দক্ষিণ চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের জিওসি শাহজাহান ইসলামাবাদী

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী | বৃহস্পতিবার , ১৫ মে, ২০২৫ at ৮:২৮ পূর্বাহ্ণ

দক্ষিণ চট্টগ্রামের এমনি আরেকটা মুক্তাঞ্চল ছিলো পশ্চিম পটিয়ায়। জিরি ফকিরা মসজিদ থেকে সাঁইদাইর, বুধপুরা বাজার হয়ে দ্বারক পেরেপরা, পিঙ্গলা পর্যন্ত বিশাল মুক্ত এলাকা ছিল সেটি।

আনোয়ারা থানা অপারেশন : বঙ্গোপসাগর উপকূল থেকে ১০ কিমি উত্তরপূর্বদিকে এবং কর্ণফুলি নদীর মোহনা থেকে ৮ কিমি পূর্বদিকে আনোয়ারা থানার অবস্থান। থানা কমপ্লেক্স থেকে ৪ কিমি দক্ষিণ শংখ নদী, ৫ কি. মি. পূর্বদিকে চাঁনখালি খাল। থানা কমপ্লেক্সের তিনশত গজ উত্তর দিকে ছিল সার্কেল অফিসারের (সিও) অফিস। থানা কমপ্লেক্স বরকল আনোয়ারা সড়কের ঠিক পাশেই অবস্থিত। এই থানা থেকে ৬ কি.মি পশ্চিম দিকে ছিল মেরিন একাডেমি, যেখানে পাক নেভির একদল সদস্য অবস্থান করত। তিন গ্রুপে মিলে মোট ৪০/৫০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে অপারেশনের জন্য প্রস্তুত করা হয়। ভোর পাঁচটায় কমান্ডারের নির্দেশে অপারেশন শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়। শাহজাহান ইসলামীবাদী ও সার্জেন্ট মহি আলমের নেতৃত্বে এই অপারেশনের পরিকল্পনা করা হয়। রাত ১২ টার দিকে বরকল শেল্টার থেকে কমান্ডার সার্জেন্ট আলমের নেতৃত্ব পায়ে হেঁটে ১০/১২ জনের একটি দল আনোয়ারা বারখানইস্থ কমান্ডার আবদুল লতিফের বাড়িতে অস্থায়ী শেল্টারে অবস্থান নেয়। ১০/১২ জনের আরেকটি দল আনোয়ারা থানার কোয়ার্টার মাইল পূর্বপাশে মুক্তিযোদ্ধা স্বপনের বাড়িতে অবস্থান নেয়। আনোয়ারা কেলিশহর থেকে ১০/১২ জনের আরেকটি গেরিলা গ্রুপ পূর্বের পরিকল্পনা যোগাযোগের ভিত্তিতে সোনা মিয়ার বাড়িতে মিলিত হয়। রাত ১২টার দিকে অপারেশনের দায়িত্বে নিয়োজিত শাহজাহান ইসলামাবাদী ও সার্জেন্ট মহি আলম উক্ত দুটি শেল্টারে সবার সাথে যোগাযোগ করেন। রাত একটার মধ্যে সবগুলো দল আনোয়ারা থানার দুই কিলোমিটার পূর্বদিকে একটি গোপন আশ্রয়কেন্দ্রে মিলিত হয়। আক্রমণের সময়ক্ষণ নির্ধারণ করে উপদলগুলোকে স্ব স্ব দায়িত্ব বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। সার্জেন্ট মহি আলমের নেতৃত্বে কাজী ইদ্রিস, ফেরদৌস ইসলাম, নুরুল ইসলামসহ প্রায় ১০/১২ জনের কভারিং কাট অব ও হোল্ডিং পার্টি১ আনোয়ারা প্রাইমারি স্কুলের একশত গজ পূর্বদিকে নির্দিষ্ট স্থান পুকুরপড়ে অবস্থান নেয়। তাঁদের সাথে কিছু রাইফেল ও গ্রেনেড ছিল। শাহজাহান ইসলামাবাদীর নেতৃত্বে আবদুর সবুর, মজিদ, মঞ্জুর আলমসহ আরো প্রায় ১০/১২ কভারিং, কাট অব ও হোল্ডিং পার্টি২ কিছু রাইফেল ও গ্রেনেডসহ আনোয়ারা থানার পশ্চিম দিকে ১৫০ গজ দূরে আনোয়ারা গ্রামের মধ্যে অবস্থান নেয়। হাবিলদার আবু ইসলামের নেতৃত্বে কাসেম, জব্বার, বিএলএফ গ্রুপের নাসির (সাংবাদিক ও লেখক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী), আইয়ুবসহ প্রায় ১৫/২০ জনের এ্যাকশন পার্টি আনোয়ারা থানা দক্ষিণদিকে আনোয়ারা বরকল রাস্তা পাশ থেকে ১০০ গজ পশ্চিম দিকে একটি মন্দিরের পাশে অবস্থান নেয়। রাত ৪টার মধ্যে সবাই পজিশন নেয়ার কাজ সমাপ্ত করে দলনেতার ফায়ারের আদেশের অপেক্ষায় থাকে। পূর্বেই সিদ্ধান্ত হয় যে, ভোর ৫টার সময় দলনেতা সার্জেন্ট আলমের দল থেকে থানা এবং সিও অফিস লক্ষ্য করে ফায়ার ওপেন করা হবে। সাথে সাথে অন্য দুটি গ্রুপও ফায়ার ওপেন করবে। ২২ সেপ্টেম্বর ভোর ৫টায় পরিকল্পনা মোতাবেক দলনেতা আনোয়ারা থানা ও সিও অফিস লক্ষ্য করে ফায়ার শুরু করলে বাকি গ্রুপ দুটো থেকে ফায়ার শুরু হয়। আনোয়ারা থানা ও রাজাকারের অবস্থানগুলো থেকেও এলোপাথাড়ি চারদিকে পাল্টা গুলি হতে থাকে। আনোয়ারা স্কুলে কয়েকজন রাজাকার অবস্থান নিয়েছিল। তারা তাদের অবস্থান থেকে অপারেশন দলের ওপর গুলিবর্ষণ করতে থাকে। তাদের গুলিতে হাবিলদার আবু ইসলাম হাতে গুলিবিদ্ধ হন। তবুও তিনি হামলা বন্ধ করেননি। এভাবে প্রায় ৪০৪৫ মিনিট গুলিবিনিময়ের এক ফাঁকে হাবিলদার আবু ইসলাম ও আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা হামাগুড়ি দিয়ে থানার পেছন দিকে পৌঁছে যান। থানায় অবস্থানরত প্রায় ১০ জন পুলিশ (সঠিক সংখ্যা নিয়ে মতভেদ আছে) গেরিলাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। থানার অভ্যন্তরে ইবিআরসির চারজন রিক্রুটএর সন্ধান পাওয়া যায়। এদের একজন অপারেশনের সময় মারা যায়। পাকবাহিনী তাঁদেরকে ধরে নিয়ে এসেছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাজ করার শর্তে তাদেরকে সাথে নিয়ে নেওয়া হয়। থানার মধ্যে অবস্থানরত যেসকল রাজাকার হাতেনাতে ধরা পড়ে তাদেরকে থানার পাশে পুকুরপাড়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে হাবিলদার আবু ইসলামসহ তিনজন গুলিতে আহত হয়। এছাড়া বেশকিছু অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এই অপারেশনের ফলে এই এলাকায় রাজাকারদের উৎপাত কমে যায়। রাজাকাররা এই এলাকা ত্যাগ করে আনোয়ারার পশ্চিম সীমান্তে গহিরায় চলে যায়। ঘটনার পরেরদিন চট্টগ্রাম শহর থেকে এসে বেশ কিছু পাক আর্মি আনোয়ারা থানার আশেপাশে দোকানপাট ও বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে লুটপাট করে চলে যায় ।

শাহজাহান ইসলামাবাদীর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সময় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন : . জিরি মাদ্রাসা আক্রমণ: ১৪ আগস্ট এই মাদ্রাসায় অবস্থানরত রাজাকার, মিলিশিয়া ও পাকিস্তানী বাহিনীর উপর আক্রমণের প্ল্যান করা হয় জুলাই মাসে হাবিলাসদ্বীপে বসে। শাহজাহান ইসলামাবাদী সহ আরও কয়েকজনের নেতৃত্বে অপারেশনের পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়। ১৪ আগস্ট রাতে আক্রমণের উদ্দেশ্যে সবাই বুধপুরা হাসপাতালে জড়ো হন। সেখান থেকে দুটো দলে ভাগ হয়ে মাদ্রাসা আক্রমণ করা হয়। এই অপারেশনে তাঁরা সফল হন। বেশ কয়েকজন রাজাকার, পাকিস্তানী বাহিনী ও মিলিশিয়াকে হত্যা ও আটক করা হয় ।

. পটিয়া থানা আক্রমণ: পটিয়া থানা আক্রমণ দু’বার হয়েছিল। প্রথমবার শাহজাহান গ্রুপের ডেপুটি কমান্ডার ফেরদৌস খানের নেতৃত্বে। এরপর রাজাকার পাকিস্তানিরা দখল করে নিলে শাহজাহান ইসলামাবাদীর নেতৃত্বে একটি অপারেশনের মাধ্যমে পটিয়া থানা মুক্ত করা হয়। এই অপারেশনে শাহজাহান ইসলামাবাদীর নেতৃত্বে অংশগ্রহণ করেছিলেন, পটিয়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিস, মাহফুজুর রহমান খান, আবদুর রশিদ, দিলিপ দাস প্রমুখ ।

. বরমা রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণ: শাহজাহান ইসলামাবাদী ও ইদ্রিস আনোয়ারীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা এই ঘাঁটিটি আক্রমণ করেছিলেন। যদিও রাজাকারদের কৌশলে তাঁরা চারদিক থেকে আটকা পড়ে গিয়েছিলেন। এমতাবস্থায় তাঁরা দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু শক্তি ও সাহস হারাননি। পরবর্তীকালে ইসলামাবাদীর প্রিয় বন্ধু সার্জেন্ট মহি আলম অসম সাহসিকতার সাথে অভিযান চালালে তাঁরা এই ঘেরাও থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু, সেই অপারেশনে সার্জেন্ট মহি আলম পাকিস্তানীদের ছোঁড়া গুলিতে নিহত হয়েছিলেন ।

শাহজাহান ইসলামাবাদী আনোয়ারার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শামসুল আলম মাস্টারের গ্রুপের সঙ্গেও তাঁদের আমন্ত্রণে সেখানে গিয়ে অন্তত তিনটি অপারেশন করেছেন। এছাড়া দক্ষিণ চট্টগ্রামের সববৃহৎ অপারেশন আনোয়ারা থানা অপারেশনে তিনি তো ছিলেনই। শাহজাহান ইসলামাবাদী আনোয়ারা থানা অপারেশেনের পরিকল্পনা করেন এবং তিনি নিজে বিভিন্ন গ্রুপের সমন্বয়ে একটি বৃহৎ মুক্তিযোদ্ধা দলকে কমান্ড করে অপারেশনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন।

এরকম আরও ডজনখানেক সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা করে শাহজাহান গ্রুপ। যা এই লেখার সংক্ষিপ্ত পরিসরে তুলে আনা সম্ভব নয়। এক সময়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তান অ্যাসেম্বলির অনুবাদক ও ঢাকার কয়েকটি পত্রিকায় সাংবাদিকতা করতেন। পরে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের চিফ অ্যাকাউন্টস অফিসার হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দেরর ৮ ডিসেম্বর তিনি পরলোকগমন করেন।

লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতি সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবৈশ্বিক উষ্ণায়ন : প্রেক্ষিত চট্টগ্রাম
পরবর্তী নিবন্ধড. মঈনুল ইসলামের কলাম