তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘনঘটা : আতংকিত বিশ্বমানবতা

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | শুক্রবার , ১৮ অক্টোবর, ২০২৪ at ৮:১৩ পূর্বাহ্ণ

বিশ্ব ক্রমেই যেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পথে হাঁটছে। গোটা বিশ্ব এখন দু’ভাগে বিভক্ত। একটি ইসরায়েল এর পক্ষে, আরেকটি গ্রুপ ইসরায়েল এর বিপক্ষে। চতুর্মুখী যুদ্ধের ডামাডোল চলছে আজ। একদিকে গাজার ৯০ শতাংশ জনপদ বিরাণ ভূমিতে পরিণত করেছে রক্তখেকো নেতানিয়াহু প্রশাসন। ৪২ হাজার নিরপরাধ নারী, শিশু, যুবা, বৃদ্ধের রক্তে সয়লাব হয়ে গেছে ২৩ লাখ অধ্যুষিত গাজার সবুজ জনপদ। গাজায় এখন আর পাখিরা ডাকে না, কুহু কুহু রবে আল্লাহর গুণগান গায় না কোন পশুপাখি, মর্মর পাতার ধ্বনি শোনা যায় না এখন। সূর্যের আলোতে রাঙিয়ে তুলে রক্তের হোলিখেলা। বিশুদ্ধ পানির অভাব, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন গাজাবাসীকে ঠেলে দিয়েছে এক দুর্গম অন্ধকার জীবনে। প্রতিটা মুহূর্ত যেন গাজা এখন মৃত্যুপুরী। কখন যেন বর্বর ইসরায়েল বাহিনী হঠাৎ করে অভিশপ্ত বোমা ফেলে নিঃশেষ করে দেব নিরপরাধ ছোট্ট শিশু মণিদের। আর তারা হাসিমুখে বরণ করে নেবে শাহাদাতের পেয়ালা। নিজ মাতৃভূমি রক্ষার তাগিদে দেদারছে নিজের রক্ত ঢেলে দিচ্ছে গাজার অসহায় মানুষগুলো। আর নিমিষেই হারিয়ে যাচ্ছে অচিন পাখির দেশেযেখান থেকে ফেরে না কেউ কোনদিন, কস্মিনকালেও। শাহাদাতের পেয়ালা পান করে মহান স্রষ্টার সাক্ষাৎ পাওয়ার দুর্লভ সুযোগ হয়েছে তাদের। মনে হয় তারা যেন অনন্ত জান্নাতের আকাশে রঙিন পাখি হয়ে উড়ছে আর অবলোকন করছে মহান রাজাধিরাজের অনন্ত সৃষ্টিলীলা। এর চেয়ে সৌভাগ্যবান কেউ হতে পারবে কিনাঅন্তত আমার জানা নেই। শরীর থেকে এক ফোঁটা রক্ত গেলে প্রচন্ড কাতরায় মানবদেহের প্রতিটি অণুপরমাণু। আর গাজার শিশুরা সেই রক্তকে আলিঙ্গন করছে প্রতিটি মুহূর্তে। গাজা যেন জান্নাতের এক সাক্ষাৎ বালাখানা।

বলছিলাম, গাজাবাসীদের উপর বর্বর ইহুদিদের বীভৎসতার প্রতিচ্ছবি, নৃশংসতার অকাট্য প্রমাণ। আল্লাহর পথে শহীদ হওয়া এত সহজ নয়, গাজাবাসীর কপালে জুটেছে সেই ব্যতিক্রমী অপূর্ব সুযোগ। এত নৃশংসতার পরেও বর্বর ইসরায়েল সেনাদের তৃষ্ণা যেন এখনো মিটেনি। আহারে গাজা! আহারে গাজার শিশু! আমরা তো তোমাদের থেকেও অধম, এক ফোঁটা রক্ততো দিতে পারিনি কস্মিনকালেও। এই দানবীয় শরীর থেকে এক ফোঁটা রক্ত গেলে যেন শরীরময় বয়ে যায় আকাশচুম্বী উচ্ছলতা। সে’সব শিশুদের শাহাদাতী নজরানার এক ছিটেফোঁটা যদি পেতাম তাহলে জীবনকে মনে করতাম ধন্য, ধন্য আর ধন্য। এখন লেবাননে শুরু হয়েছে আরেক মহাযুদ্ধহিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসারাল্লাহকে শহীদ করেছে বর্বর নেতানিয়াহু। আমেরিকার তৈরি ব্লাংকার ব্লাষ্টার বোমায় ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছে এই অকুতোভয় বিশ্ব ইসলামী বিপ্লবের দাঈকে। মাথানত করেনি তবুও বর্বর ইসরায়েলের সামনে, ‘অনেক নবীই (এখানে এমন) ছিলো, নবী (আল্লাহর পথে) যুদ্ধ করেছে, তার সাথে (আরো যুদ্ধ করেছে) অনেক সাধক ব্যক্তি, আল্লাহর পথে তাদের ওপর যত বিপদ মসিবতই এসেছে তাতে (কোনোদিনই) তারা হতাশ হয়ে পড়েনি, তারা দুর্বলও হয়নি, (বাতিলের সামনে তারা) মাথাও নত করেনি, আল্লাহতায়ালা ধৈর্যশীলদের ভালোবাসেন’সূরা আলে ইমরান১৪৬। এই বিপ্লবী বীর হাসান নাসারাল্লাহর সাথে আরও শহীদ হয়েছেন ইরানের আইআরজিসি’র ডেপুটি কমান্ডার আব্বাস নিলফুরাশানসহ অনেক হিজবুল্লাহ কমান্ডার। গত জুলাইতে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেসকিয়ানের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শহীদ হয়েছেন হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়া। এটি ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের দ্বারাই সংঘটিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। এর আগে ২০২০ সালে মেজর জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে ইসরায়েলি গোয়েন্দাবাহিনী। এর পরপর ফুয়াদ শুকর, ইব্রাহীম আকিলসহ অনেক ইরানী পরমাণু বিজ্ঞানী, আইআরজিসি’র কমান্ডারকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি বর্বর বাহিনী। হামাস প্রধান হুইল চেয়ারে বসা অন্ধ হাফেজ ইয়াসিনকে শহীদ করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। এভাবে একে একে ফিলিস্তিন, লেবানন ও অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামের দাঈদেরকে নির্মমভাবে শহীদ করেছে বর্বর ইসরায়েলি বাহিনী। লেবাননের স্থল অভিযান শুরুর পর থেকেই অপ্রতিরোধ্য হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হচ্ছে কুফুরী শক্তির ধারকবাহক অভিশপ্ত ইসরায়েলি যোদ্ধাদেরকে। শুনা যাচ্ছে, গত ১লা অক্টোবর ইরান থেকে ২০০ ব্যালিস্টিক হাইপারসনিক মিসাইল নিক্ষেপ করেছিল ইসরায়েল ভূখন্ডে আর তাতেই লন্ডভন্ড হয়ে গেছে ইসরায়েলদের অহংকার আয়রন ডোম নামক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। অনেকগুলো যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়েছে সেই মিসাইল নিক্ষেপের ঘটনায়। এরপর থেকে ফুঁসে উঠেছে বর্বর নেতানিয়াহু। বিশ্বমোড়ল খ্যাত সন্ত্রাসী রাষ্ট্র আমেরিকার প্রত্যক্ষ মদদে দুঃসাহস দেখাচ্ছে বর্বর ইসরায়েল। ১লা অক্টোবরের হামলার প্রতিশোধ হিসাবে ইহুদী রাষ্ট্রটি এখন ইরানের তেল স্থাপনা ও পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার ব্যর্থ পরিকল্পনা করছে। আর এদিকে পৃথিবীর পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র, সামরিক শক্তিতে যার র‌্যাকিং ১৪তম সেই ইরানও বসে নেই। তারাও পাল্টা হুংকার দিয়ে বলেছেযদি বর্বর ইসরায়েল ইরান আক্রমণের দুঃসাহস দেখায় তাহলে ইসরায়েলের প্রতিটি স্থাপনায় এমনভাবে আঘাত করা হবে যে, এতে করে পুরো ইসরায়েল নামক দেশটি পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। আবার জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর উপর হামলার ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসছে পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহ। এমনকি তার ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রও। এতে করে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে ইসরায়েল। ৪০টি দেশ এরই মধ্যে শান্তিরক্ষী বাহিনীর উপর হামলার ঘটনায় ইসরায়েল এর উপর অনাস্থা প্রকাশ করেছে। এরই মধ্যে ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স ইসরায়েলের সাথে অস্ত্র সরবরাহ চুক্তি স্থগিত ঘোষণা করেছে। নিকারাগুয়া ইসরায়েলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। ইসরায়েলের জন্য আরেকটি বড় দুসংবাদ হচ্ছেযদি ইসরায়েল ইরানে আক্রমণ করার দুঃসাহস দেখায়তাহলে আরব দেশগুলো তাদের আকাশসীমা ব্যবহার করতে দেবে না। এর মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার। মোনাফেক রাষ্ট্র হিসাবে খ্যাত জর্ডান মুসলিম দেশ হয়েও ইসরায়েলকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করছে। এশিয়ার সিংহ খ্যাত তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান সিংহের মতন গর্জন করে উঠেছেমুসলিমদের রক্তচোষা বর্বর নেতানিয়াহুকে আল্লাহর কাছে পাঠানোর হুমকি। আর ইরানের পাশে তো দীর্ঘদিনের মিত্র রাশিয়া আছেইসাথে আর এক শক্তিধর রাষ্ট্র চীনের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতা। এসব কিছু বিবেচনা করে ইসরায়েল নামক বর্বর রাষ্ট্রটি এক পা এগুতে চাইলে ১০পা পেছাচ্ছে এবং তাদের মনোবল দিন দিন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। আবার ইসরায়েলের ভেতরে চলছে গণঅসন্তোষ।এখনো ১০০ জিম্মি রয়েছে হামাসের অধীনে। সেই জিম্মিদের স্বজনরা প্রায় প্রতিদিনই তেলআবিবের রাজপথ কাঁপিয়ে তুলছে প্রতিনিয়ত। এদিক দিয়েও নেতানিয়াহু খুব একটা স্বস্তিতে নেই। দুর্ধর্ষ ইসরায়েল সিরিয়ার দামেস্কে কয়েক দফায় হামলা করেছে। সেখানেও ইরানের বিপ্লবী গার্ডের কয়েকজন কমান্ডারকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। ২০০৬ সালে হিজবুল্লাহইসরায়েলের মধ্যকার ৩৪ দিনের যুদ্ধে বর্বর ইসরায়েলিরা নাকে খত দিয়ে যুদ্ধ স্থগিত করে নিজ দেশে ফিরে গিয়েছে। এদিকে ইরাকের প্রক্সি সংগঠনগুলো যেমন: ইয়েমেনের হুতি, ইরাকের রেসিস্ট্যান্স গ্রুপ, হামাস, হিজবুল্লাহসহ অনেক অঙ্গ সংগঠন ইসরায়েলের ভূখন্ডে ড্রোন, অত্যাধুনিক মিসাইল হামলা চালিয়ে নাস্তানাবুদ করে তুলছে। লাখ লাখ অবৈধ ইসরায়েলি দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। তেলআবিবের আকাশে ঘন ঘন সাইরেন বাজছে। এক্ষুণি যেন ব্যালিস্টিক মিসাইল আছড়ে পড়বে তেলআবিবের ভূখন্ডে। এক বছরের যুদ্ধে গাজায় তাদের অর্জন নগন্য। শুধুমাত্র নিরপরাধ নারীশিশুকে হত্যা ছাড়া আর কিছুই অর্জন করতে পারেনি। লেবাননে সেই আশাও গুড়ে বালি। ১২ লাখ লেবানিজ উদ্বাস্তু। সেখানে অবস্থানরত দেড় লাখ বাংলাদেশীদের অবস্থা আশংকাজনক বলে জানা গেছে। ইরানের সবোর্চ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির একটি নির্দেশের অপেক্ষা মাত্র। পারমাণবিক বোমার বোতাম টিপলেই ছারখার হয়ে যাবে পুরো ইসরায়েল। আর এতেই শংকিত অবৈধ ইহুদি কাফেরগোষ্ঠী। তবে কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শঙ্কা আসন্ন? আর বিশ্ববাসী সে দিকেই মুখিয়ে আছে ভয়ংকর অবয়বে।

লেখক: সভাপতিরাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমাদের অমলকান্তি- বেতারের কিংবদন্তি নাট্যজন মাহবুব হাসান
পরবর্তী নিবন্ধবেলকনি থেকে পড়ে তারকা লিয়াম পেইনের মৃত্যু