পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে প্রতি বছর ১ থেকে ১০ জিলহজ্ব চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) ব্যবস্থাপনায় কোরবানি পশুর স্থায়ী–অস্থায়ী হাট বসে নগরে। এবারও চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ২০ জুন থেকে হাট বসার কথা। ওই হিসেবে মাঝখানে আর মাত্র পাঁচ দিন বাকি আছে। তবে জেলা প্রশাসনের অনুমতি না পাওয়ায় অস্থায়ী হাট বসাতে ইজারাদার নিয়োগ দিতে পারছে না চসিক। এমনকি দরপত্র প্রক্রিয়াও শুরু করা যাচ্ছে না। এছাড়া কয়টি অস্থায়ী পশুর হাট বসাবে সেটাও চূড়ান্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।
প্রাথমিকভাবে ২৩টি অস্থায়ী পশুর হাট বসানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় চসিক। এসব হাট বসানোর অনুমতি চেয়ে ১১ মে জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করে সংস্থাটি। জানা গেছে, চসিকের কাছ থেকে আবেদন পাওয়ার পর জেলা প্রশাসন সিএমপির কাছে হাটগুলোর বিষয়ে মতামত চেয়ে ২২ মে চিঠি দেয়। ১২ জুন সিএমপির সিটি স্পেশাল ব্রাঞ্চ জেলা প্রশাসনের কাছে মতামত দেয়। এতে ৯টি হাট বসানোর অনুমতি দেয়া যেতে পারে বলে প্রস্তাব দেয়া হয়। এছাড়া সিএমপির আওতাধীন না হওয়ায় একটি হাটের বিষয়ে মতামত জানায়নি। বাকি ১৩টি হাটের বিষয়ে আপত্তি জানানো হয়।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, অস্থায়ী পশুর হাট ছাড়া নগরে তিনটি স্থায়ী পশুর হাট আছে। এগুলো হলো সাগরিকা পশুর বাজার, বিবিরহাট গরুর হাট ও পোস্তারপাড় ছাগলের বাজার। সাগরিকা ও পোস্তারপাড়ে ইাজারাদার নিয়োগ করা হয়েছে। বিবিরহাটে দুইবার দরপত্র আহ্বান করলেও কেউ সাড়া দেয়নি। বর্তমানে সেখানে খাস কালেকশনের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করে চসিক। সাগরিকা পশুর হাটে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কোরবানি পশু আসা শুরু হয়েছে।
অস্থায়ী হাটের বিষয়ে গতকাল চসিকের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, এখনো জেলা প্রশাসনের অনুমতি পাইনি। পেলে দরপত্র প্রক্রিয়া শুরু করব। সময় কম থাকায় প্রয়োজনে বন্ধের দিনেও দরপত্র কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) রাকিব হাসান আজাদীকে বলেন, পশুর হাট বসানো নিয়ে সিটি কর্পোরেশন আবেদন করেছে। আগামীকালের (আজ) মধ্যে একটা সিদ্ধান্ত দেব।
১৩ হাট নিয়ে সিএমপির আপত্তি : চসিকের প্রস্তাবিত ২৩ অস্থায়ী হাটের মধ্যে ১৩টি নিয়ে আপত্তি জানায় সিএমপি। হাটগুলো হচ্ছে সল্টগোলা রেলক্রসিং সংলগ্ন হাট, দক্ষিণ বাকলিয়া ওয়ার্ডের চর চাক্তাই চসিক উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে খালি জায়গা, স্টিল মিল বাজার, উত্তর পতেঙ্গা সিটি কর্পোরেশন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় মাঠ, উত্তর হালিশহর ওয়ার্ডের গলিচিপা পাড়া বারুণী ঘাটা ও গাজী হালদা খালি জায়গা, পাঁচলাইশ ওয়ার্ডের কয়লার ঘর ক্রিয়েটিভ স্কুলের সামনে, বকসু নগর মসজিদ সংলগ্ন মাঠ, মধ্যম শহীদ নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ, পশ্চিম শহীদ নগর কালু কোম্পানির বাড়ির পাশে, কামরাবাদ সামাদপুর মোড়, হাজী পাড়া বারেক শাহ মাজার সংলগ্ন মাঠ, মোহরা ওয়ার্ডের জান আলী স্টেশন সংলগ্ন রেলওয়ের পরিত্যক্ত মাঠ এবং পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ডের বাকলিয়া এঙেস রোডের পাশে খালি মাঠ।
যে কারণে আপত্তি : জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠানো সিএমপির সিটি স্পেশাল ব্রাঞ্চের তথ্যগুলো পর্যালোচনায় জানা গেছে, সল্টগোলা রেলক্রসিং বন্দর এলাকার সবচেয়ে ব্যস্ততম স্থান। প্রস্তাবিত জায়গাটিতে গরু বাজার বসানোর মতো স্থান নেই। সেখানে একটি কবরস্থান আছে। তাছাড়া সেখানে অস্থায়ী গ্যারেজ ও স্থাপনা দ্বারা পরিপূর্ণ। বন্দরের যানবাহন, কাভার্ড ভ্যান, লং ভেহিকেল খোলা ট্রাক উক্ত রাস্তা দিয়ে চলাচল করে। গরুর বাজার বসানোর মতো যথেষ্ট উন্মুক্ত স্থান না থাকায় বাজারের প্রভাব মূল রাস্তায় পড়বে, যা বন্দরের মূল গেট যেমন লং ভেহিকেল গেট, ৫ নং গেট, সিপিএআর গেটে প্রভাব পড়বে। এতে বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি সাধারণ যানবাহন চলাচল বিঘ্ন ঘটবে। তাই সেখানে কোরবানির পশুর বাজার বসানোর অনুমতি প্রদান করা সমীচীন হবে না বলে মতামত দেয় পুলিশ।
চর চাক্তাই চসিক উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠটি একাধিক সরু ও সংকীর্ণ অলি–গলি দ্বারা সংযুক্ত। সেখানে পশু বহনকারী ট্রাক–পিকআপ এবং ক্রেতা–বিক্রেতাদের গাড়ি চলাচল, পশু লোড–আনলোড কিংবা আগত যানবাহনের কোনো পার্কিং স্থান নেই। গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম ব্যবসা কেন্দ্র ও ঘনবসতিপূর্ণ চাক্তাই এলাকায় পশুর হাট উপলক্ষে সংকীর্ণ গলিপথে পশুবাহী ও ক্রেতা–বিক্রেতার অতিরিক্ত যানবাহন প্রবেশ করলে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হবে এবং পশুর হাটে পশু পরিবহন ও ক্রেতা–বিক্রেতার গমনাগমনেও সমস্যা সৃষ্টি হবে।
স্টিল মিল বাজার এবং উত্তর পতেঙ্গা সিটি কর্পোরেশন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় মাঠে হাট বসালে নির্মাণাধীন এলিভেটেড এঙপ্রেসওয়ে নির্মাণের কারণে সংকুচিত রাস্তায় যানবাহন চলাচলসহ মানুষের যাতায়াতে বিঘ্ন ঘটবে এবং আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া সেখানে হাট বসলে পতেঙ্গা এলাকায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হবে।
উত্তর হালিশহর ওয়ার্ডের গলিচিপা পাড়া বারুণী ঘাটা ও গাজী হালদা খালি জায়গায় বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ও আশেপাশে কোনো ব্যাংকের শাখা, দূর–দূরান্ত থেকে আসা গরু বেপারিদের থাকার সুব্যবস্থা নেই। এছাড়া বাজারটি এক রাস্তা বিশিষ্ট এবং অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থায় অপ্রতুলতা রয়েছে।
কয়লার ঘর ক্রিয়েটিভ স্কুলের সামনে, বকসু নগর মসজিদ সংলগ্ন মাঠ, মধ্যম শহীদ নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ, পশ্চিম শহীদ নগর কালু কোম্পানির বাড়ির পাশে, কামরাবাদ সামাদপুর মোড় এবং হাজী পাড়া বারেক শাহ মাজার সংলগ্ন মাঠে পশুর হাট বসলে রাস্তাঘাটে লোকজনের চলাফেরা বিঘ্ন ঘটবে। এছাড়া যানজট সৃষ্টি, ইজারা (হাসিল) আদায়কে কেন্দ্র করে উক্ত অস্থায়ী পশুর হাটসমূহে আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে জান আলী স্টেশন সংলগ্ন রেলওয়ের পরিত্যক্ত মাঠে রেলওয়ের স্থাপনা নির্মাণের কাজ চলছে। এখানে রেল চলাচলকালে যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা আছে। অতীতেও কখনো সেখানে কোরবানি পশুর হাট বসেনি। বাকলিয়া এঙেস রোডের পাশের খালি মাঠে আগত পশুবাহী গাড়িতে পশু লোড–আনলোড ও ক্রেতা–বিক্রেতার গাড়ি সমাগম ঘটলে এর চাপ মূল সড়ক তথা বাকলিয়া হাইওয়ে সড়কে পড়বে এবং এলাকাজুড়ে যানজট সৃষ্টি হবে। তাই হাটটিতেও ইজারাদার নিয়োগ করা সমীচীন হবে না বলে মনে পুলিশ। পাহাড়তলী ওয়ার্ডের চৌধুরীহাট সিএমপির আওতাধীন না হওয়ায় মতামত প্রদান করেনি সিএমপি।
যেসব হাটের অনুমতি দেয়া যেতে পারে : সিটি স্পেশাল ব্রাঞ্চ ৮টি হাট বসানোর অনুমতি দেয়া যেতে পারে বলে জেলা প্রশাসনকে জানায়। প্রস্তাবিত হাটগুলো হচ্ছে ৬ নং পূর্ব ষোলশহর ওয়ার্ডের কর্ণফুলী গরু বাজার (নূর নগর হাউজিং এস্টেট), ৪১ নং দক্ষিণ পতেঙ্গা ওয়ার্ডের বাটারফ্লাই পার্কের দক্ষিণে টি কে গ্রুপের খালি মাঠ, ৪০ নং উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ডের খেজুরতলা বেড়িবাঁধ সংলগ্ন খালি মাঠ, একই ওয়ার্ডের পূর্ব হোসেন আহম্মদ পাড়া সাইলো রোডের পাশে টিএসপি মাঠ, মুসলিমাবাদ টি কে গ্রুপের খালি মাঠ এবং মুসলিমাবাদ রোডের সিআইপি জসিমের খালি মাঠ, ২৬ নং ওয়ার্ডের বড়পোল সংলগ্ন গোডাউনের পরিত্যক্ত মাঠ, পাঁচলাইশ ওয়ার্ডের ওয়াজেদিয়া মোড় এবং দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের আউটার রিং রোডস্থ সিডিএ বালুর মাঠ।
প্রসঙ্গত, গত বছর চসিকের ব্যবস্থাপনায় অস্থায়ী হাট বসেছিল ৩টি। ২০২২ ও ২০২১ সালে স্থায়ী–অস্থায়ী মিলে ছয়টি করে পশুর হাট বসেছিল চসিকের ব্যবস্থাপনায়। ২০২০ সালে অস্থায়ী চারটিসহ মোট হাট বসেছিল সাতটি।