চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে নদীর তলদেশে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম সড়ক টানেলের সূচনা হলো। বাংলাদেশ প্রবেশ করলো টানেল যুগে। সাম্প্রতিক সময়ে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ যতটা আলোচিত এবং সেটা দেখার জন্য যতটা কৌতূহল সবার মধ্যে বিরাজ করছে, ঠিক ততটা কৌতূহল সঞ্চারিত হয়েছে টানেলের ‘থিম সঙ’ নিয়ে। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু টানেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যে থিম সঙটা গাওয়া হয়, সেটি প্রযুক্তির কল্যাণে মুহূর্তে বিশ্বের কোটি মানুষের কাছে চলে যায়। নিমিষেই এটি জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী নিজেই গানটির কথা উল্লেখ করেছেন তাঁর ভাষণে। গানটি লিখেছেন কবি ওমর কায়সার। শুরুটা তিনি এভাবে করেছেন :
আলোয় আলোয় আজ পাতালপুরি
জাদুর ছোঁয়ায় হয়ে গেল স্বপ্নপুরী
জাতির পিতা তোমার নামে
টানেল হলো চট্টগ্রামে
আনন্দে আজ মন হয়েছে রঙিন ঘুড়ি।
এ পর্যন্ত শ্রোতারা সাধারণ দৃষ্টিকোণে শুনেছেন গানটি। কিন্তু পরক্ষণে যেই পঙ্ক্তিটি কানে এলো, তখন শ্রোতাদের কানের সঙ্গে অন্যরকম অনুভূতি এসে যুক্ত হলো হৃদয়ে।
কী উনিলাম আজব কথা
দইজ্জার তলে চলের গাড়ি
বুডুর গড়ি দুই মিনিটে
পৌঁছি যাইয়ুম বাপর বাড়ি
শেখ হাসিনা বাপর বেডি
কাজর খেইল দেহাই দিইয়ি
হথাত যারা ফডর ফডর
ইতারা বেয়াগ ফডত গেইয়ি।
কী অদ্ভুত বিষয়! এখানে প্রমিত বাংলার সঙ্গে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাকে মিশিয়ে নিয়েছেন, যা হৃদয় স্পর্শ করেছে। আমরা দেখলাম, বাংলাভাষায় লেখা গানের মধ্যে চট্টগ্রামের ভাষা জুড়ে দেওয়ার দক্ষতা অসাধারণ। এই অংশটুকু শুধু চট্টগ্রামের মানুষের নয়, সব অঞ্চলের মানুষ পছন্দ করেছে। এরপর এসেছে আবার সেই ভাষা :
আমরা গড়ি, আমরা পারি
দুঃখনদী দিলাম পাড়ি
বিশ্বে এমন অগ্রগতির নেইকো জুড়ি।
অবাক বিশ্ব তাকিয়ে আছে
অবাক বিশ্ব তাকিয়ে আছে
অবাক বিশ্ব তাকিয়ে আছে।
গানটির সুর সংযোজন ও সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন দেশবরণ্যে জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী পার্থ বড়ুয়া। পার্থ বড়ুয়ার সঙ্গে এই গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন সন্দীপন দাশ, সাব্বির জামান, নিশীতা বড়ুয়া এবং তাসমিনা অরিন। গানটির সঙ্গে কোরিয়াগ্রাফিতে যুক্ত হয়েছেন নৃত্যশিল্পী অনন্য বড়ুয়া ও তার দল। এটি নির্মাণ করেছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।
ওমর কায়সার মেধাবী এক কবি। যিনি কবিতায় সবসময় সমকালকে স্পর্শ করেন। তাতে দ্রোহ আছে, প্রেম আছে, দুঃখ আছে, বিরহ আছে, আছে প্রকৃতি ও জীবনের নানা জটিলতা। যদিও তাঁর ভেতরে বাস করে ধ্যানমগ্ন এক মানুষ। তিনি সমাজের কথা বলেন, সৌন্দর্যের কথা বলেন। সামপ্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান অত্যন্ত দৃঢ়, প্রগতিশীলতাকে ধারণ করেন বলে তাঁর প্রতিটি উচ্চারণ খুবই স্পষ্ট, অর্থবহ ও গভীর। কবিতার প্রকাশভঙ্গি, বিষয়–বৈচিত্র্য, শব্দের অনন্তের দোতনা ও ছন্দের অমোঘ বাণীতে তিনি ভাস্বর। তিনি গড়ে তুলেছেন নিজস্ব ভুবন। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে: প্রাগৈতিহাসিক দুঃখ, আকাশ বুনন, প্রতিমা বিজ্ঞান, বাস্তুসাপও পালিয়ে বেড়ায়, প্রাচীন প্রার্থনাগুলো, নির্বাচিত কবিতা, আমিহীন আমার ছায়াগুলো। গ্রন্থের নামকরণেই ধারণা করা যায় কবি ওমর কায়সারের চিন্তাচেতনা ও দর্শন। নিবিড় পাঠের মাধ্যমে স্পর্শ করা যায় তাঁর কবিতার কলকব্জা।
ওমর কায়সার কবিতায় সাময়িকতাকে ডিঙোতে পারেন অনায়াসে। সুন্দর সমন্বয় করতে পারেন প্রেম আর দ্রোহের। প্রতিটি কবিতায় ফুটে ওঠে নিজস্ব দর্শন। তাঁর পঙক্তিগুলো যেমন সরল–স্মার্ট–আঁটোসাটো, তেমনি উপমায় নতুনত্ব লক্ষণীয়। ভাব আর ভাষা দিয়ে তিনি অবলীলায় স্পর্শ করতে পারেন পাঠকের মন। এখানে তাঁর একটি কবিতার উদ্ধৃতি দিচ্ছি :
স্বরমণ্ডলের মতো সাজিয়ে রেখেছো সাত সাতটি চেয়ার
অথচ মানুষ আছে আটজন
একজন নিশ্চিত ঝরে যাবে জেনেও মানুষ চেয়ার–সঙ্গীত শোনে
আর বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে সাতটি চেয়ারের চারপাশে আটজন দখলমত্ত মানুষ
এভাবে বারবার একেকটি চেয়ার উঠে যাবে আর এক একজন মানুষ ঝরে যাবে।
[চেয়ারের গান]
ওমর কায়সার নিজেকে কেবল কবিতার অঙ্গনে সীমাবদ্ধ রাখেননি, সাহিত্যের অন্যান্য শাখায়ও রেখেছেন তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর। প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, শিশুসাহিত্য প্রভৃতি শাখায় তিনি স্বতঃস্ফূর্ত ও নিবেদিত। প্রকাশিত হয়েছে উপন্যাস : ‘অ্যাকুরিয়ামের দিনগুলো’, কিশোর উপন্যাস : ‘দূর সাগরে পথ হারিয়ে’ ও ‘মেছো ভূতের গল্প’ ; ছোটদের গল্প: ‘পরি ও জাদুর তুলি’, ‘জাদুর বেলুন’, ‘অবিকল স্বপ্নের মতো’, ‘সে এক আশ্চর্য বাতি’, গুরুত্বপূর্ণ রচনা : ‘গল্পে শেখো বাংলা ভাষা’ এবং পরিবেশ বিষয়ক গ্রন্থ : ‘তৃণভূমি’। এ ছাড়া বেশ কিছু সংকলন সম্পাদনা করে তিনি সুধিজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর শিশুসাহিত্য আমাদের আরেক সম্পদ। এমন এমন ছড়া তিনি উপহার দিয়েছেন, যা অভাবনীয়। তাঁর একটি ছড়ার উদাহরণ দিতে চাই, যেটি আমি বিভিন্ন বক্তৃতায় উল্লেখ করি।
কালো এক ষাঁড়
বাঁকা করে ঘাড়
তেড়ে আসে তার
সাম্প্রদায়িক হিংসায়–
যেন সেই ষাঁড়ে
এগোতে না পারে
বাধা দিতে তারে
আমাদেরও ঠিক
বড় বড় দুটো শিং চাই।
অন্যদিকে তাঁর কিশোর গল্প তুলনাহীন, ছোটোদের মনে কৌতূহল সঞ্চার করতে সক্ষম। ‘সে এক আশ্চর্য বাতি’ গ্রন্থের ফ্ল্যাপে কিছু কথা লেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। তাতে আমি তাঁর কিশোর গল্পের ছোট্ট মূল্যায়ন করতে পেরেছিলাম।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন সাংবাদিকতাকে। পূর্বকোণ, ভোরের কাগজ হয়ে বর্তমানে দৈনিক প্রথম আলোতে কর্মরত আছেন তিনি, চট্টগ্রাম অফিসে বার্তা সম্পাদক হিসেবে। প্রায় ৪০ বছর ধরে আমি তাঁর লেখা পাঠ করছি। তাঁকে দেখছি। আমার নানা সাংগঠনিক কাজে আমি তাঁর সহযোগিতা পেয়ে এসেছি। আমরা যখন কিশোরকবিতা আন্দোলনের কথা বলি, তখন আসে তাঁর নাম। এদেশের প্রথম কিশোরকবিতার সংকলন ‘ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে’। এটি সম্পাদনা করেছেন অজয় দাশগুপ্ত, ওমর কায়সার ও উত্তম সেন। তাঁরা ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। আমাদের প্রথম জাতীয় ছড়া উৎসব ও প্রথম কিশোর কবিতা সম্মেলনের আয়োজনে অন্য অনেকের চেয়ে ওমর কায়সারের সনিষ্ঠ সহযোগিতার কথা এখনো আমার মনে আছে। অনেকগুলো পুরস্কার তিনি পেয়েছেন। তন্মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন সাহিত্য পুরস্কার, অধ্যাপক খালেদ শিশুসাহিত্য পুরস্কার, সমধারা পুরস্কার ইত্যাদি। খুব শীঘ্রই পাচ্ছেন আরেকটি পুরস্কার : বাংলা একাডেমি পরিচালিত ‘সা’দত আলি আখন্দ পুরস্কার’। আমরা জানি, তাঁর জন্য আরো বড় পুরস্কার অপেক্ষা করছে। সবচেয়ে বড় পুরস্কার হচ্ছে পাঠকের ভালোবাসা। এই ভালোবাসা তিনি পাচ্ছেন অনবরত। টানেলের থিম সঙ লিখে যে জনপ্রিয়তা তিনি অর্জন করেছেন, তারও তুলনা হয় না। অভিনন্দন কবি ওমর কায়সার।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;
ফেলো (নম্বর : ৪২২), বাংলা একাডেমি।