একবার এক রাজার মনে হয়েছিল তিনি যদি তিনটা বিষয়ে সমাধান পেতেন: যদি তিনি জানতেন কোন কিছু বা কাজ শুরু করার সঠিক সময় কখন, কার কথা শোনা উচিত, কাকে এড়িয়ে চলা উচিত, এবং কোন কাজটা করা সবচেয়ে জরুরি, তাহলে তিনি কোনো পদক্ষেপে ব্যর্থ হতেন না।
এবং এই চিন্তা যখন তার মাথায় এলো তিনি রাজ্য জুড়ে ঘোষণা দিলেন এই বলে যে, সেই ব্যক্তিকে তিনি পুরস্কৃত করবেন যার মাধ্যমে তিনি জানতে পারবেন কোনো কাজ শুরুর যথার্থ সময় কোনটা, জীবনে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় মানুষ কে/ কারা, এবং কোন কাজটা সম্পাদন করা সবচেয়ে জরুরি। জ্ঞানী মানুষেরা রাজার কাছে এসে নানাভাবে তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগলেন।
প্রথম প্রশ্নের জবাবে কেউ কেউ বললেন, কোনো কাজ শুরুর যথার্থ সময় কোনটা জানতে হলে একজন ব্যক্তির উচিত কাগজে কলমে দিন, ক্ষণ ঠিক করে, সেটা কঠোরভাবে মেনে চলা। তাঁরা বললেন, শুধু এভাবেই একটা কাজ যথা সময়ে, যথাযথভাবে শুরু করা যায়। অন্যান্যরা বললেন, আসলে, আগে থেকে কোনো কাজ শুরুর আদর্শ সময় নির্ধারণ করা একেবারে অসম্ভব। তবে প্রত্যেকের উচিত অলস সময় পার না করে হাতের কাছে যা আছে সেটাতে নিজেকে নিযুক্ত করা এবং কোনটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেটাতে মনোনিবেশ করা। আবার কেউ কেউ বললেন, অবশ্যই যতই করিতকর্মা হোন না কেন রাজার পক্ষে কোনো কাজ যথাসময়ে, যথাযথভাবে শুরুর তরিকা পালন করা কোনোমতেই সম্ভব নয়। তবে রাজার একটা উপদেষ্টা পর্ষদ থাকতে পারে এ ব্যাপারে পরামর্শ করার জন্য।
তারপর, অন্যান্যরা আরো বললেন, অনেক সময় কিছু কিছু বিষয় আসে যেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে উপদেষ্টা পর্ষদের সামনে উপস্থাপনের সুযোগ থাকে না। সেসব বিষয়ে মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত দিতে হয় করা হবে কি হবে না। কিন্তু, সেটা করার জন্যও একজন ব্যক্তির আগে থেকে জানা উচিত কী ঘটছে। শুধু জাদুকরের পক্ষেই এটা সম্ভব। অতএব, যে কোনো কাজ শুরুর যথাযথ এবং যথার্থ সময় জানতে হলে একজন ব্যক্তির অবশ্যই জাদুকরের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
দ্বিতীয় প্রশ্নের ক্ষেত্রেও প্রায় একইরকম উত্তর পাওয়া গেল। কেউ কেউ বললেন, রাজার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তাঁর উপদেষ্টা পর্ষদের সদস্যবৃন্দ। অন্যরা বললেন, যাজকরা। আবার কেউ কেউ বললেন, যোদ্ধারাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
তৃতীয় প্রশ্নের জবাবে উত্তর এলো, বিজ্ঞান হলো সবচেয়ে জরুরি কর্ম বা পেশা। অন্যরা বললেন, এখনো যুদ্ধবিদ্যা–ই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্ম। বাকিরা বললেন, ধর্মীয় আরাধনাই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্ম বা পেশা।
প্রাপ্ত উত্তরগুলোর ভিন্নতার কারণে রাজা কোনোটাতেই সম্মত হলেন না এবং কেউই পুরস্কার লাভের যোগ্য বিবেচিত হননি। কিন্তু, উত্তর পাওয়ার বাসনা এখনো মনে জাগরুক থাকায় রাজা এবার এক সন্ন্যাসীর শরণাপন্ন হওয়ার নিয়ত করলেন। এই সন্ন্যাসী তাঁর বিচক্ষণতার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন।
সন্ন্যাসী পাহাড়ে বসবাস করতেন এবং কখনো সেখান থেকে লোকালয়ে আসতেন না। সাধারণ মানুষের সাথে তাঁর দেখা–সাক্ষাৎ হতো। সুতরাং, রাজা সাধারণ বসনে সন্ন্যাসীর বাড়ির চৌহদ্দীতে পৌঁছলেন। ঘোড়া থেকে নেমে, দেহরক্ষীকে বাইরে অপেক্ষমাণ রেখে তিনি একা এগোতে লাগলেন সন্ন্যাসীর সাক্ষাতের প্রত্যাশায়।
রাজা যখন উপস্থিত হলেন, সন্ন্যাসী তখন তাঁর কুঁড়েঘরের সামনে কোদাল দিয়ে মাটি খনন করছিলেন। রাজাকে দেখে শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে তিনি আবারো মাটি কাটার কাজে মনোযোগ দেন। আসলে তিনি শারীরিকভাবে খুবই নাজুক এবং নড়বড়ে ছিলেন এবং প্রতিটি কোপের সাথে সাথে হাঁপিয়ে উঠছিলেন।
রাজা তার কাছাকাছি গিয়ে বললেন, ‘আপনার মতো একজন জ্ঞানী মানুষের কাছে আমি এসেছি তিনটা প্রশ্নের উত্তর জানতে। প্রশ্নগুলো হলো, কীভাবে আমি যথাসময়ে যথার্থ কাজ করার শিক্ষা পেতে পারি? কে/ কারা আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং কাদেরকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে? এবং, কোন কোন বিষয়গুলো অধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং গুরুত্বের দাবি রাখে?
রাজার প্রশ্ন শুনে সন্ন্যাসী কোনো উত্তর দিলেন না। তিনি হাতে থুথু ছিটিয়ে আবারো মাটি খননের কাজে লেগে গেলেন।
‘আপনি ক্লান্ত’, রাজা বললেন, ‘কোদালটি আমাকে দেন। কিছুক্ষণ আপনার জন্য আমি কাজ করি’।
সন্ন্যাসী রাজাকে ধন্যবাদ দিয়ে কোদালটি হাতে তুলে দিলেন। এবার তিনি মাটিতে বসে পড়লেন। .
কিছুক্ষণ মাটি খনন শেষে রাজা থামলেন এবং প্রশ্নগুলো আবারো করলেন। এবারো তিনি কোনো উত্তর দিলেন না। উঠে রাজার কাছে হাত বাড়িয়ে কোদাল চেয়ে বললেন, ‘কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিন। আমি আরেকটু কাজ করি।’
কিন্তু, রাজা তাকে কোদাল না দিয়ে নিজে খনন কাজ চালিয়ে গেলেন। ঘণ্টা দুয়েক খননের পর সন্ধ্যা নামতে শুরু করলে রাজা কোদালটি মাটিতে গেঁথে রেখে সন্ন্যাসীকে বললেন,
‘আপনার কাছে আমি এসেছি আমার প্রশ্নগুলোর উত্তরের খোঁজে। আপনি যদি উত্তর দিতে না পারেন, আমাকে বলুন। আমি বাড়ি ফিরে যাই।’
‘কেউ একজন দৌড়াতে দৌড়াতে আসছেন, বললেন সন্ন্যাসী। দেখি তিনি কে?’
রাজা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন জঙ্গল থেকে একজন দাড়িওয়ালা মানুষ বেরিয়ে আসছেন। ভদ্রলোক দুই হাতে পেট চেপে ধরে আছেন। সেখান থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। রাজার কাছে আসতেই ভদ্রলোক বেহুশ হয়ে নিচে পড়ে যান। খুবই দুর্বলভাবে তিনি গোঙাচ্ছিলেন। রাজা ও সন্ন্যাসী উভয়েই মিলে তাঁর রক্তমাখা কাপড় ছাড়িয়ে নিইয়ে দেখলেন ভদ্রলোকের পেটে বড় একটা আঘাত। রাজা যতটুকু সম্ভব ভালো করে ক্ষতস্থানটি ধুয়ে নিজের রুমাল ও সন্ন্যাসীর তোয়ালে দিয়ে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলেন। তবুও রক্ত বের হওয়া বন্ধ হচ্ছিল না। রাজা ও সন্ন্যাসী উভয়েই প্রাণপণ চেষ্টা করলেন। শেষমেষ যখন রক্ত গড়িয়ে পড়া বন্ধ হলো তখন আহত ভদ্রলোক কিছু পান করতে চাইলেন। রাজা তাকে খাওয়ার পানি এনে দিলেন। ইতোমধ্যে সূর্য ডুবে গেছে এবং চারদিকে শীত নেমে এসেছে। রাজা ও সন্ন্যাসী দু’জনে মিলে আহত ব্যক্তিকে কুড়েঘরের মধ্যে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। ক্লান্ত– শ্রান্ত রাজা ঘরের এক প্রান্তে ঘুমিয়ে সংক্ষিপ্ত গ্রীষ্ম রাত কাটিয়ে দেন। ঘুম ভাঙার পর তিনি আসলে মনে করতে পারছিলেন না কোথায় আছেন এবং পাশে শুয়ে থাকা আহত ব্যক্তিটি কে।
রাজাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আহত ব্যক্তি বললেন, ‘আমাকে মাফ করবেন।’ জবাবে রাজা বললেন, ‘আমি আপনি কে চিনি না এবং আপনাকে ক্ষমা করার কিছু নেই। ‘আপনি আমাকে চেনেন না, তবে আমি আপনাকে চিনি। আমি আপনার সেই শত্রু যে প্রতিশোধ নেওয়ার শপথ নিয়েছিল কারণ আপনি তার ভাইকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন এবং তার সম্পত্তি দখল করেছিলেন। আমি জানতাম আপনি সন্ন্যাসীর সাথে দেখা করতে একা এসেছিলেন। আমার পরিকল্পনা ছিল ফেরার পথে আপনাকে খুন করব। কিন্তু, দিন ফুরিয়ে গেলো। আপনি ফিরে আসেননি। তখন আমি লুকানো স্থান থেকে বেরিয়ে এসে আপনাকে খুঁজছিলাম। আপনার দেহরক্ষীরা আমাকে আহত করলো। আমি তাদের হাত থেকে পালিয়ে আপনাদের কাছে চলে এসেছিলাম। আপনারা দুইজনের সেবা না পেলে রক্তক্ষরণে আমার মৃত্যু হতে পারতো! আমি আপনাকে হত্যা করতে চেয়েছিলাম, আর আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন। এখন আমার ইচ্ছে, আপনি যদি চান, আমি সারাজীবন বিশ্বস্ততার সাথে আপনার খেদমতে কাটিয়ে দিব। আমার সন্তান–সন্ততিদেরও আমাকে অনুসরণ করতে বলব। আমাকে ক্ষমা করুন!’
সহজেই একজন শত্রুর সাথে সমঝোতা করতে পেরে এবং তাকে বন্ধু হিসেবে পেয়ে রাজা খুব খুশি হলেন। তিনি ভদ্রলোকের সেবায় ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও সেবকদের পাঠিয়ে দেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন। একইসাথে তাঁর হৃত সম্পত্তি পুনঃরুদ্ধারের প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
আহত ব্যক্তির কাছে বিদায় নিয়ে রাজা এখন সন্ন্যাসীর খোঁজে বের হলেন। যাওয়ার আগে তিনি সন্ন্যাসীর কাছে আরো একবার তাঁর প্রশ্নের উত্তর চাইবেন বলে মনস্থির করলেন। দেখতে পেলেন সন্ন্যাসী হাঁটুতে ভর দিয়ে আগের দিন তৈরি করা মাঠে বীজ বপন করছিলেন।
রাজা তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, ‘শেষবারের মতো আমি আপনার কাছে আমার প্রশ্নের উত্তর প্রার্থনা করছি।’
‘আপনাকে ইতোমধ্যে উত্তর দেওয়া হয়েছে’ সন্ন্যাসী বললেন।
‘কীভাবে উত্তর দেওয়া হয়েছে? আপনি কী বলতে চান?’ রাজা জানতে চাইলেন।
সন্ন্যাসী জবাবে বললেন, ‘আপনি চোখে দেখেন না?’ ‘আপনি যদি গতকাল আমার দুর্বলতার প্রতি দয়া পরবশ হয়ে আমাকে মাটি খননের কাজে সাহায্য না করে ফিরে যেতেন, আপনি আততায়ীর হাতে খুন হতে পারতেন! তখন আপনাকে অনুশোচনা করতে হতো আমার সাথে থেকে না যাওয়ার কারণে! সুতরাং, আপনার জন্য উৎকৃষ্ট সময় ছিল যখন মাটি কাটছিলেন, এবং আমি ছিলাম আপনার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আর আমার উপকার করা ছিল আপনার জন্য সবচেয়ে গুরুত্ববহ কাজ। পরবর্তীতে, মানুষটি যখন আমাদের কাছে দৌড়ে আসলেন তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল যখন আপনি তাঁর সেবা করছিলেন। কারণ আপনি তার ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে না দিলে আপনার সাথে শান্তি–সমঝোতা না করে তিনি মারা যেতেন। সুতরাং তিনি ছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং তাঁর সেবা করাই ছিলো আপনার জন্য সর্বোত্তম কাজ। মনে রাখবেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো বর্তমান! বর্তমানই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় কারণ এটাই একমাত্র সময় যখন আমাদের কিছু করার ক্ষমতা থাকে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলো সেই ব্যক্তি যিনি আপনার সাথে বর্তমানে আছেন কারণ কোনো মানুষই নিশ্চিতভাবে জানেন না এর পর মুহূর্তে অন্য কারো সাথে দেখা করার সুযোগ আসবে কিনা। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো বর্তমানে আপনার সাথে যিনি আছেন তাঁর প্রতি ভালো আচরণ করা।
অনুবাদক : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক