর্ণবিচূর্ণ করে দেয়া হয়েছে। সব কক্ষের আসবাব পত্র, চেয়ার–টেবিলসহ সবকিছু ভাঙচুর করা হয়েছে। অফিস কক্ষে থাকা বিভিন্ন ট্রফিসহ নানা ধরনের ক্রীড়া উপহার ও সামগ্রীসহ সব ভেঙে দেয়া হয়েছে। সব মিলে এক অপূরণীয় হয়ে ক্ষতি হয়ে গেলো। এই পরিস্থিতি কাটিয়ে আবার নতুন করে কার্যক্রম শুরু করতে বহু সময় লেগে যাবে।’












