আজিব বাহারের ছয় মাসের ছেলে যখন গত বছর যুদ্ধবিধ্বস্ত রাখাইনে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, ৩৮ বছর বয়সী মায়ের কাছে তখন সন্তানকে দেওয়ার মতো ওষুধ বা খাবার কিছুই ছিল না। ছেলেটি তার হাতের ওপরই মারা যায়। ‘আমার সন্তানরা ক্ষুধায় সারারাত কেঁদেছিল। আমি ঘাস সেদ্ধ করে তাদেরকে দিয়েছিলাম যেন চুপ থাকে,’ কক্সবাজারে এক শরণার্থী শিবিরে বসে রয়টার্সকে এমনটাই বলেছেন বাহার। এ নারী ও তার পরিবারের সদস্যরা পরে মিয়ানমারের সংঘাত আর ক্ষুধা থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন।
সংঘাত, অবরোধ ও দাতাদের তহবিল কাটছাঁটের প্রাণঘাতী সংমিশ্রণের কারণে মিয়ানমারের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত রাখাইন রাজ্য এখন এক উদ্বেগজনক খাদ্য সংকটের মুখোমুখি বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি। মিয়ানমারের এই রাজ্যটি বছরের পর বছর ধরে সংঘাত আর জাতিগত সহিংসতা, নিপীড়নের সাক্ষী হয়েছে, যার বেশিরভাগই গেছে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর দিয়ে। খবর বিডিনিউজের।
দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশটির সংখ্যালঘুদের নিয়ে মঙ্গলবার জাতিসংঘে হওয়া এক উচ্চ পদস্থ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা যেসব শরণার্থী শিবিরে আছে তার সহায়তায় আরো ৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
পাতা খেয়ে বেঁচে থাকা : ২০২১ সালে ক্ষমতা দখল করার পর সৃষ্ট বিক্ষোভ সামরিক বাহিনী শক্ত হাতে দমন করে। এরপর মিয়ানমারজুড়ে বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সংঘাত দেশটির রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক সংকট তীব্র করে তোলে। রাখাইনেও জান্তার সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় শক্তিশালী এক সশস্ত্র গোষ্ঠী, আরাকান আর্মি।
আজিব বাহার ও তার স্বামীসহ ৫ রোহিঙ্গা বলেছেন, বাংলাদেশে পালিয়ে আসার আগে তারা পাতা, ঘাস ও লতা খেয়ে কোনোমতে বেঁচে ছিলেন। এই পাঁচজনই বাংলাদেশে ঢুকেছেন ছয় মাসের মধ্যে। রাখাইনে এক লাখেরও বেশি শিশু এখন তীব্র পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। এদের মধ্যে ২ শতাংশের কম চিকিৎসা নিতে পারছে বলে ত্রাণকর্মীদের অপ্রকাশিত প্রতিবেদনে থাকা তথ্য–উপাত্ত বলছে। নির্যাতন–নিপীড়নের ভয়ে এ ত্রাণকর্মীরা তাদের পরিচয় প্রকাশে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এই সংকটজনিত পরিস্থিতির তথ্য লুকাতে মিয়ানমারের শাসক জান্তা গবেষকদের ক্ষুধার তথ্য জোগাড় না করতে এবং ত্রাণকর্মীদের তা প্রকাশ না করতে চাপ দিচ্ছে, রয়টার্স গত বছরই এক প্রতিবেদনে এ কথা জানিয়েছিল।
জান্তা ও আরাকান আর্মির নিরাপত্তা শঙ্কা ও বিধিনিষেধের কারণে জাতিসংঘ জান্তার নিয়ন্ত্রণে থাকা সিটওয়ে থেকে ত্রাণ রাখাইনের মধ্য ও উত্তর অংশগুলোতে নিয়ে যেতে পারছে না বলে জানিয়েছেন মিয়ানমারে জাতিসংঘের ভারপ্রাপ্ত প্রধান মাইকেল ডানফোর্ড। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির মিয়ানমার প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করা ডানফোর্ড বলেন, আমরা যে ক্ষুধা দেখেছি, তার মাত্রা বাড়াতে এটা অবশ্যই ভূমিকা রাখছে। আমরা মারাত্মক রকমের হতাশ, কারণ আমরা জানি বিপুল সংখ্যক লোক রয়েছে আমাদের সাহায্য যাদের প্রয়োজন।
আরাকান আর্মির মুখপাত্র খিন থু খা বলেছেন, জান্তা ওষুধ ও খাবারসহ ত্রাণ সরবরাহ আটকে রেখেছে। আর তারা জাতিসংঘ এবং অন্যান্য সংস্থাকে সহযোগিতা করছেন। তাদের তথ্য–উপাত্তে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, প্রতি চারটি শিশুর একটি পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। তবে এটা এখনো দুর্ভিক্ষ পর্যায়ে পৌঁছেনি। তিনি জানান, সংঘাতের কারণে লোকজনকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ালেও আরাকান আর্মি তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম যতটা সম্ভব কম রাখার চেষ্টা করছে এবং কর কমিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে রয়টার্স মিয়ানমারের জান্তার মুখপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তার দিক সাড়া পায়নি।
বোমা ফেলুন, দুর্ভোগ শেষ করুন : সংঘাত, ফাঁকা ফাঁকা বাজার, থমকে থাকা অর্থনীতি আর অবরোধ সব একসঙ্গে রাখাইনের বাসিন্দাদের এমনভাবে চেপে ধরেছে যে, তা আগে কখনোই দেখা যায়নি বলে ভাষ্য ত্রাণকর্মীদের। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা দেশের ভেতর উদ্বাস্তু হয়ে বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে অবস্থান করা লাখো রোহিঙ্গার, যাদের অধিকাংশই আগের বিভিন্ন সময়ের সংঘাতে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এখন চলাফেরায় মারাত্মক বিধিনিষেধের মুখে রয়েছেন।
ত্রাণকর্মীদের দেওয়া তথ্য দেখাচ্ছে, সেসব শিবিরে ব্যাপক অপুষ্টির দেখা মিলছে, বাচ্চাদের খাওয়াতে অনেক বাবা–মা তাদের কোনো কোনো বেলার আহার বাদ দিচ্ছেন। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এ বছরের আগস্ট পর্যন্ত এমন দুর্দশায় থাকা মানুষের সংখ্যা দশ গুণ বেড়ে গেছে।
ডানফোর্ড তার সঙ্গে এ বছরের শুরুর দিকে সিটওয়ের বাইরে একটি রোহিঙ্গা শিবিরের এক বাসিন্দার কথা স্মরণ করেন। তহবিল কাটছাঁটের পর বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি খাদ্য সরবরাহ সীমিত করার আগ পর্যন্ত শিবিরগুলোতে পর্যাপ্ত সহায়তা দিয়ে যাচ্ছিলেন তারা। ডানফোর্ড বলেন, ওই ভদ্রলোককে পেয়েছিলাম, তার চোখে পানি, আমাকে বলল, যদি বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি আমাদের খাওয়াতে না পারে, আর কর্তৃপক্ষগুলো সহায়তা না করে, তাহলে দয়া করে আমাদের উপর একটি বোমা ফেলুন। আমাদের দুর্ভোগের অবসান ঘটান।
খাদ্যের অভাবে কঙ্কালসার : আগের দফাগুলোতে যেসব রোহিঙ্গা এসেছিল, তাদের তুলনায় সম্প্রতি যারা আসছে তাদের স্বাস্থ্যের অবস্থা বেশি খারাপ। বিশেষ করে ৫ বছরের নিচের শিশু এবং গর্ভবতী ও বুকের দুধ খাওয়ানো মায়েদের অপুষ্টির মাত্রা ভয়াবহ তীব্র বলে গত মাসে জানিয়েছিল বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতে কাজ করা অলাভজনক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি। নতুন আগতদের সংখ্যা এমন সময়ে বাড়ছে যখন বিশ্বজুড়ে এ খাতে অর্থায়নে সংকট দেখা দিয়েছে এবং স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সংক্রান্ত সেবার ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ছে। ‘খাওয়ার মতো খাবার ছিল না বললেই চলে। বেশিরভাগ দিনই আমরা একবেলা খেতাম,’ বলেছেন বাহারের স্বামী মোহাম্মদ ইদ্রিস, যিনি একসময় রাখাইনের বুথিডংয়ে কৃষিকাজ করে দিন চালাতেন।
মিয়ানমারে শেষ দিনগুলোতে তিনি বেশিরভাগ সময় তার খাবার সন্তানদের দিয়ে দিতেন, তারা খেয়ে বাঁচলে বাকিটুকু তিনি খেতেন। খাবারের দাম বেড়ে গিয়েছিল এবং কখনো কখনো কেনার মতো কিছুই থাকতো না। ‘শেষ কবে ডিম বা মাংস খেয়েছিলাম মনে করতে পারছি না।’ তার স্ত্রী বাহার এখন ৮ মাসের গর্ভবতী। এখন শান্তিতে থাকতে পারলেও কঙবাজারের শরণার্থী শিবিরের পরিস্থিতিও ভালো নয়, বলছেন এ নারী। ভাবছি, এই শিশুও কি ক্ষুধার্ত হয়ে জন্ম নেবে?