এক বছরেরও বেশি সময় ধরে দক্ষিণ চট্টগ্রামের উপজেলা, থানা ও পৌরসভায় কোনো সাংগঠনিক কমিটি নেই বিএনপির। কমিটি না থাকায় সেখানে চলছে না দলটির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডও। এদিকে তিন মাসের জন্য গঠিত দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির মেয়াদও চলে গেছে। ইতোমধ্যে ১৩ মাস পার করলেও আওতাভুক্ত সাংগঠনিক ইউনিট কমিটিগুলো গঠন করতে পারেনি এ আহ্বায়ক কমিটি। এতে তৃণমূলে স্থবির হয়ে পড়ছে দলটির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড। বিষয়টি নিয়ে তৃণমূলের কর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আহ্বায়ক কমিটির নেতৃবৃন্দেকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন তারা।
বিএনপি নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, দক্ষিণ জেলা বিএনপির অধীন ১৩টি সাংগঠনিক ইউনিট রয়েছে। এর মধ্যে ৭টি উপজেলা, ৫টি পৌরসভা ও একটি থানা রয়েছে। এগুলো হচ্ছে বাঁশখালী উপজেলা ও পৌরসভা, চন্দনাইশ উপজেলা ও পৌরসভা, লোহাগড়া উপজেলা, বোয়ালখালী উপজেলা ও পৌরসভা, পটিয়া উপজেলা ও পৌরসভা, সাতকানিয়া উপজেলা ও পৌরসভা, আনোয়ারা উপজেলা এবং কর্ণফুলী থানা। ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর আওতাভুক্ত ইউনিটগুলোতে পূর্বের কমিটি বিলুপ্ত করেছিলেন দক্ষিণ জেলার আহ্বায়ক কমিটির নেতৃবৃন্দ। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত কোনো ইউনিটের কমিটি গঠন করা হয়নি।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির এক নেতা আজাদীকে বলেন, আহ্বায়ক কমিটি চাইলে দুদিনের মধ্যেই ইউনিট কমিটিগুলো গঠন করতে পারে। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। তাদের হাতে পূর্ণ ক্ষমতা নেই। আহ্বায়ক কমিটি ইউনিটের খসড়া প্রস্তুত করবে এবং সেটা কেন্দ্র পাঠিয়ে দেবে। এরপর কেন্দ্র থেকে অনুমোদন পেলেই তা ঘোষণা করা হবে। সেক্ষেত্রে লন্ডনে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সম্মতির বিষয়ও জড়িত।
দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান আজাদীকে বলেন, উপজেলা ও পৌরসভা কমিটিগুলো প্রায় রেডি করে ফেলছি। শীঘ্রই ঘোষণা দিয়ে দেব। যারা দীর্ঘদিন রাজপথে ছিলেন, আন্দোলন-সংগ্রামে ভূমিকা রেখেছেন তাদের নিয়েই কমিটি গঠন করব।
দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব মোস্তাক আহমেদ খান আজাদীকে বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এজন্য তখন কিছুটা বিলম্ব হয়। এরপর করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে মার্চ থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ছয় মাস সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড বন্ধ ছিল। ফলে ইউনিট কমিটিগুলো গঠন করা সম্ভব হয়নি। তবে অক্টোবর মাসের পুরোটাই আমরা কাজ করেছি এবং কমিটিও চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। শেষবারের মতো যাচাই-বাছাই করছি। এক্ষেত্রে যারা মাঠ পর্যায়ে দলের কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন এবং যাদের গ্রহণযোগ্যতা আছে তাদেরকেই কমিটিতে স্থান দেওয়ার চেষ্টা করছি। যাতে পরবর্তীতে কোনো সমালোচনা না হয় এবং কথা না ওঠে।
দীর্ঘদিন ধরে উপজেলা ও পৌরসভা কমিটি না থাকায় সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে কোনো প্রভাব পড়ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাংগঠনিক কমিটি না থাকলেও সমস্যা হচ্ছে না। কারণ উপজেলা ও পৌরসভা বিলুপ্ত করার সময় যারা নেতৃত্বে ছিলেন তারা সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। প্রতিটি উপজেলার সিনিয়র নেতারা দক্ষিণ জেলার আহ্বায়ক কমিটির সদস্য। তারাও সবকিছু খোঁজ-খবর রাখছেন। সবার সঙ্গেও আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ আছে।
তিন মাসের কমিটির ১৩ মাস পার : সাড়ে আট বছর পর গত ২ অক্টোবর বিদ্যমান কমিটি ভেঙে দিয়ে দক্ষিণ জেলা বিএনপির ৬৫ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটির অনুমোদন দেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এতে মহানগর বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি আবু সুফিয়ানকে আহ্বায়ক এবং বোয়ালখালী উপজেলা বিএনপির সভাপতি মোস্তাক আহমেদ খানকে সদস্য সচিব করা হয়।
এ কমিটিকে তিন মাসের মধ্যে আওতাভুক্ত প্রতিটি উপজেলা, থানা ও পৌরসভা এবং দক্ষিণ জেলার কাউন্সিল শেষ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। ওই হিসেবে কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ২ জানুয়ারি। কিন্তু দক্ষিণ জেলার কাউন্সিল তো দূরের কথা, গতকাল পর্যন্ত একটি কমিটিও গঠন করতে পারেনি।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দক্ষিণ জেলার আওতাধীন একটি উপজেলার সাবেক সভাপতি আজাদীকে বলেন, আহ্বায়ক কমিটি ব্যর্থ হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে তারা একটিও সাংগঠনিক কমিটি (উপজেলা, থানা ও পৌরসভা) গঠন করতে পারেনি। উদ্যোগ নিতেও দেখা যায়নি। অন্তত একটি কমিটি গঠন করতে পারলেও বলা যেত তারা চেষ্টা করেছেন। কেন্দ্রের উচিত তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা। তাছাড়া তারা এখন করোনার কথা বলছেন। বাস্তবতা হচ্ছে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার আগেই তাদের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। করোনার প্রাদুর্ভাবে সাংগঠনিক কার্যক্রম বন্ধ হয় মার্চ মাসে। এর আগে তারা কী করেছিলেন?
অপর এক নেতা বলেন, নিজের পছন্দের বাইরে গিয়ে দ্রুত সময়ে কমিটি গঠন এবং সম্মেলন করার জন্য মহানগরের নেতাকে দক্ষিণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যে লাউ সেই কদু। প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে বিএনপির মতো একটি বড় দলে দক্ষিণ চট্টগ্রামে কোনো ইউনিট কমিটি নেই। এটা দলের জন্যও বিব্রতকর।
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে সম্মেলনের মাধ্যমে গঠন করা হয়েছিল দক্ষিণ জেলা বিএনপির কমিটি। ওই সময় জাফরুল ইসলাম চৌধুরীকে সভাপতি ও শেখ মোহাম্মদ মহিউদ্দীনকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছিল। যা দলটির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া অনুমোদনও দিয়েছিলেন। ২০১১ সালের এপ্রিলে পুনর্গঠন করা হয়। সেবার জাফরুল ইসলাম চৌধুরীকে সভাপতি, গাজী শাজাহান জুয়েলকে করা হয় সাধারণ সম্পাদক ও শেখ মোহাম্মদ মহিউদ্দীনকে সহ-সভাপতি করা হয়। তিন বছরের জন্য গঠিত এ কমিটি আট বছর পাঁচ মাস পার করার পর তা ভেঙে দেওয়া হয় ২০১৯ সালের ২ অক্টোবর।
মাঝখানে ২০১৭ সালে একবার কমিটি পুনর্গঠনের উদ্যোগ ছিল। কেন্দ্রের চাপে ওই বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বৈঠক করেছিলেন দক্ষিণ জেলা বিএনপি নেতৃবৃন্দ। কিন্তু নিজেদের মধ্যে সমঝোতা না হওয়ায় ভেস্তে যায় সেই উদ্যোগ।