থার্মোমিটারের পারদ এ বছর তরতর করে কেবল উপরের দিকে উঠছে। ইতোমধ্যে দুটি রেকর্ডের সৃষ্টি হয়েছে চলতি মাসে। ৫৮ বছরের মধ্যে ঢাকার তাপমাত্রা এখন সর্বোচ্চ। আর ৯ বছরের মধ্যে চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।
গত ৪ এপ্রিল থেকে ক্রমান্বয়ে বাড়ছিল তাপমাত্রা, যা ১৫ এপ্রিল এসে ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠে চুয়াডাঙ্গায়। ঢাকায় থার্মোমিটারের পারদ ওঠে ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এপ্রিলে তাপপ্রবাহ স্বাভাবিক ঘটনা হলেও এবারের তাপমাত্রা বেড়েছে ক্রমান্বয়ে। রোদের প্রখরতাও অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, তিন কারণে এবারের তাপপ্রবাহের মাত্রা অন্যান্য বছরের চেয়ে বেশি। যার একটি হলো জলীয় বাষ্প অস্বাভাবিক থাকা, দক্ষিণ–পূর্ব মৌসুমী বায়ু কম আসা ও সাগরে কোনো ঘূর্ণিঝড়ের প্রক্রিয়া সৃষ্টি না হওয়া। খবর বাংলানিউজের।
আবহাওয়াবিদ মো. শাহীনুল ইসলাম বলেন, সাগর থেকে যে বাতাসটা আসে সেটা দক্ষিণ–পূর্ব মৌসুমী বায়ু। সেটা আসার সময় জলীয় বাষ্প নিয়ে আসে। কিন্তু এবার বাতাসটা আসছে না সেভাবে। আর জলীয় বাষ্পও খুব কম। পশ্চিমা মৌসুমী বায়ু হচ্ছে শুকনো। এটার সঙ্গে দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলীয় বায়ু যেখানে যেখানে মেশে সেখানে কালবৈশাখীর সৃষ্টি হয়। সেটা হচ্ছে না। কেননা জলীয় বাষ্প কম। ফলে শুকনো বায়ু প্রবেশ করছে দেশে আর তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। আবার সাগরেও সাইক্লোন ফর্ম করে, সে প্রক্রিয়াটাও নেই। তাই কোনো দিক থেকেই আবহাওয়া বৃষ্টিপাতের অনুকূলে নয়। এটা মানবসৃষ্ট কোনো কারণ নয়। প্রাকৃতিক কারণেই হয়তো হচ্ছে। এর আগেও এমন তাপমাত্রা বেড়েছে।
আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক জানিয়েছেন, দক্ষিণ–পূর্ব মৌসুমী বায়ু প্রায় নেই বললেই চলে, যার সঙ্গে বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্পও আসছে না। তিনি বলেন, ৫০ শতাংশের মতো বাতাসে জলীয় বাষ্প থাকলে আমরা সেই অবস্থাকে স্বাভাবিক বলি। কিন্তু এবার ১৭ থেকে ২০ শতাংশে মতো জলীয় ছিল গত কয়েকদিনে। এই রকম জলীয় বাষ্প থাকে শীতকালে। অন্যান্য বছরও এপ্রিলে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কম থাকে। তবে এবার একটু বেশিই কম। তবে ধীরে ধীরে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বাড়ছে। এক্ষেত্রে আগামী কয়েকদিনে বৃষ্টিপাতের দেখা মিলতে পারে। ২৪ এপ্রিলের দিকে সারা দেশে কালবৈশাখী ঝড় হতে পারে।
ঢাকায় পারদ উঠেছে আরো : বিডিনিউজ জানায়, দেশজুড়ে টানা দুই সপ্তাহ ধরে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। বৈশাখের শুরুতে বৃষ্টিহীন এই সময়ে তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে ঢাকায়। গতকাল যশোর ও চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বোচ্চ ৪১.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। আর ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ কাজী জেবুননেসা বলেন, রোববার ঢাকা, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, পাবনা, বাগেরহাট, যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। দেশের অন্যত্র বয়ে যাচ্ছে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ। আরও দুই–তিন দিন এমন তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। এর মধ্যে সারা দেশে দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে এবং রাতের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে।
ঢাকায় ছয় দশকের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা : গতকাল ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস; যা ৫৮ মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। এর আগে ১৯৬৫ সালে এপ্রিল মাসে ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। ১৯৬০ সালে ঢাকায় পারদ উঠেছিল রেকর্ড ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় যশোর ও চূয়াডাঙ্গায় ৪১.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে ২০১৪ সালে চুয়াডাঙ্গায় ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল। তার আগে ১৯৯৫ সালে এবং ২০০২ সালে দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠেছিল ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফিক অ্যান্ড মেরিটাইম ইনস্টিটিউটের (নোয়ামি) সাবেক চেয়ারম্যান সমরেন্দ্র কর্মকার বলেন, সাতক্ষীরা, যশোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী অঞ্চলই আমাদের হিটওয়েভ ও কোল্ডওয়েভের জায়গা। তাপপ্রবাহপ্রবণ এসব এলাকা দিয়ে শৈত্যপ্রবাহও একইভাবে প্রবেশ করে। উত্তর–পশ্চিম দিকে থেকে গরমকালে যেটা হিটওয়েভ নিয়ে আসে, সেখান দিয়েই শীতকালে কোল্ডওয়েভ নিয়ে আসে।
তিনি বলেন, বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, বিহার, ওয়েস্ট বেঙ্গল, বাংলাদেশ ও তৎসংলগ্ন ওড়িষার কিছু এলাকা কমপ্লিটটি ফাঁকা। মেঘ নেই, সূর্যের আলো পড়ার পর স্বাভাকিভাবে হিট এনার্জি বেশি হয়ে যাচ্ছে এ ফাঁকা জায়গায়। এরপর পশ্চিম দিকে থেকে বা উত্তর–পশ্চিম দিক থেকে যে মেঘগুলো আসে ঝাড়খণ্ড, ওয়েস্টার্ন বিহার, ওড়িষা থেকে এসে ভ্যানিশ হয়ে যায়। ওয়েস্ট বেঙ্গল, বিহার ও বাংলাদেশের উষ্ণমণ্ডলীয় উচ্চ চাপবলয় সক্রিয় থাকে। বঙ্গোপসাগর থেকে ময়েশ্চার আসতে পারে না। বৃষ্টি হওয়ার জন্য যে লো প্রেসার দরকার হয়; বিহার ও ওয়েস্টবেঙ্গল এলাকায় সেটা তৈরি হচ্ছে না।