কুমিল্লার লাকসাম উপজেলা জেলার ডাকাতিয়ার উত্তর দিকে খাঁন বাহাদুর চৌধুরী বাড়ি, জমিদার পরিবারে ১৮৩৪ সালে নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আহম্মদ আলী চৌধুরী ছিলেন কুমিল্লা লাকসামের বিরাট জমিদার। যা তৎকালীন সময়ে ত্রিপুরা জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। মাতা আরফাননেসার জ্যেষ্ঠ কন্যা ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী। জমিদারি কায়দায় আরাম আয়েশের মধ্যে দিয়ে আরো দুইভাই, দুইবোন সহ ফয়জুন্নেছা বেড়ে ওঠেন । ১৫ বছর বয়স হতে না হতে কিশোরী ফয়জুন্নেসার রূপ, লাবণ্যের ঢেউ উপচে পড়ে। টানা টানা চোখ যেনো হরিনীর মত সদা চঞ্চল। এই রূপসী কিশোরী কে দেখে সেই সময়ের স্বনামধন্য জমিদার সৈয়দ মোঃ গাজি ১ লক্ষ ১ টাকা দেন মোহরানায় ফয়জুরনেনসাকে বিয়ে করেন। সংসার জীবনে ফয়জুন্নেসা দুইটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। ১৮৭১ সালে, বিয়ের ১৭ বৎসর পর তিনি জানতে পারেন, স্বামীর পূর্বের একটি স্ত্রী আছে। এই বিষয়টি তাঁর আত্মসম্মানে লাগে। তিনি প্রতারিত বোধ করেন। স্বামীকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, সতিনের সাথে ঘরকরার জন্য জন্ম হয়নি তার। তিনি স্বামীর বাড়ি ত্যাগ করে এবং বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটায়। এর মধ্যে পিতা মারা যাওয়ায় জ্যেষ্ঠ কন্যা হিসেবে জমিদারির দায়িত্ব ভার তিনি গ্রহণ করেন। ছেলেবেলা থেকে লেখা–পড়ার আগ্রহ দেখে তাঁর বাবা গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করেন। গৃহশিক্ষক এর কাছ থেকে তিনি দ্রুত বাংলা, আরবী, ফারসী ও সাংস্কৃতিক এই চারটি ভাষা রপ্ত করেন। যার কারণে বিচক্ষণতায়, কর্মদক্ষতায়, তিনি সুচারুভাবে জমিদারির দায়িত্ব পালন করে ছিলেন। জনকল্যাণকামী ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী তাঁর জমিদারি মৌজায় ১৪ টি দিঘি খনন করে পানির সংকট দূর করেন। দাতব্য প্রতিষ্ঠান, এতিম খানা, সড়ক নির্মাণ করে মানবতাবাদী ও সমাজ সংস্কারকের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন । ১৮৯৪ সালে পবিত্র হজ্ব পালন করতে গিয়ে মক্কার হাজীদের জন্য একটি ‘মুসাফির খানা’ প্রতিষ্ঠা করেন। কথিত আছে, বিচ্ছেদের পর তাঁর দেনমোহরের প্রাপ্য, কাবিনের এক লক্ষ এক টাকা দিয়ে পশ্চিমগাও এ সাড়ে তিন একর জমিতে একটি বাড়ি তৈরী করেন। তিনি নওয়াব বাড়ির সদর দরজায় একটি দশ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। যেখানে মহিলাদের জন্য স্বতন্ত্র নামাজ আদায় করার ব্যবস্থা ছিল। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র, কর্মতৎপরতায় পুরুষ শাষিত সমাজে যা বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে । তিনি বাবা মারা যাবার পর পৈতৃক জমিদারি দায়িত্বে অভিজ্ঞতা সফল ভাবে কাজে লাগান। তিনি ছিলেন একমত্র মহিলা জমিদার। সেই সময়ে এিপুরা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন মিঃ ডগলেস। তিনি খেয়াল করেন, ত্রিপুরা অঞ্চল শিক্ষা ও উন্নয়ন এর ক্ষেত্রে ভীষণ অবহেলিত। তিনি বৃটিশ সরকারের কাছে কিছু অর্থ বরাদ্দ চান। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে অর্থ না আসায়, ডগলেস সাহেব বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন, এবং স্থানীয় দশজন জমিদারদের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা হিসেবে একলক্ষ টাকা চাইলেন। কিন্তু কোন জমিদার এত অল্প সুদে অর্থ দিতে রাজি হলেন না। একে একে সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে, তখন ধূমকেতুর মত নারী জমিদারের নায়েব পুঁটলি হাতে ১ লক্ষ টাকা ডগলেসের হাতে তুলে দেন। ডগলেস খুব আনন্দিত এবং নিশ্চিত হলেন। তিনি দেরী না করে নায়েবের সাথে জমিদার বাড়িতে গেলেন ঋণের চুক্তি করতে। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেটকে বিস্মিত করে ফয়জুন্নেছা বললেন ‘আমি কাউকে ঋণ প্রদান করি না, আপনার পরিকল্পনা জনহিতকর। এটা জেনে এই টাকা এিপুরার জন–কল্যাণের কাজে দান করলাম।’ ডগলেস নিশ্চিত মনে ফিরে গেলেন এবং মহারানী ভিক্টোরিয়ার কাছে সবকিছু জানিয়ে একটি পত্র লিখে পাঠালেন। রানী ভিক্টোরিয়া খুশি হয়ে জমিদার ফয়জুন্নেছাকে ‘বেগম’ উপাধি দিলেন। কিন্তু জমিদার এই উপাধি প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ যেখানে অন্য (পুরুষ )জমিদারগণ ‘নোয়াব’ উপাধি পান, তাহলে ওনার ক্ষেত্রে কেন বেগম উপাধি হবে? উপাধির ক্ষেত্রে কোন জেন্ডার থাকা উচিত নয়। রানি ভিক্টোরিয়া খবর পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে এিপুরায় পাঠালেন। তদন্ত কমিটি সব তথ্য নিয়ে যখন জমিদার বাড়ি গেলেন, তখন তারা দেখতে পেলেন, জমিদার হাতির পিঠে চড়ে, তাঁর নির্দিষ্ট কাজে বের হয়ে গেলেন। সময়নিষ্ঠ জমিদার তদন্ত কমিটিকে সময় দিতে অপারগতা জানান। বৃটিশ তদন্ত কমিটি হতবাক হয়ে গেলেন জমিদারের সময়ানুবর্তিতা, তেজস্বি মনোভাব ও অহংকার দেখে। তারা ফিরে গিয়ে ভিক্টোরিয়াকে বিস্তারিত জানালে, ভিক্টোরিয়া আর ভুল না করে ব্যক্তিত্বময়ী এই জমিদারকে ‘নোয়াব’ উপাধি দিলেন। ১৮৮৯ সালে বৃটিশ সরকার ৩৫ হাজার টাকা ব্যয় করে কুমিল্লায় এই জমিদারকে যথাযথ মর্যাদায় অভ্যর্থনা জানান।
নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীর লাইফস্টাইল ছিল ভিন্ন আংগিকের। তিনি শেষ রাতে ঘুম থেকে উঠে অজু করে একান্তে এবাদত করতেন। নামাজ আদায় করতেন। সকাল ৮ টার মধ্য নাস্তা শেষ করে ৮ টা থেকে ১১ টা পর্যন্ত জমিদারি কাজ শেষ করে অন্দর মহলে প্রবেশ করে, অন্দর মহলের পুকুরে কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে গোসল করে জোহরের নামাজ আদায় করতেন। দুপুরের খাবার শেষ করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতেন এবং কিছুক্ষণ জমিদারির কাজ করে আসরের নামাজের পর সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করতেন ।
রবীন্দ্র যুগে যে কয়জন বাংলা সাহিত্যে সাধনা করে যশ ও খ্যাতি অর্জন করেন, নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী তাঁদের মধ্যে অন্যতম। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম সাহিত্যিক হিসেবে নবাব ফয়জুন্নেছার নাম চিরস্মরণীয়। তাঁর সাহিত্য সাধনার খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের সমসাময়িক লেখক। শুধু তাই নয়, প্রথম মুসলিম গদ্য–পদ্যের লেখিকা ছিলেন। ১৮৭৬ খৃষ্টাব্দে ১০ ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা গিরিশ চন্দ্র মুদ্রণ থেকে শ্রীমতি ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী রচিত সাহিত্য গ্রন্থ ‘রূপজালাল’ প্রকাশিত হয়। রক্ষণশীল সমাজে অন্ত পূরুবাসিনী সাহিত্য ক্ষেত্রে যে জ্ঞান অর্জন করেছেন, তা ‘রূপজালাল’ মূলত রূপকের আশ্রয়ে ফয়জুন্নেছার আত্মজীবনী মূলক রচনা। এ ছাড়া আরও ২ টি কবিতার বইও প্রকাশিত হয়। ‘সংগীত লহড়ী’ ও ‘সংগীত শাহ’। রূপজালাল গ্রন্থটি কুমিল্লা, ইন্ডিয়া, লন্ডন বাংলা বিভাগে সংরক্ষিত আছে ।
নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা নবাব। মেয়েদের শিক্ষার প্রতি জোর প্রচেষ্টা চালান। তিনি কুমিল্লায় একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন যা উপমহাদেশের বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন স্কুলগুলোর মধ্যে অন্যতম। ১৮৭৩ সালে বেগম রোকেয়ার জন্মের সাত বছর পূর্বেই নারী জাগরণের অগ্রদূত ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠা করেন ‘ফয়জুন্নেছা জানানা (মহিলা) হাসপাতাল। নবাব বাড়ির কাছে মেয়েদের জন্য স্বতন্ত্র হাসপাতাল। ১৪ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
১৯০৩ সালের ২৩ শেষ সেপ্টেম্বর এই মহীয়সী নারী মৃত্যুবরণ করেন। ২০০৪ সালে ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী কে মরণোওর ‘একুশে পদক’ প্রদান করা হয়। তাঁর নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছাত্রী নিবাসের নামকরণ করা হয়। কুমিল্লায় পৈতৃক ভিটায় ফয়জুন্নেসার জমিদার বাড়িতে অনেক স্মৃতি বিজড়িত ইতিহাস আছে। আছে জাদুঘর।এসব স্মৃতিবিজড়িত দর্শনীয় স্থানগুলো নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হলে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য স্টাডি ট্যুরের মাধ্যমে পরিচয় করিয়ে দেওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানদের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
লেখক : প্রাবন্ধিক, উপস্থাপক, রন্ধনশিল্পী