প্রতিষ্ঠার ১৩৭ বছর পর এসে ল্যান্ড লর্ড পোর্টে পরিণত হতে যাওয়া চট্টগ্রাম বন্দরের বে টার্মিনালও বিদেশি অপারেটরের হাতে ছেড়ে দেয়ার চিন্তাভাবনা হচ্ছে। বে টার্মিনালের তিনটি জেটির মধ্যে (টার্মিনাল) দুটি ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত আগেই চূড়ান্ত হয়। এখন তৃতীয় টার্মিনালও ছেড়ে দেয়ার আলোচনা চলছে। অপরদিকে প্রস্তাবিত লালদিয়ার চর টার্মিনালেও বিদেশি বিনিয়োগের কথাবার্তা চলছে। বন্দরের মূল টার্মিনালগুলোতেও বিদেশি অপারেটর নিয়োগের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। সবকিছু মিলে চট্টগ্রাম বন্দরের গতি নিশ্চিত করতে বিদেশি বিনিয়োগের দিকে সরকার আকৃষ্ট হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
সূত্রে জানা যায়, পৃথিবীতে দুই ধরনের বন্দর ব্যবস্থাপনা চালু রয়েছে। এক ধরনের বন্দরকে বলা হয় টুলস পোর্ট। যেখানে ভূমি, জেটি, টার্মিনাল, ইকুইপমেন্টসহ সবকিছু বন্দর কর্তৃপক্ষের। বন্দর কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রাইভেট কোম্পানি বন্দরের কার্যক্রম পরিচালনা করে। এই বন্দরের যাবতীয় কার্যক্রম বন্দর কর্তৃপক্ষই নিয়ন্ত্রণ করে। অপর একটি সিস্টেম রয়েছে, যেটিকে বলা হয় ল্যান্ড লর্ড পোর্ট। যেখানে বন্দর কর্তৃপক্ষ ভূমির যোগান দেবে। বন্দরের জেটি, টার্মিনালসহ সব ধরনের অবকাঠামোগত নির্মাণ এবং ইকুইপমেন্ট প্রাইভেট কোম্পানি গড়ে তুলবে। এই ধরনের বন্দরের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ প্রাইভেট অপারেটরের হাতে থাকে। বন্দর কর্তৃপক্ষ শুধু নির্ধারিত হারে রাজস্ব নেবে। বিশ্বের প্রথম সারির অনেক পোর্টই ল্যান্ড লর্ড পোর্ট হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দর প্রতিষ্ঠা হয়েছে ১৮৮৭ সালে। ১৩৭ বছর ধরে নানা পরিবর্তন হলেও চট্টগ্রাম বন্দর দীর্ঘদিন ধরে টুলস পোর্ট হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছিল। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে এই বন্দর ল্যান্ড লর্ড পোর্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে যাচ্ছে। আর এই প্রক্রিয়ায় হাজার হাজার কোটি টাকার বিদেশি বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনাল (পিসিটি) পরিচালনার ব্যাপারে বিদেশি কোম্পানির সাথে চুক্তি করেছে। নিজস্ব অর্থায়নে জেটি এবং অবকাঠামো গড়ে তোলা পিসিটি ২২ বছরের জন্য সৌদি আরবের রেড–সি গেটওয়েকে দেয়া হয়েছে। রেড–সি গেটওয়ে এই টার্মিনালের প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট সংগ্রহসহ টার্মিনালটি অপারেট করবে। বন্দর কর্তৃপক্ষ এই টার্মিনাল থেকে চুক্তি অনুযায়ী রাজস্ব সংগ্রহ করবে।
পিসিটির ধারাবাহিকতায় বে টার্মিনাল পরিচালনাও একই ধাঁচে বিদেশি কোম্পানির হাতে দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। বে টার্মিনালের তিনটি জেটির (টার্মিনাল) মধ্যে একটি সিঙ্গাপুরের পিএসএ ইন্টারন্যাশনাল (সিঙ্গাপুর পোর্ট) এবং একটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডকে প্রদানের ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে। আগামী দুয়েক মাসের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর এবং বে টার্মিনাল নির্মাণে গতি আসবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। বে টার্মিনালের একটি জেটি বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেরা রাখার কথা ছিল। তবে এখন সেই জেটিটিও সংযুক্ত আরব আমিরাতের কোম্পানিকে প্রদান করার ব্যাপারে কথা হচ্ছে। অপরদিকে বে টার্মিনালে অয়েল অ্যান্ড গ্যাস টার্মিনাল হিসেবে আলাদা একটি টার্মিনাল নির্মাণের আলোচনা হচ্ছে। ওটাও দেশি–বিদেশি বিনিয়োগে গড়ে তোলা হবে বলে সূত্র জানিয়েছে।
প্রস্তাবিত লালদিয়ার চর টার্মিনালে বিনিয়োগের ব্যাপারে ইতোমধ্যে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শিপিং কোম্পানি ডেনমার্কের এপি–মুলার মায়ের্সক প্রস্তাব দিয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের চিটাগাং কন্টেনার টার্মিনাল (সিসিটি) এবং নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার দায়িত্বও বিদেশি কোম্পানিকে প্রদানের ব্যাপারে আলোচনা চলছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কিছু টার্মিনাল পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে (পিপিপি) পরিচালিত হতে পারে উল্লেখ করে সূত্র বলেছে, প্রস্তাবিত টার্মিনালগুলো ল্যান্ড লর্ড পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে। এতে বন্দর কর্তৃপক্ষ শুধু ভূমির যোগান দেবে, বাকি সব আয়োজন সম্পন্ন করবে বিদেশি কোম্পানি। তারা সরাসরি বিনিয়োগ করে বন্দর গড়ে তুলবে।
বিষয়টি নিয়ে কিছুদিন আগে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়কালে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম সোহায়েল বলেন, বে টার্মিনালে ৮ বিলিয়ন ডলারসহ চট্টগ্রাম বন্দরে ১১ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আসছে। বিদেশি কোম্পানির সাথে চুক্তি করায় বিদেশি বিনিয়োগের দ্বার উন্মোচিত হচ্ছে। বিদেশি কোম্পানিকে বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হলেও সার্বিক নিরাপত্তা এবং চ্যানেল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বন্দর কর্তৃপক্ষের থাকবে। এতে করে চ্যানেল বা জাহাজ বার্থিং নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. মঈনুল ইসলাম বলেন, কী শর্তে বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশিদের দেয়া হবে সেটিই আসল কথা। শর্তগুলোর ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এতে দেশের সার্বভৌমত্বের ব্যাপারটি জড়িত। বিদেশি কোম্পানির বিনিয়োগ এলে দক্ষতা বাড়বে, স্বচ্ছতা বাড়বে। তবে সবকিছুর আগে জাতীয় স্বার্থ দেখতে হবে। জাতীয় স্বার্থ নিয়ে আপস করা হলে বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হবে।