তেরশত নদীর দেশ বাংলাদেশ।এককালের পঁচিশ হাজার কিলোমিটারের জলপথের বাংলাদেশ। নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। বিস্তৃত অববাহিকা ও জীবন্ত বদ্বীপ দেশটির ঐতিহ্য, সামাজিকতা, সংস্কৃতিকে নদীময় করে রেখেছে। বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, প্রাকৃতিক ঐতিহ্য এ নদী। হাজার বছরের বাঙালিয়ানার শিকড় গ্রথিত প্রোথিত গভীরে। ঐতিহ্য বহমান নদীর স্রোতের সাথে।
এ দেশের মানুষের যা–কিছু ঐতিহ্য, ঐশ্বর্য ইতিহাস, সংস্কৃতি সবকিছুতেই নদীর আশ্রয়–প্রশ্রয় বিমূর্ত। এদেশের সংস্কৃতির ভাষা, ছন্দ ভাটিয়ালি, পল্লীগীতি, জারি–সারি, প্রভৃতি নদীর নান্দনিকতায় ভরা। এসবে নদী প্রধান, নদী জীবন্ত, বিমূর্ত । নদীর জলে নাওয়া, গাওয়া, খাওয়া, পরিশুদ্ধি, চাষবাস এ দেশের মানুষকে প্রকৃতিবান্ধব করে, প্রকৃতির সন্তানে রূপান্তরিত করে। প্রকৃতির সাথে মিশিয়ে রাখি।
নদীর তীরে হাট–বাজার, গঞ্জ, নগর, শহর, গড়ে প্রকৃতির ছোঁয়ায় মানুষের সমাজ বিনির্মাণ ও চর্চিত হয়েছে প্রাচীন বাংলার জনপদ থেকে। এদেশের মানুষের আদি পেশা কৃষি। কৃষি এবং মৎস্য শিকারকে সমৃদ্ধ করেছে নদী এবং তার পলি ও পলল ভূমি। নদীর সাথে মানুষের দৈনন্দিন আচার–আচরণ, সংমিশ্রণ, সংশ্লেষণ বাঙালির ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে। বেদনায়, তাড়নায়, বিসর্জনে, বিহ্বলতায়, বিপদে–আপদে নদীর আশ্রয় গ্রহণ করেছে মানুষ। পানিতে ভাসা, হৃদয়ে জাগা অবিরাম বৃষ্টিপাত, বন্যা খরায় বিভিন্ন ঋতুতে ক্লান্ত–শ্রান্ত বাংলাদেশ। উজানের নদীবাহিত পলি, ভূমির পুষ্টি আমাদের ঐতিহ্যকে পুষ্টিবান করে। সমতল পলিপৃক্ত মাটির বুক চিরে সোহাগে বয়ে যাওয়া মায়াবী নান্দনিক নদীর দেশ, প্রীতি ও স্মৃতির দেশ বাংলাদেশ।
বাঙালির নারীর চোখের জল বাংলার নদীর জলের সাথে একাকার হয়ে সকাল–সন্ধ্যায় জীবনের সাথে প্রতিবেশের মহামিলন ঘটে এই ভূখণ্ডে। এই ভূখণ্ডে নদী ও নারী, নদী ও জীবন, নদী ও সংস্কৃতি সে কারণে অবিচ্ছেদ্য, অবিভাজিত, পরিপূরক।
তেরশত নদীর দেশ নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীর বৈচিত্র্যময় নামের ব্যঞ্জনা, ঐতিহ্যময় প্রবাহের রসময়তা বাংলাদেশের মানুষের জীবনবোধকে নদীর মত বিস্তৃত– কুল ভরা করেছে। নদীমাতৃক এই দেশকে, এই দেশের প্রতিবেশ–পরিবেশকে করেছে সমৃদ্ধ, ঐতিহ্যময়, বৈচিত্র্যপূর্ণ। বিচিত্র এ সম্ভার পৃথিবীর আর কোথায় পাওয়া যায়! বিল–ঝিল, হাওড়–বাওর, জলাভূমি, জলমহাল, নদ–নদী, সাগর–মোহনা সবকিছুতেই প্রকৃতির সাথে বাঙালির জীবনের ছুঁয়ে যাওয়া পরশের প্রভাব বিদ্যমান। এভাবেই গড়ে উঠেছে বাঙালিয়ানার হাজার বছরের সাংস্কৃতিক, সামাজিক পরিমণ্ডল, আবহ।
গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকেই এ দেশে নদী–ঐতিহ্যে সংকটের সূচনা হয়। নদী কমে এসেছে। বিপন্নতার ধারাবাহিকতায় নদীর সংখ্যা এখন হয়েছে সাড়ে চারশত। ৫৭ টি আন্তর্জাতিক নদীই বিপদাপন্ন। বিপদাপন্নতা এখন আন্ত ও আন্তর্জাতিক বিষয়। নাব্যতা শঙ্কা নিয়ে, দখল–দূষণ নিয়ে, অস্তিত্বের সংকট নিয়ে দেশের নদীগুলো চরমভাবে সংকটাপন্ন। দেশের আভ্যন্তরীণ নদীপথ এখন বর্ষা মৌসুমেই সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটারের বেশি নয়। পঁচিশ হাজার কিলোমিটার থেকে সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার!
সংকটের স্বরূপ উদঘাটিত। প্রতিকার নিয়ে নির্লিপ্ততা, নিষ্ক্রিয়তা কিংবা আন্তরিকতার ঘাটতি, সময়োপযোগী পদক্ষেপের অনুপস্থিতি প্রকৃতি পরিবেশ এবং দেশের এই প্রাকৃতিক মূলধনের প্রবাহ নিয়ে আমরা চরমভাবে উদাসীন। আমাদের উদাসীনতা হাজার বছরের এই ঐতিহ্যকে ধ্বংস করতে বসেছে।
দক্ষিণের চিত্রা, কীর্তনখোলা, ভৈরব, রুপসা, কপোতাক্ষ; উত্তরের করোতোয়া, ইছামতি, নারোদ, বড়াল, তিস্তা, সুরমা, ব্রহ্মপুত্র, কংস, সোমেশ্বরী দূষণের দখলে দারুণভাবে সংকটাপন্ন বিপদাপন্ন। দখলদার ও ভূমি দস্যুদের দুর্দমনীয় প্রতাপে বিলীন হওয়ার পথে দেশের শতাধিক নদ–নদী।
পাবনার ইছামতি, কিশোরগঞ্জের নরসুন্দর, বগুড়ার করতোয়া, শাহজাদপুরের বড়াল, ছোট করোতোয়া, নাটোরের নারোদ, তাড়াশের বেহুলা, গাইবান্ধার ঘাঘট, রংপুরের শ্যামাসুন্দরী, নেত্রকোণার সোমেশ্বরী, কুমিল্লা গোমতী, জামালপুরের ব্রহ্মপুত্র, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী– হালদা, বাঁকখালী বিপন্নতায় বিদিশাগ্রস্ত। নদীমাতৃক বাংলাদেশের ঐতিহ্য আমাদের নদ–নদী। এদের প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেহ লুটপাট হচ্ছে এবং স্বাস্থ্যে দূষণ ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। আমাদের জাগতেই হবে।
গতবছরের জুলাই মাসে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে এদেশের নদীগুলো জীবন্ত সত্তা হিসেবে আইনি স্বীকৃতি পেয়েছে। নদীর অভিভাবক সৃষ্টি হয়েছে। দখলকারীদের চিহ্নিত করে বিশাল তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। পরিচ্ছন্ন প্রকৃতিবাদীরা স্বস্তি পেয়েছে, আশান্বিত হয়েছে। দেশের অনেক নদীকেই একাধিকবার আদালতের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে। নদীর দেহ লুণ্ঠনকারী শকুনরা থেমে নেই। পৃথিবীর দেশে দেশে নদীকে আইনি সুরক্ষা দেয়ার প্রক্রিয়া চালু হয়েছে ২০১৭ সাল থেকে।
আমাদের দেশে নদীসমূহের প্রধান সংকট– দখল, দূষণ, নাব্যতা, প্রতিবন্ধকতা এবং অবৈধভাবে নদীদেহ লুন্ঠন ও সংকোচন। বালি, মাটি উত্তোলন, প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা ।
অবহেলা, নির্লিপ্ততা আমাদের অপরাধ হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত। কর্ণফুলী আমাদের দেশের অর্থকরী প্রধান নদী।দূষণে, দখলে, উৎপীড়নে নদীটির বিপদাপন্নতা অবর্ণনীয়। আমাদের অভ্যন্তরীণ এবং বহির্বাণিজ্যের শতভাগ সম্পাদন করার প্রধান মাধ্যম এটি। বিগত প্রায় এক দশক যাবত মহাখনন বা ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের নামে নদীটির উপর যে অত্যাচার– উৎপীড়ন চালানো হয়েছে, তা অবর্ণনীয়।
নদীটি দেশের ব্যবসা ও অর্থকরী মাধ্যম হয়েও চরম অবহেলার শিকারে পরিণত হয়েছে। এভাবে এটি নিজেই ব্যবসার উপাদানে পরিণত হয়েছে। ভূমিদস্যুরা এর দেহ নিয়ে ব্যবসা করছে।
আমাদের নির্লিপ্ততা, প্রশাসনিক অবহেলা, অপেশাদারিত্ব, রাজনৈতিক উদাসীনতা, অদূরদর্শিতা, ভূমিদস্যুদের অপতৎপরতা, শিল্প মালিকদের অসাধুতা নদীটিকে ধারাবাহিক ভাবে নির্যাতন করে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে নদীটি তার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে পারবেনা অদূর ভবিষ্যতে। বিশ্ব নদী দিবসে কর্ণফুলী সহ সকল নির্যাতিত নদীসমূহের পাশে আমাদের দাঁড়াতে হবে। দায়িত্বশীলতার সাথে নদীটির পাশে থাকার প্রত্যয়, প্রতিজ্ঞা আমাদের ভিতর জাগাতে হবে।
আইনি সত্তার অধিকার পাওয়া নদীসমূহের আইনি অধিকার এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ২০১৫ সাল থেকে প্রতিবছর ১৭ আগস্টকে ‘নদী অধিকার দিবস‘ হিসেবে পালন করে আসছে দেশের কতিপয় নদীপ্রেমিক সংস্থা। জাতিসংঘ ‘কনভেনশন অন দ্যা ল অব দ্যা নন নেভিগেশনাল ইউজেস অব ইন্টার্নেশনাল ওয়াটার কোর্সেস‘ বা জাতিসংঘ পানি প্রবাহ সনদ, ১৯৯৭ আন্তঃসীমান্ত বা আন্তর্জাতিক অভিন্ন নদীর একটি বিশ্ব স্বীকৃত রক্ষাকবচ। ১৯৯৭ সালের ২১ মে যখন প্রস্তাব আকারে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক সনদটি গৃহীত হয়, তখন বাংলাদেশও এর পক্ষে ভোট দিয়েছে। তারপর থেকে এ সনদের প্রতি নদীমাতৃক বাংলাদেশের দীর্ঘসময়ের নির্লিপ্ততা ও উদাসীনতা দুঃখজনক, দুর্ভাগ্যজনক, অপরিণামদর্শী। ২০১৪ সালের ১৭ আগস্ট থেকেই সনদটি কার্যকর হয়েছে। আমরা এখনো স্বাক্ষর করিনি।
বিশ্ব নদী দিবসে নদী প্রকৃতি, নদী সম্পদ, নদী ব্যবস্থাপনাকে সময়োপযোগী সুরক্ষিত রাখা অত্যন্ত জরুরী। নদীমাতৃক বাংলাদেশ আবার তার নদীমাতৃত্ব ফিরে পাক। আমাদের নদীগুলো সংকটহীন, শঙ্কাহীন, প্রবাহে উন্মুক্ত থেকে হয়ে চলুক হাজার বছর। নিরন্তর প্রত্যাশা এই।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, অধ্যাপক, কর্ণফুলী গবেষক।