মুক্তিযুদ্ধের এক কিংবদন্তী শাহজাহান ইসলামাবাদী। দক্ষিণ চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের তিনিই ছিলেন প্রধান নায়ক। কিংবা এভাবেও বলা যায়, তাঁকে কেন্দ্র করেই দক্ষিণ চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ গড়ে উঠেছিল। তাঁর প্রধান কৃতিত্ব হচ্ছে তিনি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর ন্যায় ভারতে না গিয়ে দেশের অভ্যন্তরে থেকেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। চট্টগ্রামে মৌলভী সৈয়দ ও সুলতান–উল–কবির চৌধুরীও দেশে থেকেই মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। তবে তারা দু’জনই প্রথম দিকে ভারতে গিয়েছিলেন, তবে বেশিদিনের জন্য নয়। শাহজাহান ইসলামাবাদী একবারের জন্যও ভারতে যাননি।
পটিয়া, আনোয়ারা ও বাঁশখালী এই তিন থানা জুড়েই ছিল শাহজাহান ইসলামাবাদীর মুক্তিযুদ্ধের বিস্তৃতি। বোয়ালখালীতেও দু’একটা অপারেশন করেন। তাঁর একটি গ্রুপের অধীনে অনেক গ্রুপ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। তাঁর গ্রুপে যতজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল, নিয়মিত বাহিনী হলে হয়ত তাদেরকে নিয়ে একটি ব্যাটালিয়ন গঠন করা যেত। ব্যাটালিয়নের অধীনে অন্তত দুই থেকে ছয়টি কোম্পানি থাকে। সাধারণত ৫০০–১৫০০ সৈন্য নিয়ে সামরিক বাহিনীতে একটি ব্যাটালিয়ন গঠন করা হয়। শাহজাহান ইসলামাবাদীর গ্রুপে পাঁচ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা ছিলো। নিয়মিত বাহিনী হলে তাঁর গ্রুপকে অনায়াসে একটি ব্যাটেলিয়ান হিসেবে গণ্য করা যেত। তাঁর র্যাংক হতো লেফটেন্যান্ট কর্নেল। কিন্তু গেরিলা বাহিনী হওয়ায় সেগুলি আর হয়নি। মুক্তিযুদ্ধকালে দক্ষিণ চট্টগ্রামকে যদি একটি যুদ্ধ এলাকা বা সেক্টর হিসেবে গণ্য করা হতো, তাহলে বরকল হতো তার হেডকোয়ার্টার, যাকে সামরিক পরিভাষায় বলতে পারি ক্যান্টনমেন্ট। শাহজাহান ইসলামাবাদী হতেন দক্ষিণ চট্টগ্রামের মুক্তিবাহিনীর জিওসি।
শাহজাহান ইসলামাবাদী আওয়ামী লীগ করতেন না। কিন্তু দেশকে ভালোবাসতেন। মনে প্রাণে চাইতেন পাকিস্তানের গোলামীর জিঞ্জির ছিন্ন করে বাংলাদেশ স্বাধীন হোক। তাঁর বিখ্যাত পিতা মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী তাঁর স্বদেশপ্রেমের উৎস। মওলানা ইসলামাবাদী আজীবন মাতৃভূমির স্বাধীনতা, স্বদেশ ও স্বজাতির মুক্তির স্বপ্ন লালন করে বৃদ্ধ বয়সে কারানিগ্রহ ভোগ করেছিলেন। তাঁকে লাহোর জেলে মাথা নিচে পা ওপরের দিকে ছাদের সাথে বেঁধে ঝুলিয়ে রেখে আজাদ হিন্দ ফৌজের সাথে তাঁর সম্পর্ক এবং নেতাজী সুভাষ বসুর হদিস জানতে চেয়েছিলো। বুড়ো হাড়ে টনটনে ব্যথা সহ্য করেও বুডোর কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করা সম্ভব হয়নি। তাঁরই তো সন্তান শাহজাহান ইসলমাবাদী, বহুত না হো তো থোড়া ত হবেনই। হয়েছিলেন কিছু পিতৃবৎ শাহজাহান ইসলামাবাদী। আমি লক্ষ্য করেছি মওলানা ইসলামাবাদীর দৈহিক বৈশিষ্ট্যটিও এই পুত্রটি আত্মসাৎ করেছিলেন। তাঁর একমাত্র কন্যার একমাত্র পুত্র ইঞ্জিনিয়ার আবদুল্লাহ আল হারুনের দেহ সৌষ্ঠবেও তাঁর নানার শরীরের আশ্চর্য মিল লক্ষ্য করে আমি অবাক হয়ে ভাবি কী করে এটা সম্ভব হলো। হারুন ভাইও তাঁর নানার ন্যায় একহারা শীর্ণ দীঘল দেহের অধিকারী। তবে নানার ঈগল চঞ্চু নাকটি বোধ হয় পাননি।
শাহজাহান ইসলামাবাদীর বড় কোয়ালিফিকেশন হচ্ছে তিনি ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর পুত্র। যদিও তাঁর নিজের যোগ্যতাও কম ছিলো না।
মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, ডা. অন্নদাচরণ খাস্তগীর, শেখ–এ–চাটগাম কাজেম আলী মাস্টার, যাত্রা মোহন সেন, দেশপ্রিয় জে এম সেনগুপ্ত, শরচ্চন্দ্র দাশ, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, নবীন চন্দ্র সেন, কৃপাশরণ মহাস্থবির, ড. বেণীমাধব বড়ুয়া, নূর আহমদ চেয়ারম্যান, কমরেড মুজফফর আহমদ–এঁরা আমাদের প্রাতঃস্মরণীয় মহাপুরুষ। মওলানা ইসলামাবাদী একটি ব্যতিক্রমী চরিত্র, তাঁর জাত আলাদা। এ ধরনের সুপারম্যান গণ্ডায় গণ্ডায় জন্মায় না। জাতি ভাগ্যবান হলে এরকম দু’একজন মহাপুরুষ জন্মায়। বাংলাদেশ অবশ্যই ভাগ্যবান। মওলানা ইসলামাবাদী জন্মেছিলেন এ দেশে। মওলানা ইসমাইল হোসেন সিরাজী, মওলানা আকরম খাঁ তাঁর সগোত্র হতে পারেন।
মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী বিধাতার এক অপূর্ব সৃষ্টি। এমন বহুমুখী প্রতিভা বিধাতার সৃষ্টিতে খুব কমই দেখতে পাই। রাজনীতি, সাহিত্য, সাংবাদিকতা, সমাজসেবা, সংগঠন, ধর্ম–এমন বিচিত্র পথে তাঁর প্রতিভা বিকশিত হয়েছে যে, আমাদের ক্ষুদ্র জ্ঞানে তার কোন পরিমাপ করে উঠতে পারি না। মওলানা ইসলামাবাদী রাজনীতি করতেন, তাঁর রাজনীতির উত্তরাধিকার হয়তো কিছুটা পেয়েছিলেন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র শামসুজ্জামান ইসলামাবাদী, যাঁর নামে বরকলে একটি স্কুল আছে। তিনি লেখক, সাংবাদিক ও পিতার অনুসারী ছিলেন। তিনি অকাল প্রয়াত। মওলানা ইসলামাবাদী ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিপুরুষ, আজাদ হিন্দ ফৌজের সদস্য–যোদ্ধা ছিলেন; মওলানা ইসলামাবাদীর এই গুণের উত্তরাধিকার বর্তেছে শাহজাহান ইসলামাবাদীর ওপর। মওলানা ইসলামাবাদী সাংবাদিক ছিলেন, তাঁর সাংবাদিক প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র বদরুল আজাদ ইসলামাবাদী (বিএ) আজাদ ইসলামাবাদী।
মওলানা ইসলামাবাদী সশস্ত্র যুদ্ধ করে ব্রিটিশের কাছ থেকে স্বাধীনতা উদ্ধার করতে চেয়েছিলেন। তাঁর পুত্র শাহজাহান ইসলামাবাদীও বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। শাহজাহান ইসলামাবাদী মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিলেন, যদিও তাঁর পিতা বিজয়ী হতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে শাহজাহান ইসলামাবাদী চিটাগাং চেম্বারে কাজ করতেন। প্রধান হিসাব রক্ষক ছিলেন তিনি চেম্বারের।
শাহজাহান ইসলামাবাদী সক্রিয় রাজনীতি না করলেও রাজনীতির উৎসাহী পর্যবেক্ষক এবং রাজনৈতিক বই–পুস্তক, বিশেষ করে বিভিন্ন দেশের বিপ্লবের ইতিহাস, মার্কসবাদী লিটারেচারের নিবিড় পাঠক ছিলেন। প্রখ্যাত বামপন্থী নেতা অধ্যাপক আসহাবউদ্দীন আহমদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিলো তাঁর। বহু সময় বরুমচড়ায় শঙ্খের চরে একটি খামার বাড়িতে অধ্যাপক আসহাবউদ্দীন শাহজাহান ইসলামাবাদী, আনোয়ারার শামসুল আলম মাস্টার এবং সমমনা আরো দু’একজনকে নিয়ে গোপন বৈঠকে মিলিত হয়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং তাঁদের করণীয় নিয়ে আলোচনা করতেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে ৬ দফা দেয়ার পর অধ্যাপক আসহাবউদ্দীন তাকে নিয়ে ব্যাঙ্গ করলেও ৬ দফার মধ্য দিয়ে যে পাকিস্তানের রাজনীতি মোড় পরিবর্তন করতে যাচ্ছে, সেটা শাহজাহান ইসলামাবাদীর দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। তিনি কিছুদিন সাংবাদিকতাও করেছেন। এই সূত্রে তিনি দেশে রাজনৈতিক অগ্রগতির খোঁজখবর পেতেন এবং নিজেকে আপডেট করে রাখতেন।
৭১–এর ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করলে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। শাহজাহান ইসলামাবাদী শহরেই ছিলেন। ইপিআর–এর কোয়ার্টার মাস্টার ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম (পরে মেজর ও বীর উত্তম) শহরে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেন। শাহজাহান ইসলামাবাদী প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন। ৩০/৩১ মার্চ প্রতিরোধ ভেঙে পড়তে থাকলে সবাই গ্রামের দিকে চলে যেতে থাকেন। শাহজাহান ইসলামাবাদী বুঝতে পেরেছিলেন, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ছাত্র–জনতার প্রাথমিক প্রতিরোধ আধুনিক অস্ত্র শস্ত্রে সুসজ্জিত সুশিক্ষিত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সাঁড়াশী আক্রমণের মুখে টিকতে পারবে না। তখন গ্রামে গিয়ে নতুন করে প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে হবে। সেজন্য শাহজাহান ইসলমাবাদী প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। শহরের প্রতিরোধ প্রায় ভেঙে পড়লে তিনি দুটি অস্ত্র নিয়ে আড়ালিয়ার চরে (বাইনজুরি) তাঁর পিতামহ মতিউল্লাহ পণ্ডিতের গ্রামীণ ভদ্রাসন বাটীতে চলে গেলেন। শুধু বাড়ি নয়, এটি বিপ্লবতীর্থ। মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ও তাঁর সন্তানদের আঁতুরঘর।
শাহজাহান ইসলামাবাদী গ্রামে গিয়ে যাঁদেরকে চোখ বুঝে নির্ভর করা যায়, তেমন বিশ্বস্ত, লোকদের একজন দু’জন করে ডেকে ডেকে তাঁর যুদ্ধ পরিকল্পনার কথা জানাতে শুরু করেন। তিনি বলেন, শহরের প্রতিরোধ ভেঙে পড়েছে, এখন গ্রাম থেকেই নতুন করে যুদ্ধ আরম্ভ করতে হবে।
প্রথমে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. গোলাম মাওলার সাথে পরামর্শ করেন। এরপর নিজ গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম ও ছাত্তার, পাশের গ্রামের ফেরদৌস ইসলাম খান, আহমদুর রহমান ও আবুল বশরসহ আরও কয়েকজনকে নিয়ে গড়ে তোলেন একটি সক্রিয় গ্রুপ। পিতা মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী প্রতিষ্ঠিত শামসুজ্জামান উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন।
শুরু করেন অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ। এর অল্প কিছুদের মধ্যে শাহজাহান ইসলামাবাদীর গ্রুপে এসে যোগ দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মুরিদুল আলম (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ), ফরিদুল আলম, মঞ্জুর, আলমগীর, গউছ মোহাম্মদ মালেক, মোজাহের, হাবিবুর রহমান, ছবুর, সোলাইমান, কালামসহ আরও অনেকে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে এই গ্রুপে প্রায় ৪ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা যোগ দেন।
ডা. গোলাম মাওলা ছিলেন শাহজাহান ইসলামাবাদীর খুব বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ছিলেন শাহজাহান গ্রুপের প্রশিক্ষক ও চিকিৎসক। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র চালনা, অচল অস্ত্র সচল করা এবং গেরিলা যুদ্ধের কৌশল শেখাতেন। অসুস্থ, আহত, গুলিবিদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাসহ গ্রামের মানুষদের চিকিৎসা করতেন। শাহজাহান ইসলামাবাদীর মা–ও ছিলেন একজন মহীয়সী নারী। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের মাতৃস্নেহে বুকে টেনে নিয়েছেন। অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিয়ে সুস্থ করেছেন, রান্না করে খাইয়েছেন, পরণের ভেজা কাপড়ও পাল্টে দিয়েছেন।
শাহজাহান ইসলামাবাদী গ্রুপের ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন ফেরদৌস ইসলাম খান। প্রথমবার তাঁর নেতৃত্বে পটিয়া থানা অপারেশন হয়েছিল। এরপর রাজাকার ও পাকিস্তানি সৈন্যরা থানা পুনরায় দখল করে নিলে শাহজাহান ইসলামাবাদীর নেতৃত্বে একটি অপারেশনের মাধ্যমে পটিয়া থানা মুক্ত করা হয় ।
কানাইমাদারীর হাবিলদার আবু ইসলাম তাঁর গ্রুপ নিয়ে আলাদাভাবে থাকলেও তিনি শাহজাহান ইসলামাবাদীর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে বা তাঁকে জানিয়ে অপারেশন করতেন। শাহজাহান ইসলামাবাদীর পরিকল্পিত অপারেশনেও প্রয়োজন হলে অংশগ্রহণ করতেন। জুন–জুলাইর দিকে ভারতে থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রামে অপারেশনের দায়িত্ব নিয়ে বিএলএফ–এর প্রথম গ্রুপ পটিয়া পৌঁছলে সেটিও শাহজাহান ইসলামাবাদীর গ্রুপে যোগ দেয়। এই গ্রুপের কমান্ডার ছিলেন, শহীদ নূরুল আনোয়ার, ডেপুটি কমান্ডার শহীদ ইদ্রিস আনোয়ারী, অজিত, নাসিরুদ্দিন চৌধুরী (সাংবাদিক ও লেখক) ও রণজিৎ।
সাত্তার, মোতালেব এবং সম্ভবত শাহ আলম নামে বরকল এলাকার তিনজন মুক্তিযোদ্ধা ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসার পথে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েছিলেন। তবে কিছুদিন পরে তারা ছাড়া পান এবং তারাও এসে শাহজাহান ইসলামাবাদীর গ্রুপে যোগ দেন।
বরকল এলাকার লোককবি রুহুল আমিন শাহজাহান ইসলামাবাদীর যুদ্ধকালীন তৎপরতা খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে শাহজাহান ইসলামাবাদী ছিলেন স্বল্পভাষী, চিন্তাশীল এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তি। তিনি তাঁর বিশ্বস্ত কয়েকজনকে নিয়ে একটি গোপন গোয়েন্দা গ্রুপ তৈরি করেছিলেন। যাঁদের পরিচয় তিনি, তাঁর ছোট ভাই বদরুল আলম আজাদ ইসলামাবাদী এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. গোলাম মাওলা ছাড়া আর কেউ–ই জানতেন না। তাঁরা ছিলেন সাধারণ মানুষ। এই গ্রুপের কাজ ছিল এলাকার মানুষের গতিবিধি, মুক্তিযোদ্ধাদের গতিবিধি এবং কর্মকাণ্ডের উপর নজর রাখা। তাঁরা প্রতিদিন শাহজাহান ইসলামাবাদীকে আপডেট করতেন। শাহজাহান ইসলামাবাদী সে অনুযায়ী পরিকল্পনা সাজাতেন। বদরুল আলম আজাদ ইসলামাবাদী ছিলেন শাহজাহান ইসলামাবাদীর ছোট শাহজাহান ইসলামাবাদী নিজ গ্রামে অপরিচিত হয়েও যে মুক্তিযুদ্ধের ঘাঁটি করতে পেরেছিলেন, সেটা ভাই বিএ আজাদ ইসলামাবাদীর কারণেই সম্ভব হয়েছিলো। শাহজাহান ইসলামাবাদীকে গ্রামের মানুষ চিনতেন না। কারণ, তিনি শহরে থাকতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি গ্রামে আসেন।
বিমান বাহিনীর সার্জেন্ট মহি আলম চৌধুরীও এসে শাহজাহান ইসলমাবাদাীর গ্রুপে যোগ দেন। তিনি বরিশালের উলানিয়া গ্রামের মানুষ। ছুটিতে থাকা অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তিনি যুদ্ধে যোগ দেন। তিনি প্রথমে ভারতে যান। সেখান থেকে তাঁকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানার পাঁচটি গ্রুপের প্রধান কমান্ডার নিযুক্ত করে দেশের অভ্যন্তরে পাঠানো হয়। তিনি বরকল এসে শাহজাহান ইসলামাবাদীর সঙ্গে দেখা করেন। শাহজাহান ইসলামাবাদী তাঁকে তাঁর গ্রুপের অপারেশন কমান্ডার নিযুক্ত করেন। তাঁর অধীনস্থ গ্রুপ কমান্ডার মহসিন খানও তাঁর গ্রুপ নিয়ে শাহজাহান ইসলামাবাদী গ্রুপের সঙ্গে বিভিন্ন অপারেশন অংশ নিতে থাকেন। এভাবে বরকল, বরমা, কেশুয়া, বাইনুজরী গ্রাম নিয়ে বরকল রাস্তার দু’পাশের বিস্তীর্ণ এলাকা মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়। শাহজাহান ইসলামাবাদীর নেতৃত্বে এই এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রায় অধিকাংশ অপারেশনে অংশগ্রহণ করতেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে যুদ্ধাহতদের চিকিৎসার জন্য আনা হতো, আবার প্রশিক্ষণের জন্যও আসতেন। এছাড়া বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেক মুক্তিযোদ্ধা, কমান্ডার, গ্রুপ কমান্ডার, এরিয়া কমান্ডার অপারেশনের আগে ও পরে শাহজাহান ইসলামাবাদীর কাছে নির্দেশনা ও পরামর্শ নিতে আসতেন, থাকতেন, আবার চলেও যেতেন।
লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতি সংগঠক